ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অপরূপ নেত্রকোনা

প্রকাশিত: ১০:১২, ৩ মে ২০১৯

অপরূপ নেত্রকোনা

বরেণ্য মানুষ সৃষ্টির এক উর্বর জেলা নেত্রকোনা। এই জেলায় অসংখ্য বরেণ্য মানুষের জন্ম হওয়ার কারণে বরাবরই নেত্রকোনার প্রতি আমার একটি আলাদা টান রয়েছে। এই ভাল লাগা থেকেই বরেণ্যদের নিয়ে টেলিভিশনে বিগত বছর দশেক নিয়মিতভাবে আমি দীর্ঘ ধারাবাহিক অনুষ্ঠান নির্মাণ ও উপস্থাপনা করে চলেছি। বিটিভিতে আমার নির্মিত ও উপস্থাপিত সেই অনুষ্ঠানে নেত্রকোনায় জন্ম নেয়া বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ, বিজয় বাংলা কি বোর্ডের জনক ও বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা, এই সময়ের জাতীয় বীর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান (আইজিপি পদমর্যাদা) মুহ. আবদুল হাননান খানের জীবনী আমি ইতোমধ্যে উপস্থাপন করেছি। এই তিনজই এই সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে দেশের জন্য বিরাট অবদান রেখে চলেছেন। এ ছাড়া নেত্রকোনার বরেণ্যদের তালিকা যদি করা হয় জীবিত-মৃত মিলিয়ে অর্ধশতাধিক যে ছাড়িয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আগে কখনও নেত্রকোনায় যাওয়ার কোন উপলক্ষ পাইনি সে জন্য যাওয়াও হয়নি। এবার একটি উপলক্ষ পেয়ে সেখানে প্রথমবারের মতো যাওয়ার সুযোগটি আর হাতছাড়া করিনি। নেত্রকোনার বেসরকারী অর্থনৈতিক ও মানবিক উন্নয়ন সংস্থা (অমাস)-এর চেয়ারম্যান মুহ. আবদুল হাননান খান এবং নির্বাহী পরিচালক মো. ইকবাল হাসান তপুর আহ্বানে তাদের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুই বাংলার মানুষের অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্মেলনে আমাকে প্রদত্ত একটি সম্মাননা গ্রহণ করতে গত ২৯ মার্চ নেত্রকোনায় যাই। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করতেই হয় যে, ঢাকা থেকে নেত্রকোনা যাওয়া থেকে শুরু করে ও সম্মাননা গ্রহণের পর নেত্রকোনায় অবস্থানকালে পিতৃ-মাতৃতুল্য মুহ. আবদুল হাননান খান এবং তার স্ত্রী মমতাজ জামান আক্তার সিদ্দিকার পূর্বধলাস্থ বাসভবনে আন্তরিক আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। নেত্রকোনা যে শুধু বরেণ্য মানুষের জন্ম দেয়া এক উর্বর ভূমি তাই নয়। পাহাড়, হাওর আর সমতলের এক অপূর্ব নৈসর্গিক লীলাভূমি নেত্রকোনা। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়ক পথে ১৫৯ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ লাগোয়া জেলা নেত্রকোনা। উত্তরে মেঘালয়ের গারো পাহাড়, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ, পূর্বে সুনামগঞ্জ এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা। কংস, সোমেশ্বরী, মগরা, ধলা প্রভৃতি প্রধান নদী এ জেলার বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে। জেলার মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুড়ি ও কমলাকান্দা উপজেলায় কম-বেশি ৫৬টি হাওর এবং বিল রয়েছে। শুস্ক মৌসুমে হাওরে চাষাবাদ হলেও বর্ষা মৌসুমে পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। শুষ্ক মৌসুমে সাবমার্সিবল রোড দিয়ে এক এলাকা থেকে আর এক এলাকায় যাওয়া যায়। বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকার একমাত্র বাহন নৌযান। বর্ষাকালে হাওরের গ্রামগুলো একেকটি ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরের প্রকৃত সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে বর্ষা মৌসুমে। এ জেলায় দেখার মতো অনেক কিছুই আছে। টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ। ১৯৪৬-৫০ সালে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত টঙ্ক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। দুর্গাপুর উপজেলাধীন বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি থেকে কিছুটা সামনে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছু দূর