ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ভেতর থেকে আমিই বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৯:৩৪, ৬ মে ২০১৯

 ভেতর থেকে আমিই বাংলাদেশ

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বই নয়, বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্তকণিকায় জন্ম নেয়া তাঁর পরবর্তী প্রজন্মও যাতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে না পারে, সেজন্য ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের বুলেটে শিশুপুত্র রাসেলের নামটিও যুক্ত করে দিয়েছে খুনীরা। এটি কেবল শুধু একটি পরিবার বা নেতাকেই হত্যা করেনি। এই হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন-সার্বভৌম ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকে হত্যা করতে চেয়েছে। আর সে পরিকল্পনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মাটিচাপা দিয়েছে, কয়েকটি জেনারেশনকে বিপথগামী করে তুলেছে। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বরাবরই নতুন ও মেধাবীদের টার্গেট করে থাকে। তারা জানে, মুক্তিযুদ্ধকালীন মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্পের মিথ্যাচার করে কোন লাভ হবে না। আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটি কী এবং কারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে- এগুলো তখনকার মানুষ জানলেও স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের জেনারেশন মোটেও জানে না। কিংবা তখন যাদের বয়স খুব কম বা বুঝ-জ্ঞান হয়নি, তারাও মুক্তিযুদ্ধ কী বা তখন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ইসলাম কী রকম বর্বরতা ঘটিয়েছিলÑ এটিও মনে থাকার কথা নয়। আর তাই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যাতে ততটা বুঝতে না পারে বা জ্ঞান-বুদ্ধি হলেও তারা যা শিখে এসেছে তার মধ্যেই যেন ঘুরপাক খেতে থাকে, সে ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিল। ’৭৫-এর পরবর্তী সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েকটি জেনারেশনকে একদিকে অঙ্কুরে বিনাশ, অন্যদিকে পাকিস্তানপ্রীতি করে গড়ে তুলতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। আর সেসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতেও মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে পাকিস্তানপ্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে তুলে ধরে। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে এখনও তাদের পরিকল্পনায় বড় হওয়া কয়েকটা জেনারেশনের একটা বড় অংশের মধ্যে বিভ্রান্ত কাজ করে। যুদ্ধাপরাধী, রাজাকার, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে জামায়াত-ছাত্রশিবিরের অনেকের মাঝে নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা যায়। কারণ, বিএনপিসহ কতিপয় সিনিয়র রাজনৈতিক নেতার এখনও বক্তব্য, বিবৃতিসহ বিভিন্ন টেলিভিশন টকশোগুলোতে অনর্গল মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। আর জামায়াত খোলস পরিবর্তন করে নতুন নামে রাজনীতির মাঠে আসা শিবিরের সাবেক সভাপতি যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের সাজা ফাঁসির রশিতে ঝুলে মৃত্যু কার্যকর করা অপরাধীদের শহীদ বলে, তখন তাদের অন্যান্য নেতাকর্মীদের কাছে ইতিবাচক কিছু আশা করাও বোকামি। কারণ হচ্ছে, খুব ছোটকাল থেকেই ওইসব নেতাকর্মীদের ব্রেনওয়াশ করা হয়েছে। বিকৃত ইতিহাসে তারাও বিভ্রান্ত। যেমন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের কথাই ভাবুন- আন্দোলনকারীদের অনেকেই তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে ‘আমি রাজাকার’ লিখে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরেছে। ঘৃণ্য এই কাজটি শুধু আন্দোলনকারী ছাত্ররাই করেনি, অনেক ছাত্রীও নিজেকে রাজাকার বলতে লজ্জাবোধ করেনি। এই বিষয়টি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক সমালোচনা হলেও আমি একান্তভাবে একটু গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তৃতীয় বিশ্বের প্রযুক্তির এ সভ্যতায় এখনও নিজেকে রাজাকার বলার মতো মানুষ আছে, তাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী! এটি ভাবতেই কেমন যেন খারাপ লাগে। আসলে এর শুরুটা এখন নয়, অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান এ জাতির যে ক্ষতি সাধন করেছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও পাকিস্তানপ্রীতি যে জেনারেশন সৃষ্টি করেছে- এই জায়গা থেকে খুব সহসায় যে মুক্তি পাচ্ছি; এমনটাও দেখা যাচ্ছে না। অঙ্কুরেই জাতিকে