ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সম্পদ রক্ষায় আইওয়াশ

আত্মসমর্পণ ও ইয়াবার চালান সমানে চলছে

প্রকাশিত: ১০:১৭, ৪ মে ২০১৯

 আত্মসমর্পণ ও ইয়াবার চালান সমানে  চলছে

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ কয়লা ধুলে ময়লা যায় না...। একদিকে আত্মসমর্পণ, অন্যদিকে ইয়াবার চালান গচ্ছিত! এ রহস্যময় বিষয়টিকে ঘিরে কক্সবাজারে অভিজ্ঞ মহলে এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মধ্যেও বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা চলছে। কারাগারে থাকলেও ইয়াবা সম্রাটদের এখন সুদিন যাচ্ছে। আত্মসমর্পণ করে জেল হাজতে, অথচ তারই ঘরে ইয়াবার বড় চালান জব্দ, বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সচেতন মহলকে। সূত্র জানায়, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ১০২ ইয়াবাকারবারি আত্মসমর্পণ করেছে পুলিশের হাতে। ঢাকঢোল পিটিয়ে তারা ইয়াবা কারবার থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে বলে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে আত্মসমর্পণকৃত ১০২ জনের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তির স্বজনরা ঠিকই ইয়াবা কারবার চালিয়ে নিচ্ছে বর্তমানে। কেউ সরাসরি আবার কেউ বহনকারীর মাধ্যমে চালান পাঠাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। মাঝে মাঝে কিছু কিছু চালান জব্দও হচ্ছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। আত্মসমর্পণকৃত ইয়াবা কারবারি তাহেরের বাড়ি থেকে ৬০ হাজার পিস ইয়াবার চালান জব্দ হলেও তার কিছুই যায় আসে না। যেহেতু কক্সবাজার ও হ্নীলায় আবু তাহেরের একাধিক সুরম্য অট্টালিকা রয়েছে। ওইসব সম্পদ রক্ষার্থে তাহের গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। ইয়াবার টাকার জোরে কারাগারে তারা ভিআইপি মর্যাদায় অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। সচেতন মহল মনে করেন, আত্মসমর্পণের ঘটনা পুলিশের বিরুদ্ধে চোরাচালানিদের আইওয়াশ করেছে মাত্র। তা নাহলে হাজতে থাকা অবস্থায় আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা কারবারি তাহেরের বাড়ি থেকে ৬০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ হয় কিভাবে? আত্মসমর্পণকারী আবু তাহেরসহ অধিকাংশ তালিকাভুক্ত মাদককারবারির সিন্ডিকেট এখনও ইয়াবা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। আত্মসমর্পণকারীরা যাতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়, এ জন্য তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছে। তবে বন্ধ করেনি ইয়াবার কারবার। আত্মসমর্পণকারীদের স্বজনরা ইয়াবা কারবার চালাচ্ছে বহনকারীর মাধ্যমে। ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণকারী আবু তাহেরের ভাই সিন্ডিকেটের সদস্য জালাল আহমদের পুত্র হাসান মুরাদ, পূর্ব লেদার পারভেজ ও কাইসার, তালিকাভুক্ত মাদককারবারি হ্নীলা রঙ্গিখালী লামার পাড়ার সরওয়ার কামাল ওরফে সরওয়ার শাহীন, আবছার ও হেলাল সিন্ডিকেট এখনও হ্নীলা বাসস্টেশনে একটি শো-রুমের পণ্যবোঝাই গাড়িতে করে এসব মাদকের চালান সরবরাহ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্র-ছায়ায় উক্ত এলাকার বেশ কয়েকটি চক্র এখনও মাদকের চালান নিয়ে আসছে মিয়ানমার থেকে। সচেতন মহল মনে করেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে দেখে রাঘববোয়ালরা আত্মসমর্পণের নামে সরকারের অভিযানকে শিথিল করতে এ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক মেজর মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে একটি চৌকস আভিযানিক দল আত্মসমর্পণকারী ইয়াবাকারবারি টেকনাফ পূর্ব লেদার জালাল আহমদের পুত্র আবু তাহেরের কক্সবাজার উত্তর তারাবনিয়ার ছড়া বি-ব্লকের ২৬নং বাড়িতে অভিযান চালায়। ওইসময় ৫৬ হাজার টাকা এবং লকারের ভেতরের বিশেষ কায়দায় লুকানো ৬০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করা মাদককারবারি আবু তাহেরের বড় ভাই আবু বক্কর ছিদ্দিক, হোয়াইক্যংয়ের মহেশখালীয়া পাড়ার নুর আহমদের পুত্র সেলিম উদ্দিন ও কক্সবাজার পাহাড়তলীর কাদির বশরের পুত্র মোহাম্মদ আয়াছকে আটক করা হয়েছে। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা সম্রাট সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আলম, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মৌলবি রফিক উদ্দিন ও তার সহোদর ইউপি চেয়ারম্যান মৌলবি আজিজ উদ্দিন ও ইয়াবা জগতের শীর্ষ গডফাদার সাইফুল করিমসহ অনেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। ওইসব ইয়াবা সম্রাট ও হুন্ডি ব্যবসায়ী ধরা না পড়ায় এখনও ইয়াবার শেকড় উৎপাটন করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। কক্সবাজারের পুলিশ ইতোমধ্যে একজন সাংবাদিকসহ ২২ হুন্ডি ব্যবসায়ীর তালিকা তৈরি করেছে। তারা হলেন- টেকনাফের মধ্যম জালিয়াপাড়ার জাফর আলম ওরফে টিটি জাফর, নামার বাজারের বদি আলম, সাতকানিয়ার বাসিন্দা ও টেকনাফের কাপড় দোকানি মোঃ উসমান, নামার বাজারের মোঃ ইসমাইল, পাল্লান পাড়ার মোঃ ফারুক, সৈয়দ করিম, গোদারবিলের টিক্কা কাদের, মধ্যম জালিয়াপাড়ার মোঃ ইসহাক, মোঃ ইয়াসিন, মোঃ ওসমান, মোঃ তাহের, আবুল আলী (সাংবাদিক), টিটি জাফরের ভাই কালা মিয়া ওরফে ল্যাংগা কালা, ল্যাংগা কালার পুত্র মোঃ সাইফুল, দক্ষিণ জালিয়াপাড়ার মোঃ খুরশিদ, ডেইলপাড়ার মোঃ আমিন, শীলবুনিয়াপাড়ার মোঃ শফিক, কুলালপাড়ার মোঃ শওকত, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রশিদ ওরফে ভেক্কু, মোঃ সাইফুল ও কেকেপাড়ার মোঃ আইয়ুব ওরফে বাট্টা আইয়ুব। এদিকে উখিয়ার মাহমুদুল হক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লাখ লাখ পিস ইয়াবা সরবরাহ করে কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়েছে। দোছড়ি গ্রামের মাহমুদুল হক রামু গোয়ালিয়ার মোস্তাক আহমদ ওরফে ইয়াবা মোস্তাকের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও সরবরাহ করে আসছে ইয়াবার চালান। উখিয়া আদালত ভবন সংলগ্ন কোটি টাকা মূল্যে নির্মাণকৃত বাড়িতে মাঝে মাঝে ইয়াবা সিন্ডিকেটের গোপন বৈঠক হয় বলে জানা গেছে। সূত্র আরও জানায়, অবৈধ ইয়াবাকারবারিদের জন্য গত কয়েক বছর ধরে বৈধ ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানে পুরস্কারের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। একাধিকবার সেরা করদাতার পুরস্কার পেয়েছেন দেশের শীর্ষ ইয়াবা ডন হাজী সাইফুল করিম। পরপর তিনবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সেরা করদাতা পাওয়ার জন্য সেরা করদাতা মনোনীত হয়েছিলেন দেশ সেরা এই ইয়াবাকারবারি সাইফুল করিম। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা আনার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী এই সাইফুল করিম ও তার পরিবার। শুধু সাইফুল করিম নয়, তার আরেক ভাই মাহাবুবুল করিমও তালিকাভুক্ত ইয়াবাকারবারি। সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছে সাইফুল করিমের বড় ভাই রেজাউল করিম মুন্না। বলতে গেলে সাইফুল করিমের পরিবারই দেশে ইয়াবা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
×