এগুলোই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণি সিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে তিন দিনব্যাপী মণিমেলা নামে লোকজ মেলা বসে। দুর্গাপুর উপজেলাতেই আছে সুসং দুর্গাপুর জমিদার বাড়ি। সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বর পাঠকের বংশধররা এ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাংলা ১৩০৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে জমিদার বাড়িটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের বংশধররা এটি পুনর্নির্মাণ করেন। বিরিশিরি থেকে সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে রানীখাং গ্রাম। এ গ্রামেই আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। রানীখাং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। দুর্গাপুরের পার্শ্ববর্তী বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই রয়েছে কমলা রানীর দীঘি। এই কমলা রানীর দীঘি সাগর দীঘি নামেও পরিচিত। দিঘীটি পুরোপুরি বিলিন হয়ে গেলেও এর দক্ষিণ পশ্চিম পাড় এখনও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। এই দীঘি নিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। নেত্রকোনায় যাব আর এর সৌন্দর্য উপভোগ করব না তা কী করে হয়? আমার পক্ষে যদিও সব স্থান ভ্রমণ করা সম্ভব হয়নি। তার পরেও পাঠক যেগুলো দেখা হয়েছে সেগুলো এখন আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি।যেহেতু দুর্গাপুর উপজেলাতেই দর্শনীয় স্থানগুলো বেশি সেহেতু পরের দিন অর্থাৎ ৩০ মার্চ মুহ.আবদুল হান্নান খানের উদ্যোগেই তার সঙ্গী হয়ে প্রথমেই জেলার দুর্গাপুর উপজেলাধীন বিরিশিরি নামক স্থানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমিতে যাই। আমাদের সঙ্গে আরও ছিলেন নেত্রকোনার স্থানীয় ইতিহাস গবেষক ও লেখক আলী আহাম্মদ খান আইয়ুব। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহ যেমন গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু প্রভৃতি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, পরিচর্যা, উন্নয়ন ও লালনের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে একাডেমিটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমিতে প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। যেমন যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় দিবসসমূহ পালন করা হয়, নববর্ষ উদযাপন করা হয়, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জয়ন্তী ও মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয় আবার তেমনি উপজাতীয়দের নিজস্ব সকল উৎসব উদযাপন করা হয়। এর মধ্যে বার্ষিক দেউলি উৎসব, ওয়ানগালা উৎসব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উৎসবগুলো যখন চলে তখন বৃহত্তর ময়মনসিংহ এমনকি সারা দেশের সংস্কৃতি সেবিদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয় একাডেমি।বলা যায় ঐ অঞ্চলের একটি সাংস্কৃতিক হাব এটি। কয়েক বিঘা জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা একাডেমিতে আছে একটি জাদুঘর,লাইব্রেরি,রেস্ট হাউস,হোস্টেল, সুদৃশ্য মিলনায়তন ইত্যদি।জাদুঘরটিতে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠির হারানো কৃষ্টি-কালচার স্বযতেœ সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।লাইব্রেটিও যথেষ্ট সমৃদ্ধ।ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি সম্পর্কিত গন্থসহ নানা বিষয়ক গ্রন্থ এখানে আছে।