ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানুষেরই জয় ॥ ফণীর তান্ডব মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ৬ মে ২০১৯

মানুষেরই জয় ॥ ফণীর তান্ডব মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি

কাওসার রহমান ॥ তান্ডবের যে রূপ ওড়িশা দেখেছে, তার ধারেকাছে নেই বাংলাদেশ। যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেকটাই কম প্রভাব পড়েছে এ দেশে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা অংশ ছাড়া (বকখালি, নামখানা, ডায়ম- হারবার) খুব একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এখন পর্যন্ত যা তথ্য তাতে সরকারী হিসেবে ৪ এবং বেসরকারী হিসেবে ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় জেলাগুলোতে কয়েক হাজার কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। আর ফণীর নিম্ন চাপের মধ্যে হঠাৎ সৃষ্ট এক টর্নেডোয় নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের কাঁচা বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তি আর মানুষের মেলবন্ধনেই ফণী আইলা হয়ে উঠতে পারেনি। এড়ানো গেছে ফণীর ভয়াবহ বিপর্যয়। এটা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির ফল। অনেক আগে থেকেই আবহাওয়া দফতরের নিখুঁত সতর্কবার্তার কারণে হাতে প্রচুর সময় পাওয়া গেছে আটঘাঁট বেঁধে প্রস্তুতি গ্রহণের। দুর্যোগ ও ত্রাণ সচিব মোঃ শাহ কামালের ভাষায়, প্রস্তুতি ভাল থাকলে পরীক্ষা ভাল হয়। সত্যিই এবার ভাল পরীক্ষা দিয়েছে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং উপকূলীয় প্রশাসন। তাদের আগেভাগেই জোরাল প্রস্তুতির কারণে এবার ফণীতে প্রাণহানি একেবারেই কম হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াইয়ে বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে ফণীযুদ্ধে অন্তত জয় হয়েছে মানুষেরই। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, আবহাওয়া অধিদফতর এবার ঝড়ের সময় যে পূর্বাভাস দিয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য। এমন পূর্বাভাস না দিলে মানুষ সতর্ক হতে পারত না। তারা তাদের ১০০ শতাংশ কাজ দেখিয়েছে। আসলে, ১০ বছর আগের আইলার অভিজ্ঞতা থাকায় এমনিতেই প্রশাসনিক তৎপরতা ছিল। ফলে উপকূলের সাইক্লোনিক জোনের বাসিন্দারা সাইক্লোন শেল্টারে শুক্রবার দুপুর থেকেই আশ্রয় নেন। ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার এটা একটা অন্যতম কারণ। একই সঙ্গে ফণীর শক্তি হারানোও একটা বড় কারণ। আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, যে শক্তিতে বাংলাদেশে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল, সেই হিসেবে কোন ভুল ছিল না। সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম বা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হয়েই শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ওড়িশা হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে ফণী। ঘণ্টায় প্রায় ৯০ কিলোমিটার বেগে খড়গপুরের বুকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হিসেবেই ফণী তান্ডব চালায়। বকখালিতেও গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৯০ কিলোমিটার। কলকাতা থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে ফণীর দূরত্ব থাকায় ঝড়ের গতি ছিল প্রায় ৫০ কিলোমিটার। তার পর কলকাতার পাশ কাটিয়ে ক্রমশ হুগলির আরামবাগ, বর্ধমানের কাটোয়া হয়ে নদিয়ায় প্রবেশ করে ফণী। কিন্তু স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দ্রুতগতিতে শক্তি খোয়াতে শুরু করে ফণী। এত দ্রুত যে ফণী শক্তি হারাবে সেটা আশা করেননি আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় হয়ে পশ্চিমবঙ্গে তান্ডব চালানোর পর শক্তি খুইয়ে বাংলাদেশে সাইক্লোনিক স্টর্ম বা ঘূর্ণিঝড় হয়ে প্রবেশ করার কথা ছিল ফণীর। কিন্তু দ্রুত শক্তি খোয়ানোর ফলে পশ্চিমবঙ্গেই ফণী শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় থেকে শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে যায়। দ্রুত আরও শক্তি খোয়াতে শুরু করে। ফণীর গতিবিধির ওপর নজর রাখা আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, শুধু গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়ে