ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য, খননের উদ্যোগ

পুরনো ব্রহ্মপুত্র এখন মরাগাঙ, হেঁটেই পার হওয়া যায়

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ৪ মে ২০১৯

  পুরনো ব্রহ্মপুত্র এখন মরাগাঙ, হেঁটেই পার হওয়া যায়

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ খননের অভাবে ক্রমাগত পলি জমে এক সময়কার উত্তাল ব্রহ্মপুত্র নদ এখন মরা গাঙে পরিণত হয়েছে। শুকনো মৌসুমে ময়মনসিংহের পুরনো এই ব্রহ্মপুত্র এখন হেঁটেই পার হওয়া যাচ্ছে। নদের বুকে অনেক জায়গাজুড়ে চাষাবাদ হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের এমন মরণদশায় হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। এই সুযোগে একশ্রেণীর স্থানীয় বালুখেকো হামলে পড়েছে ব্রহ্মপুত্র নদে। ড্রেজার ও বুম মেশিন বসিয়ে ব্রহ্মপুত্রের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে নির্বিচারে বালু তুলে নিচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী বালুখেকো সিন্ডিকেট। ফলে ভাঙ্গনের ঝুঁকি বাড়ছে ব্রহ্মপুত্রপারের স্পর্শকাতর স্থাপনাসহ এর দুই পাড়ের। একই সঙ্গে চরদখলের মতোই চলছে ব্রহ্মপুত্র দখলের মহোৎসব। এসব নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর ও দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবে আশার কথা, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রহ্মপুত্র খননের উদ্যোগ নিয়েছেন। জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের টোক পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের ১৯০ কিলোমিটার খনন করা হবে। পরবর্তীতে দেওয়ানগঞ্জ থেকে যমুনা নদীর উৎসমুখ পর্যন্ত আরও ৩৭ কিলোমিটার খনন করা হবে। ময়মনসিংহ পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শিব্বির আহমদ লিটন ব্রহ্মপুত্র জবরদখল ও পরিবেশ দূষণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, বালু উত্তোলন বন্ধসহ ব্রহ্মপুত্র জবরদখলকারীদের উচ্ছেদে মানববন্ধন ও সমাবেশসহ স্থানীয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ জবরদখলকারীদের বিরুদ্ধেও শীঘ্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্থানীয় সূত্রের দাবি, এককালের উত্তাল ব্রহ্মপুত্র আজ যৌবনহারা, মরা খাল, শীর্ণ। এক সময় যে নদের প্রশস্ততা ছিল ১২/১৪ কিমি, আজ সেটি ভরাট হতে হতে স্থানভেদে ৫০/১০০ মিটারে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে কমেছে এর নাব্য, চঞ্চলতা। যে নদের উত্তাল ঢেউ ছাপিয়ে যেত দুকূল। সে আজ উত্তালহীন ভরা বর্ষাতেও। তার সেই তর্জন-গর্জন এখন আর শোনা যায় না। ব্রহ্মপুত্রের বুক চিড়ে চলে না কোন পালতোলা নৌকা কিংবা মালবোঝাই কোন জাহাজ, থামে না কোন বন্দরে, ঘাটে। চরদখলের মতোই চলছে ব্রহ্মপুত্র জবরদখল। পানিশূন্য ব্রহ্মপুত্রর যে পাশ জেগে উঠছে সেখানেই হামলে পড়ছে ভূমি আগ্রাসী চক্র। এসব কারণে আজ কেবলই এক মরা গাঙ ময়মনসিংহের পুরনো নদ ব্রহ্মপুত্র। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্প ॥ বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, গত বছরের ২ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেক-এর বৈঠকে ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্প’ পাস হয়েছে। প্রকল্পটি বর্তমানে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায়। ইতোমধ্যে প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। অনুমোদন পেলেই ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কার্যাদেশ দেয়া হবে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ছয় বছর মেয়াদী এই মেগা প্রকল্পটি আগামী ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ করার কথা। