ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

কর্মজীবী মায়ের সংসার

প্রকাশিত: ১০:১১, ৩ মে ২০১৯

 কর্মজীবী মায়ের সংসার

সময়ের প্রয়োজনে, যুগের দাবিতে, নিজেদের তৈরি করার তাগিদে নারীর ঘর থেকে বাইরে পা রাখা জোরোলোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময়কার সুগৃহিণী নারীরা আজ শিক্ষায়, আধুনিকতায় নিজেদের সফল প্রমাণ করে কর্মক্ষেত্রেও তাদের অভিগামিতাকে স্পষ্ট করতে পিছপা হচ্ছে না। গত শতকের মাঝামাঝিতেও নারীরা সে ভাবে অবাধ ও মুক্ত পথচলায় অবারিত হতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নারী জাগৃতির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার ওপর যে যুগান্তকারী মনন ও সৃজন চেতনাকে নিবেদন করেছিলেন সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে তিনি শুধু আলোকবর্তিকাই হয়ে থাকলেন। প্রায় অর্ধশত বছর পার হতে থাকলে নারী শিক্ষা কিছুটা সংশ্লিষ্টাদের হাতের কাছে চলে আসলেও সবার ক্ষেত্রে সেভাবে সম্ভব হয়নি। সেই অন্ধকার যুগেও বেগম রোকেয়া দাবি তুলে ছিলেন একজন অবোধ বালিকাকে বাল্যকালে বিয়ে দিতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয় তার অর্ধেক খরচ করলে মেয়েটি নিজেকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে সক্ষম হবে। শুধু তাই নয় নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করার ক্ষমতাও এসে যাবে। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রেও নারীরা যোগ্যতম বিবেচনায় ক্ষমতা এবং অধিকারকে সংহত করতে পারবে। শুধু তাই নয় সামাজিক অভিশাপের জঞ্জাল থেকে তাদের বের করে আনতে খুব বেশি সময় নেবে না। নারী শিক্ষার জন্য এমন অমৃত বাণী তৎকালীন সময়ের জন্য বিস্ময়কর হলেও চলমান সময়ে তা একেবারে জীবন ও মানোন্নয়নকে ক্রমাগতই সহজ এবং স্বাভাবিক করে তুলছে। আর তারই সুফল আমরা পেতে থাকি গত শতকের আশির দশক থেকে। তখন সংখ্যায় অল্প হলেও আজ তার হাতেগোনার অবস্থায় নেই। এই শতকের দ্বিতীয় দশকে তা একেবারে জোয়ারের কাতারে। এখন প্রায়ই প্রতি ঘরের মেয়েরা শুধু শিক্ষাই নয় পেশাগত জীবনকেও তাদের পথ চলায় সম্পৃক্ত করতে পেরেছে। ফাতেমা-তুজ-জোহরা তেমন একজন মা এবং কর্মজীবী নারী। ঘরে-বাইরে নিজের কর্মক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করে সংসার জীবনের সঙ্গে পেশার ক্ষেত্রকেও চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আশপাশের নিকটজনের একান্ত সান্নিধ্য এবং সহযোগিতার জীবন ও কর্মকে অত্যন্ত সাবলীলভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন। পাবনার মেয়ে জোহরা। পড়াশোনা শুরু করেছেন ঢাকাতেই। বাবা মোঃ আকবর আলী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মা শামীমা আকবর গৃহিণী। ৩ ভাই-২ বোনের মধ্যে তিনি ছোট। একটা ব্যাপার শুনে খুব ভাল লাগল যখন জোহরার কাছ থেকে জানা গেল মা-বাবা কখনও ছেলেমেয়ের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেননি। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় ভাইয়েরা যে ভাবে সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন তিন বোন ও সে মাত্রায় কোন কিছু কর্ম পাননি। বরং ছোট মেয়ে হিসেবে সংসারে তার কদর ছিল অন্যদের চাইতে একটু বেশি। সুতরাং শিক্ষা গ্রহণের সর্ববিধ অধিকার নিয়ে বড় হওয়া জোহরা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই তার শিক্ষা জীবনকে পার করেছেন। সাভার গার্লস হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং সাভার ক্যান্টেনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি তিতুমীর কলেজে স্নাতকে (সম্মান) ভর্তি হন। হিসাববিজ্ঞান বিভাগে এবং স্মাতোকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করে পেশাগত জীবনেও প্রবেশ করার ক্ষমতায় নিজেকে দক্ষ করে তুলেছেন। ২০০৯-এ শিক্ষা কার্যক্রম সমাপ্ত হলে সাউথ ইস্ট ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। তবে মাঝপথে ঘটে যায় জীবনের প্রয়োজনীয় এবং আকাক্সিক্ষত স্বপ্নপূরণ। তিতুমীর কলেজেই সহপাঠী-বন্ধুর সঙ্গে হৃদ্যতার পরিণতি শুভ পরিণয় পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। স্বামী পেশায় একজন সাংবাদিক। জানা, শোনা, চেনা মানুষের সঙ্গে ঘর করতে গিয়ে অচেনা পরিবেশকেও মোকাবেলা করতে হয়। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-ভাসুরের ভরা সংসার। কিন্তু শাশুড়ি একেবারে মায়ের ভূমিকায়। যার কারণে এক পুত্র ও কন্য সন্তানের মা হয়েও সংসার এবং কাজের জায়গায় এ পর্যন্ত কোন ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়নি। শুধুমাত্র নিজের মনের ভেতরের অকারণ অস্থিরতা ছাড়া শাশুড়ি একজন শিক্ষিতই শুধু নন পড়াশোনায় আগ্রহী একজন পাঠকও বটে। নিয়মিত পত্রিকা পড়েন, নতুন গল্প, উপন্যাস হাতের কাছে পেলে সে সবও কোনমতে ছাড়েন না। জ্ঞান চর্চার প্রতি এমন সম্মোহন যার তিনি তো সারা দেশেরই মা- শুধু বউমার নয়। নিশ্চিন্ত থাকেন জোহরা সন্তানদের ব্যাপারে। জানেন এবং শ্রদ্ধাও করেন শাশুড়ি মায়ের এমন দায়বদ্ধতায় ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠছে। ব্যাংকের চাকরি। ১০টা থেকে ৬টা প্রায়ই ৮ ঘণ্টা অফিসে থাকতে হয়। তারপরে ঘরে ফিরে এসে সন্তানদের বাকি যত্নটুকু করতে নিজেকে সমর্পণ করেন। কন্যাটি একেবারে ছোট। তাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোর কারণে নিজের জন্য আর তেমন কোন অবসরও থাকে না। ছেলেটা বড়, স্কুলে পড়ে। সন্ধ্যার পর তাকে নিয়েও বসতে হয়। তবে একটা কথা বলতে কোনভাবেই কার্পণ্য করেননি। স্বামীর সর্বক্ষণিক সহযোগিতা যেটা ছাড়া সামনে চলা অসম্ভব ছিল। পারিবারিক প্রতিবেশ, স্বামীর সাহচর্য, সন্তানদের ঘিরে মায়া মমতার যে নিগৃঢ়বাঁধন সবই আজ জীবনকে তৃপ্ত আর পূর্ণ করেছে। এমন করে মেয়েরা যদি এগিয়ে যেতে পারে আপন ইচ্ছায় এবং পারিবারিক ছায়ায় তা হলে সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে দেশটা প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাবে- এই প্রত্যাশা একেবারে অমূলক নয়।
×