ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যায় বৃহৎ শক্তিবর্গ কেন নিরাসক্ত! ॥ ৫ মে, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:১০, ৫ মে ২০১৯

গণহত্যায় বৃহৎ শক্তিবর্গ কেন নিরাসক্ত! ॥ ৫ মে, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ৫ মে দিনটি ছিল বুধবার। এদিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বেতার ভাষণে পূর্ব বাংলায় জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী লুণ্ঠনের জন্য পাকিস্তান সরকারকে অভিযুক্ত করেন। জাতিসংঘ ভারতে আশ্রয় নেয়া বাঙালী শরণার্থীদের সাহায্যে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং জাতিসংঘ সৃষ্টির পর এটি ছিল সবচেয়ে বড় মানবিক সাহায্য। মেজর জলিল বরিশাল পুনরায় মুক্ত করার উদ্দেশ্যে নূরুল ইসলাম মঞ্জুর ও লে. নাসেরকে সঙ্গে নিয়ে দুটি লঞ্চে ৪০ জন যোদ্ধা ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রসহ ভারতের শমশেরনগর থেকে বাংলাদেশের দিকে যাত্রা করেন। কপোতাক্ষ নদীর তীরে গাবুরা নামক চরের কাছে লঞ্চ দুটি পৌঁছলে পাকিস্তানী সৈন্যরা গানবোট দিয়ে আক্রমণ করে। এই আকস্মিক আক্রমণে এমপি মহিউদ্দিন ও এ্যাডভোকেট সর্দার জালালসহ ২৬ জন যোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে বন্দী হন এবং অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদসহ লঞ্চ দুটি ধ্বংস হয়। এ দিন চট্টগ্রামের রামগড় সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ ঘটে। মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থক পিরোজপুরের এসপিও আবদুর রাজ্জাক, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমান ও এসডিপিও ফয়জুর রহমানকে দালালদের সহযোগিতায় পাকসেনারা গ্রেফতার করে। বিরিশিরি ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক ঝাঁক পাকসেনা নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী দুর্গাপুরের গাঁওকান্দিয়া গ্রামের সাধারণ মানুষসহ ১৯ গ্রামবাসীকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে গুলি করে ও পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া সুসং ডিগ্রী কলেজের ছাত্র দিলদার হোসেন, কৃষক ইমাম হোসেন, বিল্লাল হোসেনসহ নাম না জানা অনেককেই হত্যা করা হয়েছিল। সিলেটের ননিয়া নামক এলাকায় পাক বর্বরদের পৈশাচিক নির্যাতনে ২৬ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান জেনেভায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ভারতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য ভারত সরকার জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার কারণে দেশত্যাগীদের নিয়ে ভারতে যে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তা মানবিক। ভারতের রাজ্যগুলোতে অসংখ্য উদ্বাস্তু মানবেতর জীবনযাপন করছে। আমরা এর স্থায়ী সমাধান প্রত্যাশী। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হোক- যাতে নতুন করে শরণার্থী ভারতে না আসে এবং দেশত্যাগীরা স্বদেশে ফিরে যায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ কমন্সসভায় বলেন, ব্রিটিশ সরকারের ধারণা ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের আশ্রয় প্রার্থীদের সমস্যা ক্রমে দুরূহ হয়ে পড়ছে। আশ্রয়-প্রার্থীদের সংখ্যা প্রতিদিন ২০ হাজার করে বাড়ছে। আমি মনে করি, ঢাকার বর্তমান পরিস্থিতি দেখার জন্য সেখানে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পাঠানো প্রয়োজন। এদিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিযুক্ত সাবেক রাষ্ট্রদূত চেস্টার বোলস বলেন, কার বিরুদ্ধে এবং কি কারণে আমাদের দেয়া অস্ত্র ব্যবহার করা হবে তা না জেনে বন্ধুভাবাপন্ন সরকারগুলোকে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া নির্বুদ্ধিতা। আমার মনে হয়, অবিলম্বে দুটি ব্যবস্থা নেয়া দরকার, এক. মার্কিন সামরিক সরঞ্জাম অপব্যবহারের জন্য আমাদের উচিত পাকিস্তান সরকারকে কড়া প্রতিবাদ জানানো এবং সাহায্য দান অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া। দুই. আমাদের উচিত নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে এশিয়ার শান্তি ক্ষুণ্ণ হবার বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া। এটা খুবই স্পষ্ট এশিয়ার শান্তি ক্ষুণœ হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই সেখানকার ‘ঘরোয়া বিষয়’ নয়। একটি সশস্ত্র সংখ্যালঘু কর্তৃক বিশাল সংখ্যাগুরুকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টায় যে ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা’ সৃষ্টি হয়েছে তা মীমাংসার জন্য জাতিসংঘের একটি বিশেষ ধরনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ঢাকার ধামরাই থানার