ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘সোনাগাজী থানার ওসিসহ উর্ধতন ৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ’

এ মাসেই নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট

প্রকাশিত: ১১:১১, ৫ মে ২০১৯

এ মাসেই নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এ মাসেই ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যা মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেবে পিবিআই। ইতোমধ্যে তৎকালীন সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) মোঃ ইকবালের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। এই দুইজনসহ চার উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে ছাত্রী নুসরাতকে যৌন নিপীড়নের মামলা করা হয়। প্রত্যাহার করতে রাজি না হওয়ায় গত ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষ সিরাজের অনুসারীরা। চার দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাত মারা যায়। এ নিয়ে দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। পরে মামলার তদন্তভার থানা পুলিশ থেকে পিবিআইর কাছে হস্তান্তর করা হয়। শনিবার সকালে রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিনি বলেন, কিছু কাগজপত্র তৈরি করে এ মাসের যে কোন দিন ১৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দেয়া হবে। তিনি বলেন, নুসরাত হত্যার ঘটনায় এদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পিবিআই তদন্ত দল। সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিমের ছাত্রী নুসরাতের পরিবারের করা যৌন নিপীড়নের মামলায় গত ২৭ মার্চ গ্রেফতার হন ওই মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ। কারাগারে থেকেই তিনি নুসরাতের গায়ে অগ্নিসংযোগের নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে পিবিআইর তদন্তে উঠে এসেছে। পিবিআই প্রধান জানান, নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার পর ৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান অধ্যক্ষ সিরাজকে প্রধান আসামি করে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর তা হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়। যার তদন্ত করছে পিবিআই। নুসরাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে নুসরাতের দুই সহপাঠী, মাদ্রাসার কয়েক ছাত্র ও স্থানীয় হাইব্রিড আওয়ামী লীগের দুই নেতাও রয়েছেন। বনজ কুমার মজুমদার জানান, এরকম একটি জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের দায় জড়িত সবাইকে নিতে হবে। এ ঘটনার আগে পরে যারা মদদ যুগিয়েছে, তারাও যাতে শাস্তি পায়, সেজন্য পুলিশের অন্য সংস্থাগুলো কাজ করছে। নুসরাতের পরিবারের প্রথম মামলার পর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেমসহ জেলা পুলিশের কিছু কর্মকর্তার গাফিলতির বিষয়টি বাহিনীর নিজস্ব তদন্তে উঠে আসে। ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাও হয়েছে। পিবিআই প্রধান জানান, মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে করা আইসিটি মামলার তদন্ত শেষ হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তারা আদালতে সময় চেয়ে আবেদন করেছে। তবে ইতোমধ্যে ওসি ও এসআইর দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। নুসরাত খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত বোরকা উদ্ধার ॥ ফেনী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার সময় সরাসরি অংশগ্রহণকারী এ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম যে বোরকা পরে ছিলেন। তা উদ্ধার করেছে পিবিআই। শনিবার দুপুরে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার পুকুর থেকে পরিত্যক্ত ওই বোরকাটি উদ্ধার করা হয়। তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দল পরিত্যক্ত বোরকাটি উদ্ধার করেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মোঃ শাহ আলম জানান, এ হত্যার ঘটনায় দ্বিতীয় দফায় দুই দিনের রিমান্ডে থাকা আসামি শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম ও জাবেদ হোসেনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আজ (শনিবার) দুপুরে তাদের দু’জনকে নিয়ে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় যায় পিবিআই। এ সময় অভিযান চালিয়ে মাদ্রাসার পুকুর থেকে শাহাদাতের পরিহিত বোরকাটি উদ্ধার করা হয়েছে। পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ মনিরুজ্জামান, পরিদর্শক মোঃ মোনায়েম হোসেন, পরিদর্শক লুৎফুর রহমানসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে তাদের দু’জনকে ফেনীর আদালতে হাজির করা হয়। এর আগে ১৪ এপ্রিল শাহাদাত ও ২০ এপ্রিল জাবেদ হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ইতোমধ্যে নুসরাত হত্যার ঘটনায় গাফিলতি ও দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগে জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পিকেএম এনামুল করিম, এসপি এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, এডিশনাল এসপি রবিউল ইসলাম, সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম, এসআই মোঃ ইকবালের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সংশ্লিষ্ট শাখায় এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। উল্লেখ্য, ৬ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে আলিমের প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে ৪-৫ জন বোরকা পরা লোক তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে নুসরাতকে উদ্ধার করে তার স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। ১০ এপ্রিল রাতে নুসরাত মারা যান। এ ঘটনায় তার মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার পর সোনাগাজী থানায় অভিযোগ নিয়ে যাওয়া নুসরাতের সঙ্গে ওসি মোয়াজ্জেমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। নুসরাতের মৃত্যুর পরদিন নুসরাতের পরিবারকে অসহযোগিতার অভিযোগে সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেমকে প্রত্যাহার করা হয়। আলোচিত এ মামলায় এজাহারভুক্ত আট আসামিসহ এ পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ ও প্রধান তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এদের মধ্যে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী পাঁচজন-শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হোসেন, জোবায়ের আহমেদ, উম্মে সুলতানা পপি ও কামরুন নাহার মনিসহ আটজন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। এছাড়া গ্রেফতার হয়েছেন হুকুমদাতা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, আশ্রয়দাতা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন, অর্থ যোগানদাতা পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ও মাদ্রাসার শিক্ষক আবছারউদ্দিন।
×