ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কর্নেল মোঃ মামুন অর রশিদ চৌধুরী

গোমার জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি...

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ৫ মে ২০১৯

গোমার জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি...

তৃতীয়বারের মতো জাতিসংঘ মিশনে এসেছি। এবার ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো (ডিআরসি) এর ফোর্স সদর দফতরের স্টাফ হিসেবে। ঢাকা থেকে এমিরেটসের ফ্লাইটে এন্টেবিতে এসেছি। এখন ইউএন ফ্লাইটে যেতে হবে গোমা-ডিআরসির পূর্বাঞ্চলীয় শহর। পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরদেশে এসে এয়ার পোর্টের এক কোণে জাতিসংঘ লাউঞ্জে বসে মন খারাপ করে ভাবছিলাম সামনে কি অপেক্ষা করছে। গোমার পরিস্থিতি খুব একটা ভাল না। কিছুদিন আগেই বিদ্রোহীরা গোমা শহর দখল করে নিয়েছিল। ‘গোমাগামী জাতিসংঘ যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ আফ্রিকান একসেন্টে এক মহিলার কঠোর আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলাম। এরপর গোমায় কেটে গেছে প্রায় ৬ মাস। এর মধ্যে দেশ থেকে ঘুরে এসেছি। মেজাজটা ফুরফুরে। হঠাৎ রোমানিয়ান এক কলিগ প্রস্তাব দিল ‘চল নাইরোগঙ্গো থেকে ঘুরে আসি, দুই দিনের প্যাকেজ। তাই তো, আগ্নেয়গিরির শহরে এসে আগ্নেয়গিরি না দেখে ফেরত যাব তা কি হয়। তাও আবার জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। পৃথিবীতে ৫টা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মধ্যে নাইরোগঙ্গো একটি। আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের জিওগ্রাফি আমরা সবাই জানি। মাটির গভীরে প্রচ- উচ্চচাপের কারণে এর অভ্যন্তরে তরল অবস্থায় রক্ষিত উত্তপ্ত ম্যাগমা বা লাভা মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। ভূ-পৃষ্ঠের যে কোন স্থানে যখনই কোন ফাঁক পায়, তখনই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে থাকে সেই উত্তপ্ত ম্যাগমা। ম্যাগমা বেরিয়ে আসার জিওগ্রাফিই আগ্নেয়গিরি। গোমার নিকটস্থ আগ্নেয়গিরিটিকে সুপ্ত না বলে পুরো জীবন্ত বলাই যথার্থ। গোমা পূর্ব ডিআর কঙ্গোর একটি বর্ধিষ্ণু শহর। পূর্ব ডিআরসির পুরো সীমান্তজুড়ে রয়েছে ছোট বড় লম্বাকৃতির সব লেক। তেমনি একটি লেক কিভু। কিভু লেকের পাশেই গোমা শহর। যেখান থেকে প্রায় ১৮/২০ কিমি. দূরে ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক। আর এখানেই রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত সেই নাইরোগঙ্গো আগ্নেয়গিরি। এই আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ব্যাসার্ধ প্রায় ১.৫ কিমি.। আমি থাকি ফোর্স সদর দফতর থেকে প্রায় দেড় কিমি. দূরে গোমা হিলের কাছের একটি চমৎকার বাসায়। যেখানে আমার সঙ্গে আরও চারজন বাংলাদেশী অফিসার থাকে। আমরা সেই হাউসের নাম দিয়েছি বাংলা হাউস। প্রায় এক দশক যাবত বাংলাদেশী অফিসাররা একান্ত পরম্পরায় এখানে থাকার সুবাদে যে কোন কারোরই পরিচিত এই বাংলা হাউস। লাভার শহর গোমা। শেষ ২০০২ সালে যখন নাইরোগঙ্গোর অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল তখন গোমা শহরটি লাভায় ঢেকে গিয়েছিল। গোমায় বসবাসরত প্রায় ৪ লাখ মানুষকে পার্শ্ববর্তী রুয়ান্ডান শহর গিসানিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। গ্যাসে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ। গলিত লাভার প্রভাবে গোমার মাটির রং কালো। সেই লাভা এমনকি পার্শ্ববর্তী লেক কিভুর পানিকেও বিষাক্ত করেছিল। এখন পর্যন্ত লেক কিভুতে কোন রকম মাছ বা জলজ প্রাণী থাকে না ভয়াবহ মিথেনের আধিক্যের কারণে। এক. ফিরে আসি নাইরোগঙ্গো প্রসঙ্গে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে নাইরোগঙ্গোর উচ্চতা প্রায় ৩৫০০ মিটার। আমাদের বাসা থেকে বের হলেই বিশাল সেই পাহাড়টা এত কাছের মনে হয় যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। সন্ধ্যার আকাশে নাইরোগঙ্গোর দিকে তাকালে এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হয়। আকাশ যদি পরিষ্কার থাকে তবে তো