ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অল্পে বেঁচে থাকার সৌন্দর্য, অনন্য জীবন দর্শন

প্রকাশিত: ১১:০৭, ৫ মে ২০১৯

অল্পে বেঁচে থাকার সৌন্দর্য, অনন্য জীবন দর্শন

মোরসালিন মিজান ॥ গুলশানের সব রাস্তা ঘুরে যত গাছ দেখা যায়, তারও বেশি এখন দেখা যাচ্ছে ক্যাডেট কলেজ ক্লাবে। ভবনটির পাশে খোলা আঙ্গিনা। খুব বড় নয় পরিসরটি। এর পরও কয়েকশ’ গাছ। আয়েশি ভঙ্গিতে ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে। একেকটির একেক নাম। জাত পাতও আলাদা। একসঙ্গে এত গাছ দেখার সুযোগ করে দিয়েছে শিল্পী কে. এম সবুজের চতুর্থ একক বনসাই প্রদর্শনী। সামান্য ট্রে বা টবে পরিণত বৃক্ষের উপস্থাপনা। মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছেন দর্শনার্থীরা। এখান থেকে সংগ্রহ করারও সুযোগ আছে। যার যেমন পছন্দ সে অনুযায়ী বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। শনিবার তিন দিনব্যাপী প্রদর্শনীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। লিভিং আর্ট আয়োজিত প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন চারুকলা অনুষদের ডিন খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী নিসার হোসেন। এ সময় প্রদর্শনীর শিল্পীসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। বর্তমান সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল বনসাই শিল্পীদের একজন কে.এম সবুজ। বৃক্ষপ্রেম ও নান্দনিকতার বোধ থেকে এই চর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। একসময় দলীয় প্রদর্শনীতে তার বনসাই দেখা গেছে। গত কয়েক বছর ধরে একক প্রদর্শনীতে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন তিনি। এখন চলছে তার চতুর্থ একক বনসাই প্রদর্শনী। প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, এখানে বহুবিধ গাছের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। বিভিন্ন আকারের ট্রে এবং টব দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরোটা। ভরপুর প্রাণ দেখে কী যে ভাল লাগে! গাছগুলো যেন আপন পরিবেশে নিজেকে মেলে ধরেছে। আকারে ছোট। তবে বাইরে উন্মুক্ত স্থানে বড় হতে থাকা গাছের মতোই আকৃতি। প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে অর্ধশতাধিক প্রজাতির প্রায় চারশ’ গাছ। বনসাইয়ের জন্য বিশেষ উপযোগী গাছগুলো যথারীতি আছে। পাশাপাশি নতুন নিরীক্ষা করে সফল হয়েছেন সবুজ। সুন্দরবন থেকে সংগ্রহ করা সুন্দরী গাছকে টবে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জোয়ার ভাটার নিয়ম অনুসরণ করে গাছের নিচের অংশ টানা পনেরো দিন পানির নিচে রাখেন তিনি। বাকি পনেরো দিন অন্য গাছের মতোই জল দেয়া হয়। তাতেই সৌন্দর্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে গাছটি। রুট এক্সপোজ জাতীয় বনসাইয়ের মূল্য ধরা হয়েছে তিন লাখ টাকা। একই বন থেকে আনা কেওড়াকে গড়ে নেয়া হয়েছে। নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে গাছটি। মহুয়াও দুর্লভ এখন। বনসাই করে গাছটিকে হারাতে দেননি সবুজ। অর্জুন বৃক্ষেরও একাধিক বনসাই করেছেন। তেঁতুল গাছের বনসাই মনের মতো করে গড়ে নেয়া যায়। শিল্পীর স্বাধীনতা এ ক্ষেত্রে অনেক বেশি। কে. এম সবুজ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নান্দনিক রূপে এটিকে উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের চেনা গাছগুলোর একটি জাম। এত বড় গাছকে দিব্যি ট্রেতে তুলে আনা হয়েছে। ব্রুম জাতীয় বনসাই। শিল্পী জানান, এটিও তার নিরীক্ষা। প্রথমবারের মতো জাম গাছের বনসাই করেছেন তিনি। হিজল তমাল কিংবা শেওড়া যেন গাঁয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। শহুরে