ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সেতু রেললাইন সম্প্রসারণ ॥ ভূমি অধিগ্রহণে টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা

রাতারাতি গড়ে উঠছে স্থাপনা

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ৪ মে ২০১৯

 রাতারাতি গড়ে উঠছে স্থাপনা

সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর ॥ পদ্মা সেতুর সঙ্গেই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বহুল প্রত্যাশিত রেললাইন নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা-ভাঙ্গা-যশোর রেলসংযোগ নির্মাণের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে কর্মতৎপরতায় মুখর হয়ে উঠেছে সেতুর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল। এরই মধ্যে আগাম তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ায় রেললাইন সম্প্রসারণের খবরে ভূমি অধিগ্রহণের সম্ভাবনায় প্রকল্পের মাদারীপুরের শিবচর অংশসহ অধিকাংশ অংশেই সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ ঘরবাড়ি দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এক শ্রেণীর দালাল, অসাধু চক্র ও জমির মালিকরা এই অপতৎপরতার সঙ্গে জড়িত। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ-শরীয়তপুরের জাজিরা-মাদারীপুরের শিবচর-ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে প্রায় শেষ পর্যায়ে। প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রেললাইন হবে সিঙ্গেল লাইন। কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর রেলস্টেশন, শিবচরে ২টি স্টেশন, যশোর ও ভাঙ্গায় একটি করে জংশন নির্মাণ করা হবে। এছাড়াও ৩৪টি সেতু, ৯৬টি বক্স কালভার্ট এবং আন্ডারপাস থাকবে এ প্রকল্পে। বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীতে নির্মিত হবে ২১.৮৪ কিমি. উড়াল সংযোগ সেতু। প্রথম পর্যায়ে ভাঙ্গা পর্যন্ত ৮২ কিলোমিটার প্রথম ফেজে অধিগ্রহণ শেষে চলছে ক্ষতিপূরণ বিতরণও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এ প্রকল্পের জন্য মোট ৩৫৮.৪১ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। রেললাইন নির্মাণে উঁচু জমিতে ১২০ ফুট ও নিচু জমিতে ১৫০ ফুট প্রস্থতায় জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রথমে ধীরগতি থাকলেও গত ১ বছরে বেড়েছে কাজের গতি। এরই মাঝে ২ মাস আগে রেললাইন সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় মার্কিং করা হয়। এরপরই শুরু হয়েছে শিবচর অংশসহ প্রকল্পর বর্ধিত সংলগ্ন এলাকাজুড়ে সরকারের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতে গড়ে উঠছে শত শত অবৈধ ঘর-বাড়ি দোকান-পাট। তবে এখন পর্যন্ত কতটুকু জায়গা সম্প্রসারণ হবে তা নিশ্চিত নয় প্রশাসন। শিবচরের মাদবরচর মোল্লাকান্দি, পোদ্দারচর, কাঁঠালবাড়ি, জাজিরার বিভিন্ন গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে বসতি, লাগানো হয়েছে গাছপালা। এসব স্থাপনায় কেউ থাকে না শুধু ক্ষতিপূরণের অতিরিক্ত বিলের আশায় এসব ঘর-বাড়ি, দোকাপাট নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারের আগাম তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে এ অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। স্থানীয়রা সবাই জানে এই দুর্নীতির কথা। তাদের অভিযোগ সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশেই আগাম তথ্য ফাঁসের কারণে চলছে এসব। অনেক নদী ভাঙ্গন কবলিতদের আনা হয়েছে এ ঘরগুলোতে। স্থানীয় আবু কালাম বলেন, ‘পদ্মা সেতুর রেললাইন বড় করতে নাকি আরও জমি নেবে। এই কথা শোনার পর আমাগো এলাকায় ফসলি জমিতে ঘরবাড়ি তোলার হিড়িক পড়ে গেছে। বেশির ভাগ ঘরে কোন লোকজন থাকে না। কিছু ঘরে নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে খুঁজে খুঁজে এনে থাকতে দেয়া হয়েছে।’ আরেক স্থানীয় জয়নাল মিয়া বলেন, ‘রেললাইনের জন্য যখন সরকারী লোকজন এই এলাকায় সীমানা পতাকা লাগিয়েছে তখন থেকেই এখানে ঘরবাড়ি তুলছে একটি চক্র। স্থানীয়দের পাশাপাশি বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে জমির মালিকের সঙ্গে সরকারী বিলের টাকা ভাগাভাগির কন্টাক্ট করে বড় বড় ঘর তুলছে। এসব চললেও প্রশাসনের কেই কিছু বলে না।’ মালেক মিয়া বলেন, ‘সরকারী লোকজনই দুর্নীতি করে আর নাম হয় শুধু আমাগো। সরকারী অফিসের লোক পরিচয় দিয়া আমাগো কাছে আইসা ঘরবাড়ি তুলতে কইছে। সরকারী বিলের টাকার তিনভাগের দুই ভাগ আমাগো দিবো, আর এক ভাগ তারা নিবো, এই কথাই তারা বলছে। তাগো কেউ কিছু বলে না খালি যত দোষ আমাগো।’ কাঁঠালবাড়ি ৯নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য সাঈদ ব্যাপারী বলেন, ‘এখানে রেললাইনের জন্য সরকার নতুন করে কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করবে এ খবর আমরা জানার আগে দালাল চক্র কিভাবে যেন খবর পেয়ে গেছে। তারা এই গোপন খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির মালিকদের সঙ্গে কন্টাক্ট করে ঘরবাড়ি তুলছে। আর এর কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাটের দরজা খুলে গেছে। আমরা চাই সরকারী অফিসের এই গোপন খবর আর যেন দালাল চক্র না জানতে পারে। এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’ মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সজল নূর বলেন, ‘রেললইন সংযোগ সড়ক সম্প্রসারণের জন্য আমরা নতুন করে কিছু জায়গা অধিগ্রহণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি কিছু অসাধু চক্র সরকারী মুনাফা লাভের আশায় অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় অবৈধভাবে ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছে। ইতোমধ্যেই আমরা কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছি আর বাকি স্থাপনাও উচ্ছেদ করার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। আর নতুন করে কোন অবৈধ স্থাপনা যেন কেউ গড়ে তুলতে না পারে এ বিষয়ে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।’ মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে মাদারীপুরে অনেক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলছে। তার মধ্যে রেললাইন প্রকল্প একটি অন্যতম। যখন একটি প্রকল্পের প্রস্তাব আসে তখন আমাদের অফিস থেকে বা যে কোন মাধ্যমে জমির মালিকরা তথ্যটি জানতে পারে। তখনি এই অবৈধ ঘরবাড়ি, স্থাপনা তৈরির প্রবণতা শুরু হয়। তথ্য ফাঁসের এই বিষয়টি পুরোপুরি বন্ধ করা কখনোই সম্ভব নয়। এলাকায় গিয়ে কার্যক্রম শুরু করলে স্থানীয়রা তখন তো বিষয়টি এভাবেই জেনে যায়। আর তথ্য জানার অধিকারও তাদের আছে। তবে তথ্য পাওয়ার পর কেউ যেন অসদুপায় সরকারী টাকা লোপাট করতে না পারে এ বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
×