কথায় নেই। জীবন্ত আগ্নেয়গিরির ফুটন্ত লাভা জ্বালামুখ পেরিয়ে এক সুবিশাল লাল আভা তৈরি করে যা ২০ কিমি. দূরে হলেও স্পষ্ট দেখা যায়। জ্বালামুখের পরিবর্তনশীল এই রং নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের মিথ। এই আগ্নেয়গিরি নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। একদল গবেষক ২৪/৭ ঘণ্টার জন্য নিয়োজিত রয়েছে এর পর্যবেক্ষণে। সপ্তাহে কমপক্ষে ১ দিন হেলিকপ্টারে সেই গবেষক দেখে আসে আগ্নেয়গিরির প্রাত্যহিক অবস্থা। সহসা অগ্ন্যুৎপাতের ইভাকুয়েশন প্লান নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রস্তুতি। জাতিসংঘের ফোর্স সদর দফতর এখানে হওয়ার সুবাদে-এর মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ। নাইরোগঙ্গো ভ্রমণের প্রস্তাবনা সত্যিই লোভনীয়। দুইভাবে নাইরোগঙ্গোতে যাওয়া যায়। এক হলো হেলিকপ্টারে গবেষক দলের সদস্য হয়ে আর অন্যটি হলো স্থানীয় ট্যুরিস্ট কোম্পানির সহায়তায়। ফোর্স সদর দফতরের স্টাফ হিসেবে হেলিকপ্টারের সুবিধা হয়ত নিতেই পারতাম। কিন্তু মনে হলো দেখি না ট্যুরিস্টদের আয়োজনটা। ৩০০ ডলার দিয়ে আমার রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখে আমরা রওনা দেব নাইরোগঙ্গো দর্শনে। কিছুটা ভয় কিছুটা উত্তেজনা। সঙ্গে যোগ দিয়েছে রোমানিয়ান এক মেজর আর বাংলাদেশী আরও দুই সহযোদ্ধা। নির্দিষ্ট দিনে ট্যুর কোম্পানির গাড়ি আমাদের বাসা থেকে বেজ ক্যাম্পে নিয়ে গেল। বেজ ক্যাম্পে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল এক স্প্যানিশ আর দুইজন অস্ট্রেলীয় তরুণী। টান টান উত্তেজনায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। হাইকিং পয়েন্ট থেকে প্রায় ৮ কিমি. হেঁটে নাইরোগঙ্গো ক্যাম্পে পৌঁছাতে হবে। আমাদের সবার সঙ্গে রয়েছে ছোট ছোট ব্যাগ প্যাক। হাইকিং শুরু হতেই আমাদের সামনে পেছনে যোগ দিল একে ৪৭ ধারী কয়েকজন বেজার। বেশ কয়েকদিন আগে এখানে একদল ট্যুরিস্টকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৩ কিমি. লাভাযুক্ত পথ পাড়ি দিতেই চারদিকে আঁধার ঘনিয়ে এলো। সেই সঙ্গে শুরু হলো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। তবু গাইড আমাদের নিয়ে এগিয়ে চলল। কঙ্গোর বৃষ্টির সঙ্গে আমরা যারা পরিচিত তারা জানি যে, এই বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। সুতরাং আমরাও হালকা ভিজে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু সহসা আমাদের অবাক করে দিয়ে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। সর্বাঙ্গে ভিজে যখন আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ঠিক সেই সময় মারিয়া না¤িœ অস্ট্রেলীয় তরুণী তার ভ্রমণপিপাসা থেকে পিছিয়ে শহরে ফেরার জন্য অনুরোধ করল। আর সমস্ত হিসাব-নিকাশ উপেক্ষা করে কঙ্গোর ভদ্র বৃষ্টি অভদ্রতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ধারাবাহিকতার সোপানে সমস্ত রাস্তা কাদা পিচ্ছিল করে দিল। সঙ্গের গাইড দু’জন চিন্তিতভাবে নিজেদের সঙ্গে সোহাইলি ভাষায় কথা বলছে। হয়ত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ফিরে যাবে কিনা। হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ, একটি নারীকণ্ঠের আর্তচিৎকার। কে যেন পা পিছলে পড়ল ভেজা আর শক্ত লাভার ওপরে, পিছলে নেমে গেল ৮/১০ ফুট। কাছে গিয়ে দেখি মারিয়া। কনুই এবং হাঁটুর নিচে গভীরভাবে কেটেছে, বৃষ্টিতে ভিজে হালকা গোলাপী রক্ত বয়ে যাচ্ছে কালো লাভার ওপর দিয়ে। এগিয়ে যাওয়ার কোন পথই আর খোলা থাকল না। ॥ দুই ॥ আমার নাইরোগঙ্গো দর্শন হয়নি। নাইরোগঙ্গো দর্শন হয়নি বললে ভুল হবে। প্রতিদিনই আমি দেখেছি নাইরোগঙ্গোর রূপ, বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। হয়ত কাছে থেকে দেখা হয়নি। আর কোনদিন গোমা ভ্রমণ হবে কিনা আমি জানি না। তবে গোমাবাসীর আতঙ্ক হয়ত থেকে যাবে চীরকাল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা আমার এক বছরের প্রতিবেশী হয়ে থাকা গোমাবাসীরা ভাল থাকুক আর নাইরোগঙ্গো থাকুক সুপ্ত অবস্থায় শিশুর মতো ঘুমিয়ে। লেখক : সেনা কর্মকর্তা, সেনাসদর, ঢাকা সেনানিবাস
×