ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

ভাস্কর নভেরা আহমেদ ॥ হারানো শিল্পীর সন্ধান

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৩ মে ২০১৯

ভাস্কর নভেরা আহমেদ ॥ হারানো শিল্পীর সন্ধান

বাংলাদেশে আধুনিক ভাস্কর্য শিল্প শুরুর পেছনে জড়িয়ে রয়েছে এক মহীয়সী নারীর নাম। শুধু বাংলাদেশ বল্লে ভুল হবে বলা যায় সমগ্র পাকিস্তানেই ভাস্কর্য শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল যাকে দিয়ে। সেই নারীই হচ্ছেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ। নভেরা আহমেদের শৈশব-কৈশোর বেড়ে ওঠা কলকাতা শহর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি চট্টগ্রাম শহরের আসকার দীঘির পাড়। তাঁর পরিবারিক আবহ ছিল সমসাময়িক অন্যান্য পরিবারের চেয়ে উদার ও আধুনিক। আর সে কারণেই নভেরা স্কুলে পড়া অবস্থাতেই নাচ, গানসহ নানা রকম সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই সময়ে নভেরা মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি করতে পছন্দ করতেন। যেটিই হয়ত পরবর্র্তীতে তাঁকে ভাস্কর হবার পথে এগিয়ে দিয়েছিল। ১৯৫০ সালে পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টারি পড়তে পাঠালেও নভেরা বেছে নেন ভাস্কর্যের পাঠ। ১৯৫১ সালে লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস এ্যান্ড ক্র্যাফটসে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনে পাঁচ বছর মেয়াদী মডেলিং ও স্কালপচার ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হন। এরই মধ্যে লন্ডনে শিল্পী হামিদুর রহমানের সঙ্গে তার পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯৫৫ সালে কোর্স শেষ হলে ভাস্কর্যে আরও পারদর্শিতার জন্য ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে যান। সঙ্গে ছিলেন শিল্পী হামিদুর রহমান। ইচ্ছা করলে বিদেশেই থেকে যেতে পারতেন। কিন্তু না ১৯৫৬ সালে মাতৃভূমির টানে হামিদুর রহমানের সঙ্গে দেশে ফিরে আসেন। সে সময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। যুক্ত হন হামিদুর রহমান। যুক্ত হন নভেরা আহমেদও। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে হামিদুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হলেও নভেরা আহমেদের নামটি অনুল্লেখিতই থেকে গেছে। ওই সময়টিতে নভেরা আহমেদ পাশ্চাত্য শিক্ষা আর নিজ দেশের কৃষ্টির এক মেলবন্ধন তৈরি করে প্রচুর কাজ করেন। ১৯৫৬-৬০ সময়কালে মাত্র চার বছরে শতাধিক ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট ১০ দিনব্যাপী জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে ও এশিয়া ফাউন্ডেশেনের সহযোগিতায় ‘ইনার গেজ’ শিরোনামে তৎকালীন গণগ্রন্থাগার যেটি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি সেখানে ৭৫টি শিল্পকর্ম নিয়ে সারা পকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নভেরা আহমেদের একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যেটি এই অঞ্চলের জন্য এক মাইলফলক। এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে নভেরা তাঁর এক শক্তিশালী অস্তিত্ব জানান দিয়েছিলেন। ওই সময়ের কিছু বিষয় লক্ষ্য করার মতো। পাকিস্তানী শাসকরা শিল্প-সংস্কৃতির চর্চার উপর খড়গ চালাচ্ছিলেন ইচ্ছেমতো। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মাত্র ড্রইং ও পেইনটিং এবং কমার্শিয়াল আর্ট এই দুটি বিভাগ নিয়ে ঢাকায় চারুকলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জন্ম লাভ করে। ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী চারুকলা বন্ধ করে দেয় কিনা এই আশঙ্কাও তখন ছিল। ভাস্কর্য বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ তৈরি হয়নি তখনও। চারুকলায় ভাস্কর্য বিভাগের যাত্রা শুরু হয় আরও পরে ১৯৬৩ সালে। আর এই অঞ্চলের নারী সমাজ ওই সময় ছিল এক প্রকার অবরোধ বাসিনী। পাকিস্তানের সেই সময়ের দম বন্ধ অবস্থায় একজন নারী ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনী করতে যে কী পরিমাণ সাহসের প্রয়োজন সেটি এখন ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। এই রকম একটি সময়ে নভেরা এই অঞ্চলকে তাঁর অস্তিত্ব জানান দিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের পথিকৃৎ এই মহান শিল্পী নভেরা আহমেদকে আমরা বুঝতে পারিনি। তাই তো ১৯৬০ সালে নভেরার একক প্রদর্শনীর পুস্তিকায় শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আজ এখানে নভেরা যা করছেন, তা বুঝতে আমাদের অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে।’ ভাস্কর্য যে ঘরের বাহিরে স্থাপন করা যায় নভেরাই সেটি প্রথম দেখিয়েছিলেন। তেজগাঁওয়ে এখন যেখানে পার্টেক্স গ্যালারি সেখানে ছিল শিল্পপতি এম আর খানের বাড়ি। সেই বাড়ির বহিরাঙ্গনে ১৯৫৮ সালে ‘পরিবার’ শিরোনামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন। ঢাকা শহরে আজকে যে অসংখ্য ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে এর সূত্রপাতটি হয়েছিল এই ভাস্কর্যটি স্থাপনের মধ্য দিয়েই। ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে নভেরার কাজের ধরন ছিল ফিগারেটিভ এক্সপ্রেশন। তাঁর কাজের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে নারী প্রতিমূর্তি। সমসাময়িক পুরুষ শিল্পীরা তাঁদের শিল্পকর্মে নারীকে মাতা, কন্যা, স্ত্রী এবং অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখলেও নারীদের যথার্থ কর্মময় জীবন উহ্যই ছিল। নভেরা নারীকে দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে; পুরুষ শিল্পীদের উপস্থাপনার বিপরীতে। তিনি ভাসা ভাসা সুন্দর আনন্দময়ী আদর্শ ফর্ম করার পরিবর্তে তাঁর ফর্মগুলোকে সরল, অর্থপূর্ণ, স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ করেছেন। উন্মোচন করেছেন সব ধরনের বিচলিত, আবেগমথিত, সত্যিকারের নারীর রূপকে। শুধু তাঁর কাজই নয়; ব্যক্তি জীবনে নভেরা ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক।পশ্চিমা ধারার জীবন যাপন, পোশাক পরিচ্ছদ চাল চলন সবকিছুতেই একটা ভিন্নতা ছিল বলেই তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গের আলোচনা থেকে বোঝা যায়। সেদিক থেকে বলতে পারি বেগম রোকেয়া যেমন তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন তেমনি নভেরা তাঁর কাজ এবং মুক্ত, স্বাধীন জীবনযাপন দিয়ে ওই সময়ের অবরুদ্ধ নারী মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন হয়তবা। নভেরা পাশ্চাত্যে ভাস্কর্যের পাঠ নিলেও কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর নিজ মাতৃভূমিকেই। কিন্তু আমরা তাঁকে বুঝতে পারিনি। আমি মনে করি শিশু এবং শিল্পীর বেড়ে ওঠার জন্য একটু আলাদা যত্নের প্রয়োজন হয়। নভেরার জন্য আমরা ওই সময়ে সেই যত্নশীল পরিবেশটি দিতে পারিনি। আর তাই এক আজানা অভিমানে নভেরা দেশে থাকেননি। বেছে নিয়েছিলেন নির্বাসিত জীবন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি নির্বাসিতই থেকেছেন। এমনকি তিনি চিরন্দ্রিায়ও শায়িত হয়েছেন বিদেশের মাটিতে। যা সত্যিই আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। তাই আজকে সময় এসেছে নভেরাকে যথাযথ মূল্যায়ন করার। এদেশে ভাস্কর্যের কথা বলতে হলে কিংবা ইতিহাস লিখতে হলে অবশ্যই সবার আগে নভেরার কথা বলতে হবে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে একটি অধ্যায়ের পথিকৃৎ এই মহীয়সীকে অস্বীকার করলে আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা হবে। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নভেরাকে একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করেছিলেন। তারপরেও সেটিই যথেষ্ট নয়। শহীদ মিনারের অন্যতম স্থপতি হিসেবে নভেরাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা এখন সময়ের দাবি। আমরা আশা করব নভেরাকে প্রাপ্য সম্মানটি দেয়া হবে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাতে নভেরাকে জানতে পারে সেই ব্যবস্থাটিও নেয়া হবে।
×