ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অপরূপ কৃষ্ণচূড়া বদলে দিয়েছে শহরের ছবি

প্রকাশিত: ১০:৩০, ৪ মে ২০১৯

অপরূপ কৃষ্ণচূড়া  বদলে দিয়েছে শহরের ছবি

মোরসালিন মিজান ॥ শুক্রবারের বিকেল। বৃষ্টিতে ধোয়া ঢাকা। গাড়ির জানালায় চোখ রাখতেই মন, সত্যি বলছি, নেচে উঠল। রাস্তার ধারে আশ্চর্য সুন্দর কৃষ্ণচূড়া ফুটে আছে। গত কয়েকদিন ধরেই ফুলটির পানে দৃষ্টি। এর পরও যেন প্রথম দেখার অনুভূতি হয়! চোখ সরাতে মন চায় না। গাড়ির গ্লাস নামাতেই বোঝা গেল, কয়েক দফা বৃষ্টি কৃষ্ণচূড়ার লাল আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিজয় সরণি থেকে তেজগাঁও পৌঁছে দেয় যে ব্রিজটি, তার ওপর থেকে ঠিক গাছটি দেখা গেল না। শুধু কৃষ্ণচূড়া। ঘন হয়ে ফোটা ফুল। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। সে কী দৃশ্য! তেজগাঁও থেকে মগবাজার আসতে আসতে আরও অন্তত ১৫ গাছ চোখে পড়ল। প্রত্যেকটিতে ফুল। দেখতেই দেখতেই স্বীকার করে নিতে হয়, এ শহর কৃষ্ণচূড়ার! কবি শামসুর রাহমানের কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেল, যেখানে মুগ্ধ নাগরিক কবি লিখেছেন : আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে...। লাল রঙের পাপড়িতে বাঙালীর চেতনার রং দেখেছিলেন শামসুর রাহমান। আপনিও দেখুন। কৃষ্ণচূড়া দেখার এখন সময়। একপলক দেখার চেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বের হয়ে পড়তে পারেন। যে কোন ছুটির দিনে বের হয়ে পড়ুন। যোগ দিন কৃষ্ণচূড়া উৎসবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, গ্রীষ্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফুলটির নাম কৃষ্ণচূড়া। এবারও বৈশাখের শুরুতেই ফুল ফুটেছিল। ক্রমে গাঢ় লাল হয়েছে। বর্তমানে রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ সড়কের দুই ধারে, পার্কে-উদ্যানে, পুরনো ভবনের কার্নিশে কৃষ্ণচূড়া দৃশ্যমান। লাল রঙে দারুণ সেজেছে প্রকৃতি। ঢাকার ছবিটাই বদলে দিয়েছে। বদলে যাওয়া ছবি যে কোন জায়গা থেকে দেখা যায়। তবে আলাদা করে বলতে হয় চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশের রাস্তাটির কথা। এ রাস্তার দুই ধারে কৃষ্ণচূড়ার সারি। যত পথ তত কৃষ্ণচূড়া। দেখে শেষ করা যায় না। সড়কটি অতিক্রম করার সময় প্রকৃতিপ্রেমীরা অপলক চোখে তাকিয়ে থাকেন। গত বুধবার বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, শুধু কৃষ্ণচূড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য বহু মানুষ এসেছেন। অপেক্ষাকৃত নিচু গাছের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলেন তারা। কৃষ্ণচূড়ার সবটুকু সৌন্দর্য ক্যামেরাবন্দী করতেই নিচু গাছ বেছে নেয়া বলে জানা যায়। শৌখিন ফটোগ্রাফাররাও আসছেন। ছবি তুলছেন। তেমনই একজনের নাম আসাদ। বিপুল প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলেন তিনি। কতভাবে যে ফুলের ছবি তুলছিলেন! এর পরও কিছুটা হতাশ। বললেন, লেটেস্ট মডেলের ক্যামেরা, ল্যান্স ইত্যাদি নিয়ে এসেছি। সহকর্মীরা ছবি দেখে খুশি। কিন্তু আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। কৃষ্ণচূড়া