ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ॥ পরিচালক

ঢাকা শিশু হাসপাতালে শয্যা সঙ্কট ॥ অর্ধেক রোগী ফিরে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ৩ মে ২০১৯

  ঢাকা শিশু হাসপাতালে শয্যা সঙ্কট ॥ অর্ধেক রোগী ফিরে যাচ্ছে

শেকৃবি প্রতিনিধি ॥ আন্তর্জাতিকমানের বেশ কিছু নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ঢাকা শিশু হাসপাতালে। অতিসঙ্কটাপন্ন শিশু রোগীদের নিবিড় চিকিৎসার জন্য চালু হওয়া হাই ডিপেনডেন্সি ও আইসোলেশন ইউনিটটি এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার কোথাও নেই। শিশু কিডনি রোগীদের জন্য চালু করা হয়েছে ক্রিটিকেল কেয়ার নেফ্রোলজি এ্যান্ড ডায়ালাইসিস ওয়ার্ড এবং জেনারেল নেফ্রোলজি ওয়ার্ড। সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন হাসপাতালে জটিল রোগে আক্রান্ত শিশুদের সেবায় অপারগ হলেই তারা পাঠিয়ে দিচ্ছে শিশুদের সেবার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানে। ভাল চিকিৎসা পাওয়ায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য রোগী ভিড় জমাচ্ছে এখানে। কিন্তু তাদের মধ্যে ভর্তিযোগ্য রোগীর অর্ধেকের বেশি ফিরে যেতে হয় শয্যাসঙ্কটে। অর্থাভাবে মানসম্মত সেবা বজায় করতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আবাসনসংকটে আছে হাসপাতালে ডাক্তারা। হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ শফী আহমেদ জনকণ্ঠকে জানান, হাসপাতালের উন্নয়নে বেশকিছু নতুন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। এগুলো সমাপ্ত হলে হাসপাতালে সেবার মান আরও বাড়বে। হাসপাতালটিতে নতুন কিছু বিভাগ চালু এবং রোগীদের সেবার মান বাড়াতে কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নের কারণে হাসপাতালে রোগীর ভিড় বেড়েছে কয়েকগুণ। বিশাল পরিসরের হাসপাতালটি এখন রাত-দিন রোগী-দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি আরও জানান, এই হাসপাতালে নামমাত্র খরচে উন্নত সেবা প্রদান করা হয়। বিনামূল্যে শতকরা ৪০ শতাংশ বেড দেয়া হয়ে থাকে। শুধু বেড নয়, বিনামূল্যে সেবা গ্রহণের জন্য তালিকাভুক্ত রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত সব খরচ ও খাবার সুবিধা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করে। প্রতি রোগীর একজন দেখাশোনাকারীর জন্যেও বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা আছে। হাসপাতালের উন্নয়নে ধনাঢ্যশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ শফী আহমেদ। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে সম্প্রতি বেশকিছু নতুন বিভাগ চালু করা হয়েছে হাসপাতালে। এ মধ্যে দেশে প্রথম অতিসঙ্কটাপন্ন শিশু রোগীদের নিবিড় চিকিৎসা হাই ডিপেনডেন্সি ও আইসোলেশন ইউনিট চালু করা হয়েছে। বেড সংখ্যা ১৮টি। এ মধ্যে ৩টি বেড আইসলেশন বিছানাগুলো পুরু কাঁচ দিয়ে পরিবেষ্টিত। চালু করা হয়েছে ১ দিন বয়স থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত শিশুদের জন্য ৮ শয্যার নিউনেটাল আইসিইউ। যা অতি শীঘ্রই ১৬ শয্যার উন্নত করা হবে। ২৮ দিন বয়স থেকে ১৮ বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য রয়েছে পেডিয়াট্রিকস আইসিইউ। কিডনি রোগীদের জন্য চালু করা হয়েছে ক্রিটিক্যাল কেয়ার নেফ্রোলজি এ্যান্ড ডায়ালাইসিস ওয়ার্ড এবং জেনারেল নেফ্রোলজি ওয়ার্ড। এখানে রোগীদের আল্ট্রাসাউন্ডের সহায়তায় রেনাল বায়োপসী করা হয়। হাসপাতালে ডিএনএ ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ ল্যাবে মাধ্যমে বিটা থ্যালাসিমিয়া, আলফা থ্যালাসিমিয়া, মাসকুলার ডিসট্রোফি, স্পাইনাল মাসকুলার এট্রফি, সিস্টিক ফাইব্রোসিসসহ যাবতীয় জন্মগত ও বংশগত রোগ নির্ণয় এবং এ রোগগুলোর প্রিন্যাটাল ডায়াগনসিস করা