স্বাধীনতাবিরোধীরা মোজাম্মেল হককে সভাপতি এবং শমসের আলীকে সেক্রেটারি করে ১০৮ সদস্যবিশিষ্ট শান্তি কমিটি গঠন করে। প্যান মালয়েশিয়া ইসলামিক পার্টি জাতিসংঘ সেক্রেটারি উ থান্টের কাছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের নিন্দা করে স্মারকলিপি পেশ করেন। পাক হানাদার বাহিনী বলেশ্বর খেয়াঘাটে দাঁড় করিয়ে এক সঙ্গে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে তাদের লাশ ফেলে দেয় বলেশ্বর নদীতে। বলেশ্বর নদীর পাড়ে পুরনো খেয়াঘাট ও তার আশপাশের ঘাট ছিল হত্যাযজ্ঞের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। এদিন দৈনিক যুগান্তর, ‘নোয়াখালী ও কুমিল্লায় গুরুত্বপূর্ণ সড়ককেন্দ্র মুক্তিফৌজের দখলে’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রচ- সংঘর্ষের পর মুক্তিফৌজ নোয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সংযোগস্থল ছাগলনাইয়া অধিকার করেছেন, বাহাদুরাবাদ ঘাট ও চিলমারী ঘাটের কয়েকটি জলযান দখল করে সরিয়ে নিয়ে গেছেন, পাকবাহিনীর বহু অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে তাদের অনেককে হতাহত করেছেন। ছাগলনাইয়ার যুদ্ধে শ’তিনেক এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের ওপর মীরবাজারের যুদ্ধে শ’দেড়েক পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে। এদিকে যুগান্তরের জলপাইগুড়ির সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সীমান্ত পেরিয়ে সেখানে খবর পৌঁছেছে যে, লালমনিরহাটের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর মেজর এজাজ খানকে মুক্তিফৌজের গেরিলারা মেরে ফেলেছেন। মেজর এজাজ ছিলেন পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল রিয়াজ খানের ছোট ভাই। বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম রণাঙ্গনে লালমনিরহাটের কাছে দলহাটিতে মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। উগান্ডা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্র দি পিপলের একটি প্রবন্ধে লেখক নাথান এপেনু প্রশ্ন করেছেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দ্বারা বাংলাদেশে সংগঠিত নির্বিচার গণহত্যা নিয়ে বড় বড় রাষ্ট্রগুলো কেন চুপ এবং নিরাসক্ত?’ যদিও ইউ এস সিনেটর ফুলব্রাইটের মতো কিছু প্রতিবাদী কণ্ঠের খবর পাওয়া যায় তথাপি যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশে ঘটা গণহত্যা, নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম বিবাদ নিয়ে সামগ্রিকভাবে পরিপূর্ণ কোন অবস্থান এবং প্রচারণা এখনও দেখা যায়নি। পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ নিয়ে বড় শক্তিগুলোর এই সম্মিলিত নিরাসক্তির মূলে রয়েছে হয় পাকিস্তান এবং স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশের মানুষ এবং দেশগুলোর নিজ নিজ স্বার্থের মধ্যে আপাত অমিল অথবা বড় বড় শক্তিগুলো এই ইস্যুতে সম্পূর্ণভাবে পরস্পরবিরোধী। তাই একটা ভয় কাজ করে যদি কেউ একজন এই যুদ্ধে কোন একপক্ষকে সমর্থন দেয় তাহলে অন্যরা অপর পক্ষকে সমর্থন করবে এবং এটা বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। অবশ্যই সারা বিশ্বে যাতে এই বিরোধ ছড়িয়ে না পরে সেই চেষ্টাটা মহৎ, কিন্তু আমরা যা চাই তা হল বড় বড় শক্তিগুলো এই গৃহযুদ্ধে কোন পক্ষকে সমর্থন করার বদলে সম্মিলিতভাবে শক্তিশালী পক্ষকে চাপ প্রয়োগ করে একটা সমাধানের চেষ্টা করুক। ভারতের অমৃতবাজার পত্রিকার এক রিপোর্টে বলা হয়, রেলওয়ে মজদুর ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানান। কাউন্সিল ‘নির্দোষ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দ্বারা সেখানে গণহত্যার গভীরতা অনুভব করেন। সম্মেলনে প্রায় ২০০ প্রতিনিধি এবং অন্য সব প্রস্তাবের প্রতিনিধিত্বকারী ১৯টি শাখার প্রতিনিধিত্বকারী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, বাংলাদেশীরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছিল এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য যুদ্ধ করছিল। ভারত ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন দেশ তাদের নৈতিক সমর্থন প্রকাশ করেনি। রেজুলেশনে যোগ করা হয়েছে যে, যারা সেখানে সামরিক নিষ্ঠুরতা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল এবং তারা সীমানা অতিক্রম করে শুধু ভারতবর্ষে এসেছিল ভারত একা তাদের খাদ্য, বস্ত্র এবং আশ্রয়ের জন্য তাদের সম্পদ থেকে তাদের দিচ্ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ, রেডক্রস পুনর্বাসন সংস্থা, শরণার্থী সংস্থা কিছু বড় শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল- বলা হয় যে ‘বাংলাদেশের সংগ্রাম এখনও লকারে আছে’। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×