ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

মিউজিয়াম অব রাজাস

প্রকাশিত: ১০:১৩, ৩ মে ২০১৯

 মিউজিয়াম অব রাজাস

ছিলেন জমিদারনন্দন। অথচ নিজের গানে লিখেছেন, ‘আমি কিছু নয় রে আমি কিছু নয়...।’ বাউলদের স্বভাবসুলভ বিনয়বশত নিজেকে কিছু নয় বলে দাবি করলেও বাংলা গানের অনেক কিছু হয়েই থেকে গেলেন তিনি। হাছন রাজা। ভোগবিলাসের জীবন ছেড়ে বৈরাগ্য গ্রহণ করেন তিনি। সঙ্গীতের আশ্রয়ে পরমাত্মার সন্ধান করেন। মরমী কবির ঘটনাবহুল জীবন ও দর্শন সম্পর্কে কৌতূহলের শেষ নেই। আজও মানুষ তার স্মৃতি খুঁজে ফেরে। সে দিকটি বিবেচনায় রেখে এ মরমি সাধকের স্মৃতি রক্ষার্থে তার পরিবারের উদ্যোগে সিলেট নগরীর জিন্দাবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিউজিয়াম অব রাজাস। ২০০৬ সালের ৩০ জুন যাত্রা করে হাছন রাজার নাতি দেওয়ান তালেবুর রাজা ট্রাস্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি। ভাটিবাংলার সাধক পুরুষ হাছন রাজা ও তার সময়কে তুলে ধরার প্রয়াস এখানে। সেই সঙ্গে এসেছে বাকি রাজাদের খুঁটিনাটি। ছোট পরিসর। সীমিত উপস্থাপনা। এর পরও হাছন রাজায় বুঁদ হয়ে থাকা যায়। জীবনের গভীরতর বোধগুলোকে নতুন করে জাগিয়ে তুলে, নাড়া দেয় মিউজিয়াম অব রাজাস। সিলেট শহরে অবস্থিত হলে পরেও এ অধমের সময়, সুযোগ কোনটাই হয়নি। কথায় আছে মক্কার মানুষের হজ হয় না সেই রকম অবস্থা। বারে শনিবার বের হয়েছি অফিসের এক সহকর্মীর সঙ্গে দেখা করব বলে। ফোন দিলাম সহকর্মীকে উনি বললেন উনি একটু সামনে বের হয়েছেন তাই অপেক্ষা করতে। চলতি পথে দেখতে পেলাম মিউজিয়াম অব রাজাসের দ্বার খোলা আছে। তাই কোন পরিকল্পনার অপেক্ষা না করে ঢুকে পড়লাম মিউজিয়াম অব রাজাসে। আশপাশে আধুনিক ভবন। সুউচ্চ অট্টালিকা। ওসবের ভিড়ে একটিই পুরনো এবং ভূমিসংলগ্ন বাড়ি। টিনের একতলা। দেখেই মনে পড়ে যায় হাছন রাজার সেই বিখ্যাত গান- লোকে বলে, বলে রে/ ঘর বাড়ি ভালা না আমার...। জাদুঘরের প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দুটি সিংহ স্বাগত জানানোর ভঙ্গিতে বসে আছে। দেখে মনে হলো বহুকাল আগের পাথর মূর্তি। জমিদার বাড়ির আবহ তৈরি করতেই এমন সংযোজন। নগ্ন পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে প্রবেশ করলে দুটো কামরা দর্শন মিলে। বেশ কয়েকটি গ্লাস শোকেস। বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো। একটি গ্লাস শোকেসে হাছন রাজার গানের পা-ুলিপি। নিজের হাতে লেখা। মূল কপি না হলেও, পড়া যায়। বাঁশের কঞ্চি কেটে তৈরি কলম আর কালিতে লেখা গীতি কবিতা হাছন রাজার সৃজনশীলতার অনিন্দ্য প্রকাশ। হাছন রাজার অধ্যাত্মবাদের যে পরিচয় মেলে, তাও মূলত সঙ্গীতে। একাধিক গ্লাস শোকেস সাজানো হয়েছে লোকবাদ্যযন্ত্র দিয়ে। একতারা, দোতরা, ঢোল আদি রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে এখানে। ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম সম্মুখ পানে দ্বিতীয় কক্ষের একটি দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে হাছন রাজার নিজের রচনা ও তাকে নিয়ে লেখা বই। গ্রন্থসম্ভার। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বই ও পা-ুলিপি হাছন রাজা বিষয়ক গবেষণার ফল। রাজা পরিবারে ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শন থেকেও হাছন রাজাকে খুঁজে নেয়া যায়। উদাহরণ হতে পারে প্রথম কক্ষের মাঝখানে রাখা লোহার সিন্দুকটি। হাছন রাজার পরিবারে ব্যবহৃত ৩০০ কেজি ওজনের সিন্দুক তাদের অঢেল ধনসম্পদের, মনে করা যেতে পারে, প্রতীকি উপস্থাপনা। ওই সময় বিশেষ এক ধরনের পাদুকা ব্যবহার করা হতো, যার নাম খড়ম। একাধিক আলোকচিত্রে হাছন রাজাকে খড়ম পায়ে দেখা গেছে। জাদুঘরের এককোণে রাখা হয়েছে অনরূপ দেখতে খড়ম। হাছন রাজার পোশাক সম্পর্কে ধারণা দেয় একাধিক আলোকচিত্র। হাছন রাজার আলোচনায় কিছু পশু-পাখির নাম সব সময়ই এসেছে। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছে জাদুঘর। জানাচ্ছে, হাছন রাজার ঘোড়াগুলোর ছিল আলাদা আলাদা নাম। যেমন কদমবাজ, লাল বড় ঘুড়ি, জিন ঘুড়ি, চান্দা, খুস দিল, বাক্কা বাহাদুর, শিং বাহাদুর, জয় বাহাদুর, সোনা লাল, বিজলি ঘুড়ি, মালতী। কত কত নাম! মোট ৭৮টি নামের উল্লেখ পাওয়া যায় জাদুঘরে। পাশের একটি ওয়াল শোকেসে রাখা আছে হাছন রাজার ব্যবহার করা ঘোড়ার লাগাম। চামড়ার বেল্টের মতো দেখতে সামান্য বস্তু এখন অমূল্য স্মারক। জাদুঘরে উপস্থাপন করা হয়েছে বেশ কিছু হাতির নাম। নামগুলোর মধ্যে রয়েছে জিবা, জঙ্গ বাহাদুর, বাংলা বাহাদুর, মাসুকজান, মুকনা, রাজরানী, সুরত জান, মঙ্গল প্যারী ও হাছন প্যারী। হাছন রাজার কোড়ার কথা তো বার বার এসেছে গানে। এই পাখি খুব যত্ন করে পালতেন হাছন রাজা। খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজার ডায়েরি থেকে কোড়াদের বিভিন্ন নাম সংগ্রহ করেছে জাদুঘর। টানানো তালিকায় আছে ৮০টি নাম। লাল মইন, চাকার কোড়া, টক্করিয়া, হাছন জান, হাছন বাহার, বাঘা, জল্লা, মহারাজ, ভাজ রাঙিয়া ইত্যাদি নাম হাতির চরিত্র সম্পর্কেও একটি ধারণা দেয়। শখের বসে পশু শিকারও করতেন রাজা পরিবারের সদস্যরা। তখনকার সময় এটি ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। শিকার করা পশুর সিং-চামড়া জমিদারদের শৌর্য-বীর্যের প্রতীক হয়ে দেয়ালে শোভা পেত। জাদঘরে রাখা হরিণের শিং যেন সেই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হাছন রাজা পরিবারের ঐতিহ্য আভিজাত্যের স্মারক হয়ে আছে তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন বাসনকোষন, পোশাক পরিচ্ছদ। বেগম মেহেরজান বানুর পোশাকের ছিন্ন অংশ রাখা আছে জাদুঘরে। স্বর্ণ ও রৌপ্য খচিত পোশাক দেখে বিস্ময় কাটে না। শ্বেতপাথরের বাসনকোষনও মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়। একটি কাচের থালা দুই স্তরবিশিষ্ট। মাঝখানে গরম পানি রাখার ব্যবস্থা আছে। তার ওপর খাবার পরিবেশন করা হতো। ফলে খাবার থাকত গরম! এভাবে ছোট্ট জাদুঘর হলেও আকৃষ্ট করে রাখে। হাছন রাজা ও তার ব্বংশধরদের ইতিহাস জানতে জাদুঘরটি বেশ সহায়ক। যাবেন কি ভাবে - ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, রাজারবাগ ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রীনলাইন, শ্যামলী, এনা, হানিফ বা বিআরটিসি বাসে অথবা ট্রেনে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সকালে আন্তঃনগর পারাবাত, দুপুরে জয়ন্তিকা ও কালনী এবং রাতে উপবন সিলেটের পথে ছোটে ভাড়া ৩৬০ থেকে ১২০০ টাকার মধ্যে । সেখান থেকে জিন্দাবাজারে অবস্থিত মিউজিয়াম অব রাজাস যেতে ভাড়া নেবে ৪০ টাকা, সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
×