ফুলের দিকে খালি চোখে তাকিয়ে আফসোস হচ্ছে শুধু। আসলে ক্যামেরায় এ সৌন্দর্যের সামান্যই ধারণ করা সম্ভব। এ জন্য সবাইকে নিজ চোখে ফুলটি দেখার আমন্ত্রণ জানান তিনি। চন্দ্রিমা উদ্যানেও আছে কৃষ্ণচূড়া। আছে মানে, ঢের আছে। বাইরে থেকে দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের দুই পাশের গাছগুলো দেখতে হয় না। আপনি চলে যায় চোখ। কৃষ্ণচূড়া দেখা যেতে পারেন রমনা পার্কেও। বিশাল উদ্যানে সবুজের সমারোহ। লাল ফুলটি তাই আলাদা করে চোখে পড়ে। এখানে প্রচুর গাছ। পার্কের যে গেট দিয়েই প্রবেশ করা যায়, স্বাগত জানায় কৃষ্ণচূড়া। ভেতরেও এর উপস্থিতি প্রবল। নিসর্গপ্রেমীরা তো বটেই, প্রাতঃভ্রমণে আসা সাধারণ মানুষও কৃষ্ণচূড়ার দিকে তাকিয়ে পথ হাঁটছেন। এই পথ যদি না শেষ হয়...। শেষ না হলেই যেন খুশি সবাই! এবার ফুলটির পরিচিতি তুলে ধরা যাক। কৃষ্ণচূড়ার বৈজ্ঞানিক নাম ডেলোনিক্স রেজিয়া। এটি ফাবাসিয়ি পরিবারের অন্তর্গত। গুলমোহর নামেও ডাকা হয়। আদি নিবাস আফ্রিকার মাদাগাস্কার। ১৮২৪ সালে সেখান থেকে প্রথম মুরিটাস, পরে ইংল্যান্ড এবং শেষ অবদি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তার ঘটে। এখন জন্মে আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, হংকং, তাইওয়ান, দক্ষিণ চীন, ভারতসহ বিশ্বের বহু দেশে। ধারণা করা হয়, কৃষ্ণচূড়া ভারত উপমহাদেশে এসেছে তিন থেকে চার শ’ বছর আগে। বহুকাল ধরে আছে বাংলাদেশে। তবে ফুলের নাম কী করে কৃষ্ণচূড়া হলো সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। ধারণা করা হয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অবতার কৃষ্ণের নামে ফুলটির নামকরণ করা হয়েছে। একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে, কৃষ্ণের মাথায় চুলের চূড়া বাঁধার ধরনটির সঙ্গে ফুলটির বেশ মিল। সেখান থেকেই কৃষ্ণচূড়া। আবার উদ্ভিদবিজ্ঞানী, নিসর্গপ্রেমী কিংবা কবি সাহিত্যিকরাও নামকরণ করে থাকতে পারেন। উদ্ভিদবিদ দ্বিজেন শর্মার গবেষণা থেকে জানা যায়, এই ফুল বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ফুটে থাকে। বাংলাদেশে ফোটে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত। প্রথম মুকুল ধরার কিছু দিনের মধ্যেই পুরো গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। ফুলের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর উজ্জ্বল রং। তরুরাজ্যে এত উজ্জ্বল রং সত্যি দুর্লভ। ফুলের পাপড়ির রং গাঢ় লাল, লাল, কমলা, হলুদ, হালকা হলুদ হয়ে থাকে। প্রস্ফুটিত ফুলের ব্যাস ২ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি। বৃত্তির বহিরাংশ সবুজ। ভেতরের অংশ রক্তিম। কৃষ্ণচূড়ার ফুলগুলো বড় চারটি পাপড়িযুক্ত। পাপড়ি প্রায় ৮ সেন্টিমিটারের মতো লম্বা হয়ে থাকে। কৃষ্ণচূড়া জটিল পত্রবিশিষ্ট। প্রতিটি পাতা ৩০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার লম্বা। ২০ থেকে ৪০ উপপত্র বিশিষ্ট। অবশ্য এসব তথ্য নিসর্গবিদরাই খোঁজেন বেশি। ফুলপ্রেমীরা কৃষ্ণচূড়ার লালে হারিয়ে যেতে ভালবাসেন। হারিয়ে যান। হারিয়ে যাওয়ার কী যে আনন্দ, মাত্র কিছুদিন সুযোগ পাবেন, উপভোগ করুন।
×