ভ্রান্ত পথে পরিচালনা করার ষড়যন্ত্র থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি। বরং এই ষড়যন্ত্রের ডাল-পালা প্রসারিত হয়ে আছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থান তাদের। আর অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে মিথ্যার বিরুদ্ধে। বার বার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে হচ্ছে। আজকের এই সময়ে এসেও শেখ হাসিনাকেই মুক্তিযুদ্ধের শহীদ সংখ্যার মিথ্যাচারের জবাব দিতে হচ্ছে। দুঃখ হয়, এদেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। যারা আলোর পথ দেখিয়ে প্রজন্মকে সভ্যতার দিকে নিয়ে যাবে, মিথ্যের বিরুদ্ধে সত্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে, তাদের অনেকেই ব্যক্তিস্বার্থ আর তথাকথিত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় একাকার। এখনও ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এবং সুন্দর সুন্দর কথামালা সাজিয়ে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। এখনও কতিপয় ব্যক্তি ও মহল বাকস্বাধীনতার নামে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ করছে। ভিন্নমতের নামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করছে। আর বিভ্রান্ত হচ্ছে দেশের তরুণ সমাজ। কোটা সংস্কার আর নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাদের এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। বর্তমান যুব সমাজের একটি অংশ নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে। কী শিখার কথা আর কী শিখে এসেছে। আন্দোলনের ভাষা কী হওয়ার কথা আর তারা কী লিখছে, কী বলছে- এটিও আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের এই জায়গায় গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। মেজর জিয়া অবৈভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে অঙ্কুরেই এ জাতির যে ক্ষতি সাধন করেছে, আমাদের সেই অঙ্কুর থেকেই প্রকৃত বাংলাদেশী দেশপ্রেমিক করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছে, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, তাদের সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতিটি বর্ণমালা শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। ভাষা আন্দোলন কী এবং তখনকার পটভূমির বিস্তারিত প্রতিটি শিক্ষার্থীদের অঙ্কুরেই জানাতে হবে। সপ্তাহের একদিন বা দুইদিন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে নৈতিক শিক্ষাদানের উদ্যোগ নিতে হবে। আর নৈতিক শিক্ষা পদ্ধতি কী হবে- এটা নিয়েও বিস্তর গবেষণা করার প্রয়োজনবোধ করছি। প্রতিটা শিক্ষার্থীকে সভ্যতার আলোর পথে নিতে হলে প্রত্যেককে ভেতর থেকে ‘আমিই বঙ্গবন্ধু’ ‘আমিই বাংলাদেশ’ করে গড়ে তুলতে হবে। আর সেটা করার জন্য আমাদের অঙ্কুর থেকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলা উচিত। বছরের প্রায় প্রতি মাসেই আমাদের জাতীয় কিছু কর্মসূচী থাকে। শুধু এই কর্মসূচী পালনের আগে মাত্র দুইদিন যদি শিক্ষার্থীদের মাঝে এই কর্মসূচীর বিস্তারিত তুলে ধরতে পারি এবং কর্মসূচীতে সশরীরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারি তাহলে শিক্ষকের বলার সঙ্গে বাস্তবতার একটা সেতুবন্ধন তৈরি হবে। শিক্ষার্থীরা খুব ভালভাবে বুঝবে ও গ্রহণ করতে সহজ হবে। এই ক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলোতেও দৃষ্টি দিতে হবে বেশি। কারণ, প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী এই মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আর এই মাদ্রাসাগুলোতেই বেশিরভাগ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হয় না। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয় না। অধিকাংশ মাদ্রাসাগুলো খেলাধুলাকে হারাম করেছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের মাঝে উন্নয়নের রোল মডেল। শুধু উন্নয়ন নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পলিসির সঙ্গে সঙ্গে একজন দক্ষ ও সৎ নেতার নেতৃত্ব কেমন- এটার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে শেখ হাসিনা। ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণসহ মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা ইতিহাস গোড়াপত্তন থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে ইতিহাস ভিত্তিক, আধুনিক ও কর্মময় শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমেই ‘আমিই বাংলাদেশ’ গড়তে হবে। আর এই দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ) [email protected]
×