যদি কোন পর্যটক মনে করেন যে এখানকার রেস্ট হাউসে থেকে প্রকৃতির মাঝে বইয়ের সাথে কটা দিন কাটিয়ে দিবেন সুন্দরভাবে কাটিয়ে দিতে পারেন। হোস্টেলে একাডেমির নিজস্ব শিল্পীরা থাকেন। শ’তিনেক আসন বিশিষ্ট মিলনায়তনটিও বেশ পরিপাটি। সব মিলিয়ে একাডেমিটি যে কারোই ভাল লাগবে। একাডেমি ঘুরে আমরা সোমেশ্বরী নদী পেরিয়ে বিজয়পুর বর্ডারের উদ্দেশে রওনা দেই। সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের মেঘালয় রাজ্য হতে উৎপত্তি হয়ে বিজয়পুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সোমেশ্বরী নাম ধারণ করেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৫০ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১১৪ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। এই নদীতে উন্নত বালি, কয়লা, পাথর উত্তোলন করে প্রতিদিন শতশত দরিদ্র মানুুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এখন শুস্ক মৌসুম হওয়ায় আমরা ছোট্ট কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে অনায়াসে সোমেশ্বরী পার হই। নদী পেরুনোর সময় বালি, কয়লা, পাথর আহরণও আমাদের চোখে পড়ে। বর্ষা মৌসুমে সোমেশ্বরী কানায় কানায় পানিতে পূর্ণ আর এক রূপে আবির্ভূত হয়। বিজয়পুরে একবারে সীমান্ত রেখাই আমরা যাই। সীমান্ত পর্যন্ত চলে গেছে বাংলাদেশের পাকা রাস্তা। পাকা রাস্তা হওয়ার কারণ এই সীমান্তে শীঘ্রই একটি স্থলবন্দর চালু হওয়ার কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে দুই দেশের মধ্যে আলাপ আলোচনাও অনেকদূর এগিয়েছে। সীমান্তে যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের পাহাড় কোনটা বাংলাদেশের আবার কোনটা ভারতের আপনাকে স্বাগত জানাবে। সীমান্ত রেখায় দাঁড়িয়ে সোমেশ্বরী নদী আর পাহাড় আপনাকে এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যাবে। সেখানে বেড়ানোর দারুণ এক অনুভূতি নিয়ে আমরা ফিরে আসি। আসার পথে বহেড়াতলিতে অবস্থিত রাশমণি স্মৃতিসৌধে কিছু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সংঘটিত কৃষক ও টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেত্রী হাজং মাতা রাশমনির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাশমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এখানে নির্মাণ করেছে এ স্মৃতিসৌধটি। এখান থেকে ঐতিহ্যবাহী চীনা মাটির পাহাড়ে যাই। রাশমণি স্মৃতিসৌধ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বিজয়পুরে আছে বাংলাদেশের একমাত্র চীনা মাটির পাহাড়। এই পাহাড়ের মাটির রং সাদা থেকে হাল্কা গোলাপি। এই মাটি সিরামিকের জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। মাটি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে পাহাড় খননের ফলে পাহাড়ের বুক চিরে এখানে তৈরি হয়েছ স্বচ্ছ নীল জলাধার। চীনা মাটির পাহাড় থেকে এবার ফিরার পালা। আমরা রওনা দেই বিরিশিরির ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমির দিকে। রাস্তা পেরুচ্ছিলাম আর যেন পেছন থেকে দেখে আসা অপরূপ সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। কিন্ত সময়তো আর বাধা মানে না। সময় হয়ে যায় ঢাকায় রওনা দেয়ার পেছনের অপরূপ সৌন্দর্য ফেলে রেখে গাড়ির চাকা দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলে ঢাকার পথে। পুরো নেত্রকোনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে কমপক্ষে ৩-৪ দিন সময় হাতে নিয়ে যেতে হবে। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতি ঘণ্টায় ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার উদ্দেশে বাস ছেড়ে যায়।চাইলে প্রথমে ময়মনসিংহ যেতে পারেন এবং সেখান থেকে বাসে নেত্রকোনা যাওয়া যায়। আবার সরাসরি নেত্রকোনার বাসেও যেতে পারেন। নেত্রকোনা যেতে সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ চার ঘন্টা সময় লাগবে। নেত্রকোনা সদরে থাকার জন্য আবাসিক হোটেল এবং রেস্ট হাউস আছে।রাত্রী যাপনটা সেখানেই করতে পারেন।আবার চাইলে সবচেয়ে বেশি দর্শনীয় স্থান সমৃদ্ধ উপজেলা দুর্গাপুরেও রাতযাপন করতে পারেন। সেখানেও থাকার জন্য আবাসিক হোটেল এবং রেস্ট হাউস আছে। নেত্রকোনায় গিয়ে হাওরের মাছ খেতে ভুলবেন না কিন্তু। তাহলে আর দেরি কেন? আপনার যারা ভ্রমণ পিপাসু তারা একটি সময় নির্বাচন করে বেরিয়ে পড়তে পারেন নেত্রকোনার উদ্দেশ্যে। আপনাদের নেত্রকোনা যাত্রা শুভ হোক। সাজ্জাদ কাদির
×