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৭৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআইডব্লিউটিএ এটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নদীতে নাব্য ফিরিয়ে এনে সারাবছর নৌ চলাচলের উপযোগী করা হবে। বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক রকিবুল ইসলাম তালুকদার জানান, প্রকল্পের আওতায় ১০০ মিটার প্রশস্ত ও ৩ মিটার গভীর খননের মাধ্যমে নৌপথটি ক্লাস-২ নেভিগেশনাল রুটে-দ্বিতীয় শ্রেণীর নৌপথে উন্নীত করা হবে। এতে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র সারাবছর নৌ চলাচলে সক্ষম হবে। প্রকল্পের ১ম পর্যায়ে ১৯০ কিলোমিটার খনন করা হবে। পরবর্তীতে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের পল্লীকান্ডির ৩৭ কিলোমিটার খনন করা হবে। ইতোমধ্যে এই অংশের ডিজাইনের কাজ চলছে। আগামী এক মাসের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র খননের কাজ দৃশ্যমান হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক। এজন্য জামালপুরে ড্রেজার বেজ গড়ে তোলার পাশাপাশি ময়মনসিংহেও একটি ড্রেজিং অফিস হচ্ছে। সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি এ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান খান। তিনি জানান, ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলন ব্রহ্মপুত্র নদ খননের ব্যাপারে দীর্ঘদিন যাবত দাবি জানিয়ে আসছিল। এটি বাস্তবায়িত হলে মৃতপ্রায় ব্রহ্মপুত্র প্রাণ ফিরে পাবে বলে জানান তিনি। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি ॥ প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াজেদ রচিত ‘বাংলাদেশের নদীমালা’ থেকে জানা যায়, তিব্বতের মানস সরোবরে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি। হিন্দুদের সৃষ্টি দেবতা ব্রহ্মার মানসপুত্ররূপে এর নাম হয়েছে ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্রের আগে নাম ছিল লৌহিত্য। মহাভারতেও ব্রহ্মপুত্রের নাম লৌহিত্য ছিল। লোহিত সরোবর থেকে নিঃসৃত বলেই এর নাম হয়েছে লৌহিত্য। এই লৌহিত্যের পরবর্তী নামই হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। এই নাম পরিবর্তনে আর্য ও প্রকৃতি পূজার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। ব্রহ্মপুত্র ছিল বিশালাকায়। এজন্যই সে ‘নদ’ রূপে কীর্তিত হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা দ্বিশত বার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ ‘ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকা’ এর আহমদ সাইফ রচিত ‘পানি সম্পদ’ থেকে জানা যায়, হিমালয়ের উত্থানের বহু পূর্বে ব্রহ্মপুত্র এ উপমহাদেশে প্রবহমান ছিল। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি সম্পর্কে দুটি মত প্রচলিত। ডাঃ গ্রিফিতের মতে ব্রহ্মপুত্র অসম পর্বতমালা মধ্যস্থিত ব্রহ্মকুন্ড বা লৌহিত্য সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তিনি সচক্ষে ব্রহ্মকু- দেখে এসেছিলেন। আরেকটি মত হচ্ছে, তিব্বতের মালভূমিতে অবস্থিত মানস সরোবরের নিকটবর্তী চেমাইয়াংডুং হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি। এছাড়া যতীন্দ্র মোহন রায়ের ‘ঢাকার ইতিহাস’ থেকে জানা যায়, ব্রহ্মা-পুরাণে আছে, কৈলাস শৈলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পিশঙ্গ নামক সুবৃহৎ পর্বতের পার্শ্বদেশে ‘লোহিত’ নামে এক হেমশৃঙ্গশৈল ছিল। এর পাদদেশের লোহিত সরোবর থেকে পুণ্যতোয়া ‘লৌহিত্যনদ’ উৎপত্তি। পৃথিবীর অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন ব্রহ্মপুত্র নদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম। এমনকি গঙ্গার চেয়েও প্রাচীন। ব্রহ্মপুত্রের সেকাল-একাল ॥ ময়মনসিংহের বিবরণে কেদারনাথ মজুমদার লিখেছেন, মুসলিম রাজত্বকালে কোন কোন স্থানে ব্রহ্মপুত্রের প্রশস্ততা ছিল ৮/১০ মাইল। ঐতিহাসিক মিনহাজ লিখেছেন, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গার তিনগুণ ছিল। আইন-ই-আকবরিতে আছে, শেরপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ১০ মাইল প্রশস্ত ছিল। সে সময় এই ১০ মাইল পাড়ি দেয়ার জন্য দশ কাহন কড়ি নির্দিষ্ট ছিল। সে কারণে শেরপুরের নাম হয় দশ কাহনিয়া শেরপুর। ময়মনসিংহের নিকট ব্রহ্মপুত্র বর্তমান শহর থেকে গৌরীপুর উপজেলার বোকাইনগর পর্যন্ত ১২ মাইল প্রশস্ত ছিল। শহরের চরপাড়া ও গাঙিনাপাড় এখন ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। অথচ নামে প্রমাণ করে এক সময় এখানে নদী ছিল। অব্যাহত পলি জমে ভরাট হয়ে অনেকস্থানে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল বালুচর। সেই সঙ্গে কমেছে এখন এর পানি প্রবাহ। বর্ষাকালে সামান্য পানিতে এটি দুকূল ছাপিয়ে যায়। কিন্তু শুকনো মৌসুমের আগেই এটি এখন নিস্তেজ ও শীর্ণ হয়ে পড়ে। ব্রহ্মপুত্রের অনেকস্থানে এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। সেই পালতোলা নৌকা আর উত্তাল ঢেউসহ মাঝিদের দৌড়ঝাঁপ এখন আর চোখে পড়ে না। ব্রহ্মপুত্র নদের কেওয়াটখালি রেলওয়ে ব্রিজ থেকে পাটগুদাম ব্রিজ, থানারঘাট, কাচারি খেয়াঘাট, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উদ্যান, পুলিশ লাইন খেয়াঘাট, জেলখানাঘাট ও খাকডহর পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটারজুড়ে জেগে ওঠা চরে বোরোসহ সবজির আবাদ হচ্ছে। এসব জায়গা দিয়ে শুকনো মৌসুমে হেঁটেই পারপার হচ্ছে স্থানীয়রা। জেগে ওঠা এসব চরে হামলে পড়ছে ভূমিখেকোর সিন্ডিকেট। ময়মনসিংহ নগর লাগোয় এসব পয়েন্টে বাঁশের বেড়া দিয়ে কিংবা চাপরাঘর তুলে জবরদখল করা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রহ্মপুত্রের দুইপাড়েই চলছে এই জবরদখলের প্রতিযোগিতা। একই সঙ্গে চলছে নির্বিচারে বালু উত্তোলন। ব্রহ্মপুত্র জবরদখল আর বালু উত্তোলনকারীরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী বলে প্রশাসনও কার্যকর কোন উচ্ছেদে নামতে পারেনি এখনও। ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসন ॥ ব্রহ্মপুত্রের আক্রমণ-আগ্রাসনের কারণে কতশত পরিবার যে নিঃস্ব হয়েছে, কতশত একর জমি, ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। একটি উদাহরণ থেকে এর রুদ্র মূর্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। ময়মনসিংহ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৮৭ সালের ১ মে। এজন্য প্রয়োজন পড়ে জেলা সদর দফতর প্রতিষ্ঠার। আহমদ তৌফিক চৌধুরীর ‘শহর ময়মনসিংহের ইতিকথা’ থেকে জানা যায়, ময়মনসিংহ জেলা সদর দফতর স্থাপন করা হয় বেগুনবাড়ির কোম্পানির কুঠিতে। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গনে একরাতে কোম্পানির কুঠি বিলীন হয়ে গেলে পরে সেটি স্থাপন করা হয় খাকডহরে। কিন্তু এখানেও এটি বিলীন হয়ে গেলে ১৭৯১ সালে সেহড়া মৌজায় জেলা সদর দফতর স্থানান্তর করা হয়। সর্বশেষ স্থাপন করা হয় বর্তমান অবস্থানে। অনেকে বর্তমান স্থানে জেলা সদর দফতর স্থাপনে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কেননা, তখনও এই স্থানটি ব্রহ্মপুত্রের আগ্রাসন থেকে নিরাপদ ছিল না। ময়মনসিংহের তৎকালীন ডেপুটি কালেক্টর মি. রটনও বর্তমান স্থানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়টি স্থাপন করে নিশ্চিন্ত হতে পারেননি। ইংরেজ রাজত্বের প্রারম্ভে যখন এই জেলা শহর প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এক পত্রে ব্রহ্মপুত্রের হেঁয়ালিপনায় ময়মনসিংহের তৎকালীন কালেক্টর মি. বেয়ার্ড মন্তব্য করতে গিয়ে লেখেন, ‘ব্রহ্মপুত্রের ন্যয় ভীষণ নদীর তীরে এ জেলার সদর দফতার স্থাপন আমি কোনমতেই সঙ্গত মনে করি না’। মি. বেয়ার্ডের এই আশঙ্কা সত্য না হলেও ব্রহ্মপুত্রের এই আগ্রাসন এখন আর নেই বললেই চলে। কেবলমাত্র ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলেই মাঝে মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সর্বশেষ ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গন থেকে শম্ভুগঞ্জ পাটকলকে রক্ষার জন্য জিয়া সরকার আমলে একটি বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়। পুরনো ব্রহ্মপুত্রের বালু হরিলুট ॥ ময়মনসিংহে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের বিভিন্ন পয়েন্টে ড্রেজার ও বুম মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলনে চলছে হরিলুট কারবার। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়সহ ভাঙ্গনের আশঙ্কা করছে পানি উন্নয়নের বোর্ডের প্রকৌশলীসহ পরিবেশ অধিদফতরের কমকর্তারা। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট ব্রহ্মপুত্র নদে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করছে। এর ভাগ যাচ্ছে নানা মহলে। এভাবে বালু উত্তোলন ও বেচাবিক্রির কারণে সরকার প্রতিবছর মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন কর্মকর্তাদের দাবি ভ্রাম্যমাণ আদালতের একাধিক অভিযানে ডেজার জব্দ করার পরও বন্ধ হচ্ছে না বালু উত্তোলন। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, এলাকাভিত্তিক কয়েকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ব্রহ্মপুত্র নদের বালু উত্তোলন ও বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। পাটগুদাম ব্রহ্মপুত্র ব্রিজ থেকে শুরু করে কালিবাড়ি খেয়াঘাট, থানারঘাট, কাচারি খেয়াঘাট, পুলিশ লাইন, জেলখানা খেয়াঘাট ও খাকডহরসহ ময়মনসিংহ সদরের অন্তত ১৫টি পয়েন্টে ড্রেজার ও বুম মেশিন বসিয়ে ব্রহ্মপুত্র থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব বালু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে স্তূপ করে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলনে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা পরিবেশ অধিদফতরের কোন অনুমোদন নেই। ফলে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট যেভাবে চাইছে সেভাবেই অপরিকল্পিতভাবে তুলে নিচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের বালু। স্থানীয়দের দাবি, প্রভাবশালী সিন্ডিকেট এভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রির মাধ্যমে বছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার বাণিজ্য করছে। এর ভাগ যাচ্ছে নানা মহলে। কালিবাড়ি খেয়াঘাটে লিটন মিয়া, মাহবুব আলম, ওলিউল্লাহ, সলিমুল্লাহ রসুল, আনু মোড়লের মালিকানাধীন ড্রেজার ও বেকু দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে। দৈনিক এই ঘাটে ৮০-১০০ ট্রাক বালু ও মাটি বেচাবিক্রি হচ্ছে। প্রতি ট্রাক বালু ও মাটি গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সূত্র। গত নবেম্বরে স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়ে কালিবাড়িঘাটের সব ড্রেজার ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। পরে এসব ড্রেজার মেরামতের পর সচল করে ফের বালু উত্তোলন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ লাইন ঘাটে তপন ও ভুট্টো, গলগ-া এলাকার ফারুক ও আউটার স্টেডিয়াম এলাকার মাহফুজ ড্রেজার ও বুম মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে তোলা বালু পুলিশ লাইন উত্তরা আবাসিক এলাকাসহ এর আশপাশে মজুদের পর তা বিক্রি করা হচ্ছে নানা জায়গায়। পুলিশ লাইন এলাকার স্থানীয় জিল্লুর রহমান ও আউটার স্টেডিয়াম এলাকার মাহফুজ পুলিশ লাইন ঘাটের প্রধান নিয়ন্ত্রক বলে জানায় স্থানীয়রা। পুলিশ লাইন ঘাট থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০ ট্রাক বালু বেচাবিক্রি হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের অনুমোদন না থাকায় এই ঘাট থেকে সরকার কোন রাজস্ব পাচ্ছে না। স্থানীয় সূত্রগুলোর দাবি, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার মেয়াদে এসব ঘাট ছিল বিএনপি নেতাদের দখলে। সরকার বদল হলে এসব ঘাট এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার শেখ হাফিজুর রহমান জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে কালিবাড়ি খেয়াঘাট ও খাকডহরসহ কয়েকটি স্পটে ড্রেজার জব্দ করা হয়েছে। বালু উত্তোলন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান চলবে বলেও জানান তিনি। ব্রহ্মপুত্র জবরদখলের চালচিত্র ॥ বেদখল হয়ে যাচ্ছে ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র। একশ্রেণীর প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসী চক্র জবরদখল করে নিচ্ছে ময়মনসিংহ শহর লাগোয়া ব্রহ্মপুত্র তীরের মূল্যবান জমি। আর তাতে গড়ে তুলছে স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা। নদে পানির প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় বহু স্থানে জেগে উঠেছে চর। ময়মনসিংহ শহর লাগোয়া অংশে এখন আর ব্রহ্মপুত্রের ভাঙ্গন নেই। বিপরীতে এর দুপারেই পড়েছে বালির চর। বিশেষ করে শহর লাগোয়া অংশের প্রায় ১৫ কিমি জুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল চর। শহরের খাকডহর থেকে শুরু করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শেষ মোড় পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের যে অংশ শহর লাগোয়া প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীদের লোলুপদৃষ্টি সেদিকেই। অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শহর লাগোয়া বলে আশির দশক থেকে শুরু হয় এই জবরদখলের প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে আগে থেকেই ব্রহ্মপুত্র নদ লাগোয়া যাদের আবাসিক বাসা ছিল তারা অতিদ্রুত তাদের বাসা পেছনের দিকে সম্প্রসারণ শুরু করে। শহরের কাচারি ফেরিঘাট, জুবলিঘাট, থানারঘাট, পুরনো ফেরিঘাট, পাটগুদাম র‌্যালিমোড়, ব্রিজমোড় ও বলাশপুর এলাকায় এই জবরদখল চলে রাতারাতি। শহরের থানারঘাট বালুচরে রাতারাতি গড়ে তোলে সহস্রাধিক বসতবাড়ি। এখানেই ভূমিহীনদের নামে জবরদখল হয়ে যায় প্রায় ৭০ একর জমি। এ নিয়ে চলমান মামলায় অবৈধ দখলদাররা হেরে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন এদের উচ্ছেদে কোন উদ্যোগ নেয়নি। প্রচার রয়েছে, এখানকার জবরদখলকারী কথিত ভূমিহীনদের পেছনে অনেক রাঘব বোয়াল কুশীলব জড়িত। পুরনো ফেরিঘাট থেকে পাটগুদাম ব্রিজমোড় পর্যন্ত এলাকায় রাতারাতি গড়ে তোলা হয় শত শত বসতবাড়ি। এসবের মধ্যে স্থায়ী স্থাপনাও রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এখানকার এক প্রভাবশালী একাই জবরদখল করেছেন এক শ’ কোটি