শনিবার দুপুরে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঘূর্ণিঝড় ফণী। ফলে যে প্রবল আশঙ্কায় প্রহর গুনছিলেন সাধারণ মানুষ, তার অভিঘাত অনেকটাই কম হয়। গভীর নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশে ঝড়োহাওয়া বয়ে যায়। সঙ্গে বৃষ্টিপাত হয়। তবে যে ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছিল সেটাও হয়নি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, খুব দ্রুত গভীর নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় যে পরিমাণ হাওয়ার গতিবেগ হবে অনুমান করা হয়েছিল, তার থেকে গতিবেগ ১০-২০ কিলোমিটার কম ছিল। তবে বঙ্গোপসাগর থেকে স্থলভাগের যে অংশে প্রথম আঘাত করে, সেখানেই সব থেকে বেশি গতিবেগ থাকে ঘূর্ণিঝড়ের। তাই ওড়িশাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে ফণীর। তার পর যেহেতু স্থলভাগ দিয়ে বেশি সময় ধরে ঘূর্ণিঝড়টি বয়ে গেছে, তাই বাধা পেয়ে গতিটাও অনেক কমে গেছে। মূলত, এবারের ফণীতে ভারত ও বাংলাদেশের মানুষ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতি দেখেছে। এ অগ্রগতির কারণে অনেক আগে আবহাওয়া দফতর সতর্কবার্তা দিতে পেরেছে। সময় হাতে পাওয়ায় আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতিও নিতে পেরেছে প্রশাসন। ফলে বলা যায়, প্রযুক্তি আর মানুষের এই মেলবন্ধনেই এড়ানো গেছে ফণীর ভয়াবহ বিপর্যয়। ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলা যা করতে পেরেছিল, ধারে-ভারে তার চেয়ে কম না হয়েও ততটা দাঁত ফোটাতে পারেনি ফণী। প্রাণহানি নামমাত্র। বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতিও তুলনায় অনেক কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার প্রধান কারণ আবহবিদ্যায় কার্যত বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানান, ‘তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ, পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা দেয়া এবং পরবর্তী পদক্ষেপ, সব ক্ষেত্রেই বহু যোজন এগিয়ে গেছে প্রযুক্তি। সমন্বয় বেড়েছে সব দফতরের মধ্যে। আবহাওয়া দফতর ডিজিটাইজড হয়েছে। আগে যেখানে মাত্র ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাস দেয়া হতো, এখন সেখানে ৫ দিন পর আবহাওয়া কেমন থাকবে তার পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব এবং সেভাবেই নিয়মিত আবহাওয়া দফতরের ওয়েবসাইটে দেয়াও হয়। অতীতে বড় বড় দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। যার ধ্বংসলীলাও গা শিউরে ওঠার মতো। ১৯৭০ সালের ১২ নবেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে প্রায় ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ লোক মৃত্যুবরণ করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘূর্ণিঝড়ে এত বেশি লোক আর কখনও মারা যায়নি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার লোক নিহত হয়েছিল। তখনও দেশভিত্তিক সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেয়ার প্রচলনও শুরু হয়নি। নাম দেয়ার প্রচলন শুরুর পর ২০০৭ সালের ১৫ নবেম্বর খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতার প্রবল ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে, যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ২২৩ কিলোমিটার। জোয়ারের সময় হয়নি বলে প্লাবন কম হয়েছে, ফলে তুলনামূলক মানুষ কম মারা গেছে, কিন্তু অবকাঠামোগত অনেক ক্ষতি হয়েছে, বাড়িঘর ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ২০০৭ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিডরে প্রাণ হারান ২,২১৭ জন। এরপর সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের নাম আইলা। আইলায় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে, ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় এবং তার সঙ্গে বিশাল জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়েছিল সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এই ঘূর্ণিঝড়ে খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্রাণ হারান ১৯৩ মানুষ। ওই দুই সাইক্লোনের সঙ্গে তুলনা করলে ফণীর ক্ষয়ক্ষতি খুবই সামান্য। এর অন্যতম কারণ আবহাওয়া বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারত অনেক এগিয়ে। দুই দেশের মধ্যকার চুক্তির মাধ্যমে আবহাওয়া ও বন্যার সব তথ্যই দুই দেশ নিয়মিত বিনিময় করছে। তার বদৌলতেই বাংলাদেশ এক সপ্তাহ আগে এই ফণীর খবর পেয়ে যায়। ফলে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার সব প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামগ্রিক সমন্বয় ব্যবস্থার মাধ্যমেই এই বিপর্যয় রুখে দেয়া সম্ভব হয়েছে। নব্বইয়ের দশকে ভারতে ছিল একটি স্যাটেলাইট। তার তথ্য বিশ্লেষণ করে ‘ম্যানুয়ালি’ ছবি এঁকে পূর্বাভাস দিতে হতো। যা মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম ছিল। কিন্তু এখন কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে বহু সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলো সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নির্ভুলের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া কোন এলাকার আবহাওয়ার গতিবিধি পাঁচ দিন আগে থেকেই এখন জানা যায়। আগে যেটা ছিল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। আর সাইক্লোনের ক্ষেত্রে তো দু’সপ্তাহ আগে থেকেই ক্রমাগত পূর্বাভাস দেয়া হয়। সব মিলিয়ে অন্তত সাত দিন আগে থেকে সতর্কবার্তা দিতে পেরেছে আবহাওয়া অফিস। আগে সাইক্লোন ওয়ার্নিং দেয়া যেত মাত্র একদিন আগে। তখন স্মার্ট ফোনও আসেনি। ঘরে ঘরে এসে পৌঁছয়নি টিভি। ফলে আবহাওয়ার খবর জানতে ভরসা ছিল রেডিও এবং বিটিভি। কিন্তু সেই দুই মাধ্যমও এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আবহাওয়ার গতিবিধির খবর দিতে পারত না। আইলার সতর্কবার্তা দেয়া হয়েছিল ৭২ ঘণ্টা অর্থাৎ তিন দিন আগে। যদিও তখনও সেই প্রযুক্তি সবে হাঁটি হাঁটি পা পা। কারণ ওই বছর থেকেই প্রথম তিন দিন আগের পূর্বাভাস দিতে শুরু করেছিল আবহাওয়া দফতর। তবে কিছুটা হলেও আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া গিয়েছিল। এই দুই সুপার সাইক্লোনের তুলনায় ফণীর গতিবিধি ছিল আবহবিদদের কার্যত নখদর্পণে। এমনকি, স্মার্ট ফোনের কল্যাণে সাধারণ মানুষেরও হাতের মুঠোয় ছিল তার অভিমুখ, নড়াচড়ার খবর। সাধারণ মানুষও পেয়েছেন প্রতি মুহূর্তের অগ্রগতির খবর, হাওয়ার গতিবেগ, অবস্থান। আগে থেকে সতর্কবার্তা দেয়ায় সবচেয়ে বড় সুবিধা হয়েছে উপকূল এলাকার মানুষজনকে সরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে। প্রশাসনের সাহায্যে গ্রামের পর গ্রাম কার্যত খালি করে দেয়া হয়েছে। আশ্রয় দেয়া হয়েছে সাইক্লোন শেল্টারে বা এমন জায়গায় ঘূর্ণিঝড় এলেও যেখানে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশে এবার সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১২ লাখ মানুষকে। ফলে অবকাঠামো এবং প্রাকৃতিক গাছপালা ছাড়া কার্যত কোন ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি ফণী। আবার হাতে চার-পাঁচ দিন সময় পাওয়ায় সমুদ্রেও বার্তা পাঠানো সহজ হয়েছে। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া মৎস্যজীবীরা উপকূলে ফিরে আসার সময় পেয়েছেন। গভীর সমুদ্রে টানা নজরদারি চালিয়েছে উপকূল রক্ষী বাহিনী। বার্তা উপেক্ষা করে কেউ থেকে গেলেও তাদের ফিরিয়ে এনেছেন। ফলে সমুদ্রবক্ষ ছিল কার্যত ফাঁকা। প্রাণহানি হয়নি। আবহাওয়া বিজ্ঞান বলছে, নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আছড়ে পড়ার পর যত বেশি স্থলভাগে প্রবেশ করে, তত তাড়াতাড়ি তার শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। অর্থাৎ স্থলভাগের শুষ্ক বাতাস যত বেশি পাবে, তত তার শক্তি কমতে থাকে। গত ২৭ এপ্রিল সাগরে সৃষ্টি হয় ‘ফণী’। টানা পাঁচ দিন সাগরে অবস্থানের ফলে শক্তি সঞ্চয় করে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এটি। এর প্রায় সাতদিন পর শনিবার (৪ মে) সকালে বাংলাদেশের ভূখন্ডে আঘাত হানে ‘ফণী’। শুক্রবার ভারতের পুরীতে আছড়ে পড়ে শক্তিশালী এই ঝড়। তখন এর গতিবেগ ছিল ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার। এরপর প্রায় ২৪ ঘণ্টা ভারতে তান্ডব চালিয়েছে। সকালের দিকে দুর্বল হয়ে এর গতিবেগ যখন ১০০ থেকে ৮০ কিলোমিটার তখন সেটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এতে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টি সাধারণ ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। গতি কমে যায় ৬২ থেকে ৮০ কিলোমিটারে। ফলে ক্ষয়ক্ষতি তেমন হয়নি। ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’ বাংলাদেশ অতিক্রমের সময় কেবলমাত্র সর্বোচ্চ ৭৪ কিলোমিটার বেগে বরিশালে আঘাত হেনেছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে সমালোচনার কিছু নেই। যাদের উদ্দেশে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে তারা নিরাপদে থাকুক, এটাই পূর্বাভাসের উদ্দেশ্য। তারা সবাই সতর্ক হতে পেরেছেন কিনা, সেটাই জরুরী। ঝড়ের গতিবেগের বিষয়ে আগে থেকে কিছু তথ্য দেয়া সম্ভব। কিন্তু সেটি একেবারে শতভাগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তারা আরও বলছেন, ঝড় দুর্বল হয়ে যেতে পারে, এ ধরনের পূর্বাভাসের কারণে অনেকে হয়ত আশ্রয়কেন্দ্রে যেতেই চাইবেন না। সেক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে। কোন কারণে ঝড়টি শক্তি সঞ্চয় করে শক্তিশালী হয়ে আসে তাহলে তার দায় কে নেবে? জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, আবহাওয়া অধিদফতর এবার ঝড়ের সময় যে পূর্বাভাস দিয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য। এমন পূর্বাভাস না দিলে মানুষ সতর্ক হতে পারত না। তারা তাদের ১০০ শতাংশ কাজ দেখিয়েছে। তিনি বলেন, তবে তাদের এই পূর্বাভাসের ভাষা আরও বোধগম্য করা জরুরী। সেক্ষেত্রে আবহাওয়া অধিদফতরের কোন ভূমিকা অবশ্য নেই। এই কাজটি করতে হবে উপর থেকে। ভাষা বোধগম্য করা গেলে সতর্কবার্তার সংকেত বোঝা, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া সাধারণ মানুষের জন্য সহজ হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব ডিজাস্টার সায়েন্স এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের লেকচারার বি এম রাব্বি হোসেইন বলেন, আগে থেকে কোন পূর্বাভাসই ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। মোটামুটি বলা সম্ভব। এবার আবহাওয়া যে পূর্বাভাস দিয়েছে তা একেবারেই ঠিক ছিল। কিন্তু ঝড়টি ভারতে আঘাত হানায় এর গতি কমে গেছে। তিনি বলেন, ঝড়ের গতি প্রতিমুহূর্তে বদলায়। কোন কারণে যদি ঝড়টি সরাসরি বাংলাদেশে আসত তাহলে কী হতো, সেই চিন্তা থেকেই পূর্বাভাসগুলো দিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করা হয়। আগে থেকেই যদি বলা হতো ঝড়ের গতি কমে যাবে তাহলে অনেকেই হয়ত শেল্টার সেন্টারে যেতেন না। আর ওই সময় যদি সত্যিই ২০০ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশে আঘাত হানত তাহলে তার দায় কে নিতো? ভারতে যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে সে পরিমাণ ক্ষতি বাংলাদেশেও হতে পারত। ফলে এই ধরনের পূর্বাভাসের প্রয়োজন আছে। মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্যই সতর্ক করা হয়। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা যেভাবে ওয়ার্নিং দিয়েছি সেভাবে সবাই প্রস্তুতি নিয়ে শেল্টারে গিয়েছে। যারা ওয়ার্নিং ব্যবহার করেছেন তাদের সুবিধা হয়েছে। কিন্তু যারা দূরে ছিলেন তাদের জন্য এই ওয়ার্নিংয়ের কোন মূল্য নেই। তিনি বলেন, আবহাওয়া পূর্বাভাস নিয়ে সমালোচনার কিছু নেই। যারা সমালোচনা করছেন তাদের হয়ত এই পূর্বাভাস কোন কাজে লাগেনি। সাংবাদিকদের অনেকেই আমাদের পূর্বাভাসগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করায় সাধারণ মানুষ দ্রুত ঝড়টি সম্পর্কে জানতে পেরেছে। ঝড়টি কোথায় কী অবস্থায় আছে, কখন আঘাত হানতে পারে, তারও একটি পূর্বাভাস আমরা দিয়েছি। সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেই পূর্বাভাসগুলো দিয়েছি। এর চেয়ে নতুন কোন প্রযুক্তি এখনও আসেনি। তিনি বলেন, ঝড় যে দুর্বল হয়ে যাবে সেটা আমরা জানলেও অনেক সময় কৌশলগত কারণে বলি না। এতে মানুষ অসতর্ক হয়ে পড়তে পারে। আগে থেকে বলে দিলে অনেক সময় ক্ষতিও হয়। এছাড়া একেবারে নিশ্চিত করে তো বলা সম্ভব নয় যে ঝড়ের গতি কমে যাবে। কারণ বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। আবহাওয়া অধিদফতরের পরিচালক বলেন, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সবাই যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। খাটো করে ঝড়কে যেন না দেখে সেভাবেই তথ্যগুলো দেয়া হয়েছে। মানুষের যাতে ক্ষতি না হয়, তারা যেন নিরাপদে থাকে।
×