প্রজন্ম, নিশ্চিত করেই বলা যায়, গাছগুলো প্রথমবারের মতো দেখছে। প্রদর্শনীতে আছে নানা জাতের বট। আম বট, কাঁঠাল বটসহ আরও কিছু নাম চোখে পড়ে। প্রায় সবগুলোর গায়ে গড়নে বয়সের ছাপ। ক্ষুদ্রাকৃতির চায়না বটও বেশ আকর্ষণ করে। গোলাকার পাতা অসম্ভব ঘন হয়ে আছে। শাখা প্রশাখা সরু হলেও বেশ শক্ত। জেড প্ল্যান্টগুলোও ছোট এবং ঘন পাতার। তবে পাতাগুলো কিছুটা ভারি ও মাংসল। ফুলের গাছ নিয়েও কাজ করেছেন শিল্পী। প্রদর্শনীতে দেখা গেল গোল্ডেন কামিনীর বনসাই। পাতায় যেন সূর্যের আলো খেলা করছে। ফোকেনট্রিতে এসেছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফুল। এ্যাডেনিয়ামের ফুল আকারে বড় এবং রঙিন। সহজেই দৃষ্টি কাড়ছে। সব মিলিয়ে দেখার মতো একটি প্রদর্শনী। এর আগে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তাদের সকলেই বনসাই শিল্পের প্রতি নিজেদের ভাল লাগার কথা জানান। তবে একইসঙ্গে শিল্পী এবং নিসর্গপ্রেমী নিসার হোসেনের আলোচনায় নতুন করে চেনা হয় বনসাইকে। তিনি বলেন, আমাদের এখানে বনসাই খুব একটা পরিচিত বিষয় নয়। সীমিত সংখ্যক মানুষ চর্চাটি সম্পর্কে অবগত। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় নিয়মিত প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। সমাদৃতও হচ্ছে বনসাই। এটা ভাল লক্ষণ। কারণ আমরা যে শহরে বাস করছি, সে শহরে গাছপালার সঙ্গে সম্পর্ক একটু কমে যায়। সব শহরেই এমনটি হয়। জমির খুব আকাল দেখা দেয়। এ অবস্থায় অল্প জায়গার মধ্যে ছোটখাটো হলেও একটি বাগান করার চিন্তা করি আমরা। এমন প্রবণতা থেকেও বনসাইয়ের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। পরের আলোচনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। নিসার হোসেন বলেন, বনসাই যতটা শিল্প তারও বেশি জীবনবোধ থেকে নেয়া। চীনে একসময় বৈরাগ্যবাদী দর্শন প্রচলিত ছিল। অনেকে পাহাড়ে গিয়ে একা বসবাস করতেন। তখন তারা লক্ষ্য করেন, গাছ কী কত প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকে। টিকে থাকার এই যে সংগ্রাম, ধৈর্য তাদের মুগ্ধ করে। তারা ক্রমে বনসাই চর্চায় উদ্বুদ্ধ হন। পরে জাপানের মাধ্যমে এ চর্চাটি ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান তিনি। অবশ্য কৃত্রিমভাবে বনসাই করার বিষয়ে অনেকে দ্বিমত পোষণ করে থাকেন। নিজ থেকে প্রসঙ্গটির উল্লেখ করে চমৎকার বিশ্লেষণে যান এই বক্তা। বলেন, বনসাই চর্চার বিষয়টি জীবন দর্শন হিসেবে এসেছিল। আমরা যে কোন বিষয়ে অতৃপ্ত হই। প্রচুর পরিমাণে পাওয়ার পরও দেখা যায় যে আমরা খুশি হচ্ছি না। আরও চাই। সেখান থেকে এসেছিল যে, বেঁচে থাকার জন্য আসলে অল্প হলেও চলে। আমরা যদি চাওয়া পাওয়া একটু কমিয়ে নিতে পারি, গুটিয়ে নিতে পারি, তাহলে বেঁচে থাকা সম্ভব এবং এই বেঁচে থাকারও একটা বিউটি আছে। সৌন্দর্য আছে। ন্যূনতম চাহিদার মধ্য থেকে যে সৌন্দর্য গড়ে ওঠে সেটিও মানুষকে মুগ্ধ করে। এই সৌন্দর্য একটা আর্টে পরিণত হতে পারে। তিনি বলেন, অল্প পরিসরে ভালভাবে বেঁচে থাকার গুরুত্বপূর্ণ এই দর্শন বনসাই দেখে শেখা যায়। আমাদের দেশে প্রচুর অপচয় হয়। অপচয় রোধ করতে শেখায় বনসাই। ধৈর্য ধরতে শেখায়। কষ্ট করতে শেখায়। অল্পে বেঁচে থাকা কত সুন্দর হতে পারে, বনসাই তার রূপ দিয়ে শেখায়। তিনি বলেন, যত বেশি সিমেন্টের জিনিসপত্র দিয়ে জীবনকে ঢেকে দিতে পারব ততই যেন খুশি আমরা। এটি করতে গিয়ে অনেক গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। এমনও হতে পারে যে, বনসাইয়ের থেকেই হারিয়ে যাওয়া ওইসব গাছ একদিন ফেরত পেতে হবে। প্রদর্শনী আজ রবিবার রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে। এ সময়ের মধ্যে ঢুঁ মেরে আসুন। একবার ঢুঁ মারতে পারলে ভাল লাগবে। লাগবেই।
×