টাকার জমি। পরে এসব জমির ভুয়া ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে তা নানাজনের কাছে চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে। শহরের এই এলাকায় রয়েছে শত শত অবৈধ দখলদার। ব্রহ্মপুত্র নদ জবরদখল করে তাতে ঘরবাড়ি তুলে এখানের অনেকেই ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। যে কোন সময় হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে আশঙ্কায় অনেকে এই মূল্যবান জমি একাধিকবার হাতবদল করেছে। পাটগুদাম ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের পশ্চিমপাশে বেড়িবাঁধের নিচে বাঁশের বেড়া দিয়ে এক প্রভাবশালী একাই জবরদখল করেছেন কয়েক একর জমি। ব্রিজের ওপারেও দেখা গেছে জবরদখলের এই চিত্র। শহরের কালিবাড়ি রোড এলাকায় এক প্রভাবশালী ব্রহ্মপুত্রের উপর শহর থেকে পড়া একটি বড় ড্রেন জবরদখল করে তাতে স্থায়ী বসতবাড়ি গড়ে তুলেছেন। এসবের অনেক কিছুই হয়েছে জাল ও ভুয়া দলিলের ওপর। জাল ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি চক্রের এ রকম একাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে কোতোয়ালি থানায় মামলাও রয়েছে। তারপরও ভূমিগ্রাসী চক্রের এই মূল হোতারা এখন বীরদর্পে শহরে ঘুরে বেড়ায়। এদের অন্যতম সদস্য জবেদ আলী মহুরির বাসা থেকে পুলিশ জাল দলিল তৈরির বহু আলামতও উদ্ধার করেছিল। সে সময় অবশ্য সে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়েছিল। শহরের বলাশপুর ও পাটগুদাম র‌্যালি মোড় এলাকাতেও এ রকম জবরদখলকারী জালিয়াতের সন্ধান রয়েছে প্রশাসনের কাছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রশাসন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছে না। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে একটি প্রতারকচক্র দুই দশক ধরে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদ এভাবে অবাধে বিক্রি করে আসছে। ফলে ব্রহ্মপুত্রের একটি বিরাট অংশ চলে যাচ্ছে প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসীর দখলে। এই জবরদখলের প্রতিযোগিতার কারণে ক্ষীণ হয়ে আসছে ব্রহ্মপুত্র। বিপন্ন হচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের পরিবেশ। জয়নুল আবেদিন ও ব্রহ্মপুত্র ॥ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনেক শিল্পকর্মের উৎস ছিল ব্রহ্মপুত্র। শিল্পাচার্যের শিল্পী জীবনের শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহের এই ব্রহ্মপুত্র পার থেকে। তার চিত্রকলার ভিত্তিও ছিল ব্রহ্মপুত্র। শহরের পাশ দিয়ে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্র নদ, নদের পানি, নদের মাঝি, চর, চরের মানুষ, চরের কাশফুল, জেলেদের নদীতে মাছ ধরা, জাল ফেলা, মাঝির গুনটানা-এসবের সঙ্গে চিরপরিচিত ছিলেন জয়নুল। তার শিল্পকর্মে তাই এসবের প্রতিফলন ঘটেছে দারুণ নিখুঁতভাবে। তিরিশের দশকে রোমান্টিক চোখে দেখা শিল্পাচার্যের ব্রহ্মপুত্র ও তীরবাসী মানুষের জীবনচিত্র, চল্লিশের দুর্ভিক্ষের চিত্রশালা, মায়ের বিশীর্ণ স্তনে অপুষ্ট শিশুর পুষ্টি সন্ধানের ব্যর্থ চেষ্টা, সাঁওতাল জীবনের ছবি, লোকশিল্পভিত্তিক কাজ, মেক্সিকোর পাহাড়ী প্রকৃতি মানুষের জীবনের স্কেচ, সাতচল্লিশের উদ্বাস্তু জনযাত্রাসহ নানা দুর্লভ ছবি দিয়ে শিল্পাচার্য ব্রহ্মপুত্র পারে গড়ে তোলেন জয়নুল সংগ্রহশালা। বিগত ১৯৭৫ সালের মধ্য এপ্রিলে বাংলা নববর্ষের দিনে এক উৎসবমুখর পরিবেশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন। ব্রহ্মপুত্র পারের নৈসর্গিক পরিবেশের এই সংগ্রহশালায় প্রতিদিন জয়নুলভক্ত শত শত অনুরাগী ভিড় করে এখন ।
×