সম্ভব। বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে সম্পূর্ণ অটোমেটিক বায়োকেমিস্ট্র্রি এনালাইজার মেশিন সংযোজন করা হইয়াছে। এ ছাড়া ওপিডি ব্লাড কালেকশন রুম ও এক্স-রে বিভাগ রি-মডেলিং করাসহ ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। জেনারেল আই সি ইউ’তে শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা হযেছে। উল্লিখিত চিকিৎসার পাশাপাশি থ্যালাসেমিয়া, এ্যাজমা, লিভার, ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি, বক্ষব্যাধি, সার্জারি, মেডিসিনসহ সব ধরনের চিকিৎসাসেবার সমন্বয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালে রূপ নিয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতাল। হাসপাতালের অন্তঃবিভাগে বিছানা খালি না থাকলে অসুস্থ শিশুদের জরুরীভাবে ইমারজেন্সি, অবজারভেশন ও রেফারাল ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। অন্তঃবিভাগে বিছানা খালি না হওয়া পর্যন্ত এ বিভাগে চিকিৎসা দেয়া হয়, পরবর্তীতে অন্তঃবিভাগে স্থানান্তর করা হয়। মঙ্গলবার সরেজমিনে বি-ব্লকে ৫ম তলা শিশু হৃদরোগ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নামমাত্র খরচে হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের ওপেন হার্ট সার্জারি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে হার্টে ছিদ্র নিয়ে জন্ম হওয়া অসংখ্য শিশু মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসায় স্বস্তিতে পরিবার প্রিয়জনরা। এ ওয়ার্ডে কার্ডিয়াক সার্জারি জন্য রয়েছে ১০টি এবং কার্ডিয়াক মেডিসিনে জন্য ১২টি বেড। জানায় যায়, শিশুর জন্মের পর শ্বাসকষ্ট, অস্বাভাবিক হার্ট বিট, বারবার ঠা-া কাশি লাগা, হৃৎপি-ে ছিদ্রসহ নানা উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে আসছে অসংখ্য রোগী। এ ব্যাপারে হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ শফী আহমেদ বলেন, দেশে প্রতি হাজারে ১০ জন শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৭শ’য়ের অধিক শিশুর ওপেন হার্ট সার্জারি সম্পন্ন হয়েছে। আনুষঙ্গিক সব ধরনের ব্যয়সহ প্রতিটি সার্জারিতে খরচ হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত। গাজীপুর থেকে আয়েশা আক্তার তার এক বছর বয়সী ছেলে রাকিনকে নিয়ে এসেছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রাকিনের হার্টে ছিদ্র ধরা পড়েছে। ৭৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এ হাসপাতালে হার্টে ছিদ্র অপারেশন করে ভাল চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন আয়েশা আক্তার। হাসপাতালের প্রধান ফটকের পাশে কথা হয় জুরাইন থেকে আসা জামসেদ আলমের সঙ্গে। তিনি জ্বরে আক্রান্ত পাঁচ বছর বয়সী কন্যার চিকিৎসার জন্য এসেছেন। কিন্তু শয্যা খালি না থাকায় মেয়েকে ভর্তি করাতে পারেননি। তিনি খানিকটা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। জানতে চাইলে জামসেদ আলম বলেন, পাশের বাড়ির একজন বলেছিল এই হাসপাতালটা ভাল। এ জন্যই এত দূর থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সিট খালি না থাকায় ফিরে যাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ থেকে সাড়ে তিন বছরের শিশু মাহমুদকে নিয়ে এসেছেন মা আয়শা খাতুন। তার কাছে জানতে চাইলে হাসি মুখে জানান, শ্বাসকষ্ট সমস্যায় অনেক ডাক্তার দেখালেও খুব একটা উপকার হয়নি। কিন্তু এই এ্যাজমা সেন্টারটিতে দেখানোর পর তার সন্তান দ্রুত সুস্থ হচ্ছে। এ ছাড়া এখানকার চিকিৎসক ও নার্স সবাই খুবই যতœ করে সময় দিয়ে সমস্যার কথা শোনেন। কিভাবে শিশুর ইনহেলার ব্যবহার ও ওষুধের মাত্রা নির্ণয় করতে হয়, সেটা শিখিয়ে দেন। ফলোআপের জন্য তাগাদা দেন। ফলে কেউ একবার দেখালেই বাচ্চার অসুখ না সারা পর্যন্ত নিয়মিত ফলোআপে আসেন। এখানকার পরিবেশও খুব ভাল।
×