ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জালিয়ানওয়ালাবাগ ॥ ব্রিটিশ নারকীয়তার এক শ’ বছর

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ৫ মে ২০১৯

জালিয়ানওয়ালাবাগ ॥ ব্রিটিশ নারকীয়তার এক শ’ বছর

ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম কুখ্যাত গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞ। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটানো হয়। ওই শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামে দেয়ালঘেরা এক উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলি চালিয়ে শত শত লোককে হত্যা করা হয়। গত ১৩ এপ্রিল ছিল সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের শতবার্ষিকী। জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই নারকীয় গণহত্যা এতই ভয়াবহ ছিল যে, উইন্সট্র চার্চিল পর্যন্ত একে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধুনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন এক ভয়ঙ্কর ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তবে চার্চিল সাফাই গেয়েছিলেন এই বলে যে, এটা একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। ডায়ার ছিলেন শয়তান-ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নয়। এই হত্যাযজ্ঞ ভারতের জাতীয় পরিস্থিতি বদলে দেয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কুৎসিত চেহারা উন্মোচিত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর নাইট। উপাধি ফিরিয়ে দেন। গান্ধী অসহযোগী আন্দোলনের পথে নামেন। ভগৎ সিং ও উধম সিং নিজ নিজ বিপ্লবের পথ বেছে নেন। উধম সিং এই নারকীয় হত্যার বদলা নেয়ার প্রতিজ্ঞা করেন। ২১ বছর অপেক্ষা করে থাকার পর তিনি ঘটনার সময় পাঞ্জাবের শাসনভার যার হাতে ছিল সেই লেফটেন্যান্ট গবর্নর মাইকেল ও ডায়ারকে হত্যা করেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে মহিলাদের এগিয়ে আসা শুরু হয়। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলের দিনটিতে কি ঘটেছিল? কেন সেটা ঘটল এবং পাঞ্জাবেই কেন ঘটল? গণহত্যাটিকে ব্যাহত একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হতে পারে। তবে এটা এমন এক সময় ঘটেছিল যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ ক্রমাগত দাঙ্গা বাধ ছিল। ১৯১৯ সালে পাঞ্জাব ছিল একটা বারুদের স্তূপ। হাজার হাজার সৈন্য রণাঙ্গন থেকে দেশে ফিরছিল। তাদের কোন কাজ ছিল না, রোজগার ছিল না। যে সব সৈন্য সাহসিকতার জন্য পদক পেয়েছিল তাদেরই শুধু জমি দেয়া হয়েছিল। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গিয়েছিল। তার ওপর ছিল কুখ্যাত রাওলাট আইন। দেশদ্রোহিতা নিষ্ঠুরভাবে নিশ্চিহ্ন করাই ছিল এই আইনের লক্ষ্য। সংবাদপত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি হয়েছিল। লোকজনকে বিনা হুঁশিয়ারিতে গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে আটক রাখা যেতে পারত। এই আইনে নিশ্চিত করা হয় যে, শান্তিকালীন সময়েও জরুরী অবস্থা বলবত থাকতে পারে। অমৃতসর ছিল রাওলাট আইনবিরোধী বিক্ষোভের অন্যতম কেন্দ্র। এই আইনের বিরুদ্ধ সভা-সমাবেশ ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয় এবং ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত গড়ে উঠতে থাকে। জালিয়ানওয়ালাবাগ ছিল প্রাচীর বেষ্টিত নগরীর কেন্দ্রস্থলে। গরু, মহিষ চড়ে বেড়ানোর এই বিরান জায়গাটি এসব প্রতিবাদসভার স্বাভাবিক স্থান হয়ে দাঁড়ায়। নিয়মিত বিরতিতে সেখানে সভা-সমাবেশ হয়েছিল। ডাঃ সত্যপাল (হিন্দু) ও ডাঃ সাইফুদ্দিন কিসলু (কাশ্মীরী মুসলমান) অমৃতসরে রাওলাট আইন বিরোধী বিক্ষোভের ধূর্ত প্রতীকে পরিণত হন। ১৯১৯ সালের ১০ এপ্রিল কিসলু ও সত্যপালকে গ্রেফতার করার ফলে নগরীতে সহিংসতার সূত্রপাত হয়। এদিন সকালে কিসলু ও সত্যপালকে ডিসির বাসভবনে ডেকে পাঠানো হয়। বলা হয়, তোমরা পাঞ্জাবের শান্তিভঙ্গের যথেষ্ট কারণ ঘটিয়েছ। অতএব, তোমাদের ধর্মশালায় পাঠানো হচ্ছে। ব্রিটিশরা এই গ্রেফতার গোপন রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। হরতাল ডাকা হয় এবং হাজার হাজার লোকসভা সমাবেশে জড়ো হতে শুরু করে। স্লোগান ওঠে হিন্দু-মুসলমান কি জয়। ডাঃ সত্যপাল কি জয়! ডাঃ কিসলু কি জয়! বিক্ষুব্ধ জনতা ডিসির বাসভবন অভিমুখে অগ্রসর হলে ব্রিটিশ সৈন্যরা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালায় এতে তিনজন আহত হয়। গুলিবর্ষণের ঘটনায় জনতা রুদ্ররোষে ফেটে পড়ে। একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে। জনতার আক্রোশ সাধারণ ব্রিটেনদের ওপরও গিয়ে পড়ে। উচ্ছৃঙ্খল লোকজনের হাতে পাঁচ শ্বেতাঙ্গ নিহত হয়। তারা কয়েকটি ব্যাংক ও সরকারী অফিসে আগুন লাগায়। নগরীর মিশন স্কুলগুলোর সুপারিনটেনডেন্ট মার্সেলা শেরউড নামের এক মহিলা সাইকেল চালিয়ে ছুটছিল একটি স্কুলকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য। জনতার মধ্যে স্লোগান ওঠে। ‘ইংরেজদের মারো। ক্রুব্ধ জনতার হামলায় শেরউড প্রাণ হারান। বিভিন্ন স্থানে ইংরেজদের পাল্টা হামলায় প্রায় ২০ জন ভারতীয়ও প্রাণ হারায়। তাদের শবযাত্রায় বিপুল লোক সমাগম হয়। ১১ এপ্রিল ডেপুটি কমিশনারের তরফ থেকে জানানো হয় যে, শব মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। কিন্তু জনতা সেই নিষেধাজ্ঞা মানতে অস্বীকৃতি জানায়। সেনা অফিসাররা নগরীতে বোমাবর্ষণের কথা ভাবছিলেন। খালসা কলেজের প্রিন্সিপাল গেরার্ড ওয়াথান তাদের বুঝিয়ে বেলা ২টা পর্যন্ত শব মিছিল চলতে দিতে রাজি করান এবং বোমা মারা থেকে তাদের নিবৃত্ত করেন। শব মিছিল শান্তিপূর্ণভাবে চলে। নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যায়। কিন্তু ব্রিটিশদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও আতঙ্ক কাজ করছিল। তারা এই বিক্ষোভের মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল। তাই আরও সৈন্য অমৃতসরে নিয়ে আসা হলো। ঐদিন সন্ধ্যায় ৪৫তম ব্রিগেডের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরইএইচ ডায়ার অমৃতসরে এসে কমান্ড গ্রহণ করেন। ১২ এপ্রিল অমৃতসরে মার্শাল ল’ ঘোষণা করা হয়। ডায়ারের নির্দেশে ১০ এপ্রিলের বিক্ষোভে নেতাদের বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়। সন্ধ্যায় সত্যগ্রহ স্বেচ্ছাসেবকদের এক সভা হিন্দু সভাস্থলে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পরদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে এক জনসভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৩ এপ্রিল সকালে ব্রিগেডিয়ার ডায়ার সৈন্যদের এক কুচকাওয়াজের আয়োজন করেন এবং সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু এই ঘোষণা কেবল নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় পাঠ করে শেখানো হয়। ঘোষণায় আরও বলা হয়েছিল যে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনকারীদের সামরিক আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে। পরদিন ছিল বৈশাখী উৎসব। এর পাশাপাশি নগরীতে আয়োজন করা হয়েছিল গবাদিপশু মেলা। পরিস্থিতি গুরুতর হওয়া সত্ত্বেও হাজার হাজার লোকের আগমন ঘটেছিল নগরীতে। জনসভা ডাকা হয়েছিল বিকেল ৪টায় ১২ বছরের কিশোর ব্রিজলালকে পাঠানো হয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগের জনসভার কথা জনগণকে জানিয়ে দেয়ার জন্য। এদিন বিকেলে প্রায় ২০ হাজার লোক জালিয়ানওয়ালাবাগে এসেছিল। কেউ কেউ জনসভা উপলক্ষেই এসেছিল। তবে অনেকেই স্রেফ ঘটনাচক্রেই সেখানে উপস্থিত ছিল। বিকেল চারটার দিকে ডায়ার এই জনসভার কথা জানতে পারেন। তিনি বলে ওঠেন এই ইঁদুরগুলোকে আমি গুলি করে মারব। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সৈন্যসামন্ত নিয়ে সভাস্থলে ছুটে যান। জালিয়ানওয়ালাবাগে পৌঁছে ডায়ার কোন রকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। সৈন্যরা গুলি শুরু করে এবং রাইফেলের গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে থাকে। লাশের পর লাশ পড়তে থাকে। যারা আহত হয়েছিল তারাও সেখানে পড়ে কাতরাতে থাকে। তাদের চিকিৎসা বা শুশ্রƒষা দেয়ারও কেউ ছিল না। স্বজনদের খোঁজে কেউ যাতে জালিয়ানওয়ালাবাগে না আসতে পারে তার জন্য ডায়ার কার্ফু দিয়ে রেখেছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই হত্যাযজ্ঞে কতজন লোক নিহত হয়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের হিসাবে যদিও নিহতের সংখ্যা ৩৭৯ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা হবে অনেক বেশি। এ হত্যাকা-ে ডায়ার ১৬৫০ জন সৈন্য নিয়োগ করেছিলেন। এরা ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে গুলি চালাতে থাকে। অর্থাৎ প্রতি সৈন্য ৩৩ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। ইতিহাসবিদ ও ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ গ্রন্থের লেখক কিম ওয়াগনার নিহতের সংখ্যা ৫শ’ থেকে ৬শ’ বলে উল্লেখ করেন। সাহায্য সংস্থা সেবা সমিতি ও ভারতীয় কংগ্রেস দ্বারে দ্বারে গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। সেবা সমিতির হিসাব মতে নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৫শ’। তবে কংগ্রেসের রিপোর্টে এই সংখ্যা ১০০০ বলে দাবি করা হয়। ঘটনার ৫ দিন পর খালসা কলেজের তদানীন্তন অধ্যক্ষ গেরার্ড ওয়াথেন এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০ হাজার লোক উপস্থিত ছিল এবং ১০৪২ জন মারা গিয়েছিল। ২০ এপ্রিল ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী লেফটেনেন্ট গবর্নরের সেক্রেটারি জেপি টম্পসন নিহতের সংখ্যা ৮শ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। প্রহসনের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মর্গে রাখা নিহতদের লাশ শনাক্ত করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওয়াথেন পাঞ্জাবের লে. গবর্নরের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছিলেন যে ডায়ার পলায়নপর মানুষগুলো খরগোসের মতো গুলি করে মেরে ছিল। তার হিসাবে আহতের সংখ্যা ছিল নিহতের তিনগুণ মানে প্রায় ২ হাজার। ইতিহাসবিদ ওয়াগনারের বইয়ে মণিরাম নামে এক ডেন্টাল সার্জনের দেয়া বিবরণ আছে যিনি তার ১৩ বছরের ছেলের লাশ খুঁজতে সেখানে গিয়েছিলেন। মণিরামের ভাষ্য : আমার ছেলে মদন মোহন তার খেলার সাথীদের সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই ওখানে যেত। ১৩ এপ্রিলও গিয়েছিল এবং তাকে বিয়োগান্ত পরিণতি ভোগ করতে হয়। আমি খুঁজতে খুঁজতে তার লাশ অন্যান্য লাশের সঙ্গে মিশে থাকা অবস্থায় পাই। ওর মাথায় গুলি লেগে করোটি ফেটে গিয়েছিল। সেখানে শত শত লাশ স্তূপ হয়েছিল। এভাবে আমার নির্দেশ বয়সের নির্দোষ শিশুটিকে হত্যা করেছিল তারা দাবি করে থাকে যে ন্যায়বিচার, আইন ও শৃঙ্খলার নামে তারা এ কাজ করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাযজ্ঞের ব্যাপারে তদন্ত হয়েছিল। হান্টার কমিশন তথ্যানুসন্ধান করে ডায়ারকে দোষী সাব্যস্ত করে এই বলে যে, তিনি বিচারবুদ্ধি প্রয়োগে ভুল করেছিলেন। ডায়ারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ তিনি বিনা হুঁশিয়ারিতে গুলি চালিয়েছিলেন এবং আহতদের চিকিৎসার সুযোগ দেননি। আর অপরাধের বিচারে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিলÑ এটুকুই যা। ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে অনেকের কাছে তিনি হিরো বনে গিয়েছিলেন। আশ্চর্য হতে হয় যখন দেখা যায় সে দি মর্নিং পোস্ট ডায়ারের সাহায্যার্থে চাঁদা সংগ্রহ অভিযান শুরু করে এবং প্রথম কয়েক দিনেই ১৫ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং সংগ্রহ করে। আরও আশ্চর্য হতে হয় এটা শুনে যে, বিখ্যাত ইংরেজ লেখক, সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক রুডইয়ার্ড কিপলিংও চাঁদা দিয়েছিলেন ওই তহবিলে। কয়েক বছর পর ডায়ার মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কিপলিং একটি ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন। তাতে ছোট একটা কথা লেখা ছিল ‘তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।’ জালিয়ানওয়ালাবাগের সেই জল্লাদ এভাবেই তার অপরাধের দায়মুক্তি লাভ করে। সূত্র : দি উইক
×