ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

৬ মে, ১৯৭১

সেকেন্ড ফ্লাড অব ইস্ট পাকিস্তান

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ৬ মে ২০১৯

 সেকেন্ড ফ্লাড অব ইস্ট পাকিস্তান

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ৬ মে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তাদের আত্মমর্যাদার অধিকার আদায়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। গণহত্যা বাঙালীদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত সুচতুর এক ধ্বংসযজ্ঞ। বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদী চক্র কর্তৃক অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়ে আসছে। বর্তমানে যা জনগণের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। মুক্তি সংগ্রাম ইতোমধ্যে গ্রামের দিকগুলোতেও শুরু হয়ে গিয়েছে এবং প্রথম শ্রেণীর গেরিলা কলাকৌশল অবলম্বন করছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভেতরে কী ঘটছে তা জানার কোন উপায় নেই বহির্বিশ্বের। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার দেশ থেকে সকল বিদেশী সাংবাদিকদের অপসারণ করেছে এবং দেশের অভ্যন্তরে বিদেশী কূটনীতিবিদদের সঙ্গে অবরোধ করে দিয়েছে এবং বিশ্ববাসীর সঙ্গে সকল ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। রেডক্রসের সহযোগিতা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং সংগঠনের সদস্যদের করাচি বিমানবন্দর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। সকল স্থানীয় খবরের প্রতিবেদনসমূহ সেন্সর করা হচ্ছে এবং পত্রিকা মালিকদের অস্ত্রের মুখে সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রতিবেদন লেখার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। এই দিন মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার চৌমুহনী-চন্দ্রগঞ্জ রাস্তার ফেনাকাটা পুল এলাকায় এ্যামবুশ করে। পাকবাহিনীর সৈন্য বোঝাই তিনটি ট্রাক চন্দ্রগঞ্জ থেকে চৌমুহনী যাবার পথে ফেনাকাটায় পৌঁছলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রচ- সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে মুক্তিযোদ্ধা ইলিয়াস শাহাদাৎবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ‘ফেনাকাটা পুলের সংঘর্ষ’ নামে পরিচিত। তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সদর দফতরের ওপর পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাকসেনারা দ্রুত পালাতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক হতাহত হয়। সকালে পাকসেনারা পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি এলাকায় প্রবেশ করে শর্ষিনার পীরের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে। শর্ষিনার পুল থেকে থানা পর্যন্ত এলাকার সমস্ত হিন্দু বাড়ি প্রথমে লুট ও পরে অগ্নিসংযোগ করে এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। পাকসেনাদের অপর একটি দল আলঘারকাঠির দিকে যায় এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পিরোজপুরে পাকহানাদার বাহিনী দুর্নীতি দমন বিভাগের দারোগা হীরেন্দ্র মহাজনসহ ৫ মে বন্দীকৃত এসডিও আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান, এসডিপিও ফয়জুর রহমানকে বলেশ্বর নদীর পাড়ে নিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। সিলেটের কুলাউড়া থানায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। তাদের নির্মূল অভিযানের শিকার হয় ২শর বেশি নিরীহ মানুষ। এ থানার পৃথ্বিমপাশা নামক এলাকায়ও বর্বররা নিধনযজ্ঞ চালায়। এতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়। সিনেটর ওয়াল্টার মন্ডেল মার্কিন সিনেটে বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ের পর গৃহযুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ভয়ঙ্কর এক দুর্যোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ অবস্থায় একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারের গৃহীত জরুরী পদক্ষেপই লাখ লাখ মানুষকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের সভাপতি বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো এবং নির্বাহক মি. জে.আর.বড়ুয়া জেনারেল হামিদ ও গবর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো বৌদ্ধ পূর্ণিমার পরপরই চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও পটুয়াখালী এলাকা সফর করে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সংগঠিত করবেন বলে জানান। পাকিস্তানী ঘাতকরা কুষ্টিয়ায় নেপালী শ্রমিকসহ স্থানীয় শ্রমিকদের পাইকারিভাবে হত্যা করে। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারী মুখপাত্র তথ্য প্রকাশ করে বলেন, আওয়ামী লীগ ২৬ মার্চ শেষ রাতকে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও আনুষ্ঠানিকভাবে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার সময় নির্ধারণ করেছিল। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিমান ও সমুদ্র পথের সংযোগস্থল ঢাকা-চট্টগ্রাম দখলের পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের নির্ধারিত সময়ের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সামরিক তৎপরতা শুরু করে এবং ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী মাঝ রাতের আগেই ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়ে দেশকে রক্ষা করে। মুখপাত্র আরো বলেন, এ সময় আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। শান্তিপূর্ণ পন্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীকে তাদের কর্তব্য পালন ও সরকারী কর্তৃত্ব সম্পূর্ণভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমর্থনে সোচ্চার হওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটি আজকের বাংলাদেশ! শিরোনামে প্রচারপত্র বিলি করেন...বাংলাদেশের ভেতরে কী ঘটছে তা জানার কোন উপায় নেই বহির্বিশ্বের। ইয়াহিয়া নিজের তৈরি সঙ্কটের সমাধান করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর বিশিষ্ট অনুসারীদের গ্রেফতার করান, তার ৮০ হাজার সৈন্যকে বাংলাদেশে হানা দিয়ে রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, ছাত্রছাত্রী, আইনজীবী এবং নারী ও শিশুসহ সব নিরস্ত্র নাগরিককে হত্যা ও বিকলাঙ্গ করে দেয়ার নির্দেশ দেন। এ ধরনের মধ্যযুগীয় বর্বরতা সংঘটনের দ্বারা ইয়াহিয়া বিশ্ববিবেককে অসম্মান জানায় এবং জাতির সভ্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসার নিজ অধিকার নষ্ট করে। এখনই সময় বিবেকনিষ্ঠ গর্জে ওঠার এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধের জন্য তার ওপর চাপ সৃষ্টি করার। ‘সেকেন্ড ফ্লাড অভ ইস্ট পাকিস্তান’ শিরোনামে লন্ডনের দ্য সানডে টাইমস-এ বলা হয়েছে: ‘পাকিস্তানের বর্তমান অশান্তি মূলত ব্রিটিশ ভারত পৃথকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি যৌক্তিক সমাপ্তি, যা ২৫ বছর আগেই শুরু হয়েছিল। সম্পূর্ণ পৃথক এবং বিশেষ করে একটি মুসলিম রাষ্ট্র তৈরির ওপর জোর দিয়ে মরহুম জিন্নাহ ও তার মুসলিম লীগের সহকর্মীরা শুধু মুসলিম ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে দুটি জাতির জন্ম দিয়েছিলেন, যা ছিল সংস্কৃতি, ভাষা এবং হাজার হাজার মাইল শত্রুতাপূর্ণ ভারতীয় এলাকা দ্বারা সম্পূর্ণ আলাদা।’ এদিন নিউইয়র্ক টাইমস ‘পাশবিক হত্যা’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়,গত কয়েক বছর ধরেই ওয়াশিংটন পাকিস্তান সরকারকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার নামে ভারী অস্ত্র, ট্যাংক, ও সামরিক বিমান সরবরাহ করে আসছে। দুঃখজনক হলেও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরবরাহ করা অস্ত্র, তার নিজ দেশের জনতার ওপর প্রয়োগ হচ্ছে। অতঃপর আমেরিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশেষে মানতে বাধ্য হয় যে, সেসব আগ্নেয়াস্ত্র ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবাধে গত মার্চ মাস হতে পাকিস্তানে সাধারণ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। ওয়াশিংটন আরও স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তারা সম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানকে গোলাবারুদ ও সামরিক যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে।
×