ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৯:৪৩, ৩ মে ২০১৯

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-৩১ প্লেন চেক পয়েন্টের দিকে গড়াতে থাকে। আমার পরিচিত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মুখগুলো ভেসে ওঠে আমার মনের পর্দায়। নাট্যবন্ধু এবং নাট্য প্রক্রিয়ার অভাবও অনুভূত হয় তখন। ভাবি, কী করব এত লম্বা সফরে প্রতিদিন? এক সময় বিশাল শব্দ করে ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে প্লেন অভীষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে সিট বেল্টের আলোয় সঙ্কেত নিভে যায়। আমরা বেল্ট খুলে আসন পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসি। তারপর নজর দিই সহযাত্রীদের দিকে। ততক্ষণে মুস্তাফা স্যার ঘুমিয়ে পড়েছেন। ইন্টারফ্লুগের সেই বিমানে যাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল বাংলাদেশী। পূর্ব জার্মানির এই এয়ারলাইনে করে বাংলাদেশের তরুণ ছাত্ররা যাচ্ছে পূর্ব জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য। এদের মধ্যে অর্থনীতি, খনিজবিদ্যা, প্রকৌশল এই ধরনের বিষয়াদির ছাত্র বেশি। কিছু যাত্রী চলেছেন ভিয়েতনাম থেকে পূর্ব জার্মানিতে শিক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য। এই উড়োজাহাজগুলোর সিটগুলো আজকের জেট প্লেনের চেয়ে অনেক আরামদায়ক ছিল। ইকোনমি ক্লাসেও হাত-পা ছড়িয়ে বসা যেত। ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির পশ্চিমা পেশাদারিত্বের সঙ্গে সাম্যবাদী দেশের মানুষের একটা পার্থক্য এই প্রথম বারের মতো নজরে এলো। বস্তুতপক্ষে সত্তরের দশক পর্যন্ত মার্কিনীদের অপপ্রচার এমন ছিল যে, মনে হতো কমিউনিস্টরা জ্যান্ত মানুষ সকাল-সন্ধ্যা ধরে ধরে খায়। অতএব, সাম্যবাদী বিশ্বের ওরা বোধহয় মনে করত যে, পশ্চিমা প্রচারের কারণে সবাই তাদের অমানুষ ভাবে। তাই এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করার জন্য বহিরাগতদের সঙ্গে ওরা একটু বেশিই ভাল ব্যবহার করত। প্লেনের ভেতরে সবাই ছিল নারী। একটিও পুরুষ কর্মচারী ছিল না। এদের প্রত্যেককেই দেখেছি ভীষণ উদগ্রীব থাকতে আমাদের ব্যাপারে। সকলকেই সম্বোধন করতো স্যার বা ম্যাডাম বলে। ঢাকা থেকে পূর্ব বার্লিন- এই ১৭ ঘণ্টার ফ্লাইটে যাত্রীদের ঘন ঘন খাবার কিংবা পানীয় পরিবেশন করা হতো। পথিমধ্যে মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করা হলো, Are you hungry, Sir? স্যার এর আগে অনেকবার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। আমাকে বললেন যে, এমন অভিজ্ঞতা তাঁর জীবনে কখনও ঘটেনি। যা হোক, উত্তম পানীয় এবং খাবারে ভারাক্রান্ত হয়ে আমরা তাসখন্দ বিমানবন্দরে নামলাম। এখানে যাত্রা বিরতি দেড় ঘণ্টার। তাসখন্দে বিমানবন্দরের মূল ভবনটি বেশ পুরনো স্থাপত্যের নিদর্শন বলা যেতে পারে। ভেতরে ঢুকতেই গোল, চওড়া স্তম্ভের ওপরে উঁচু ছাদওয়ালা এই ভবন পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি স্তম্ভের পাশেই একজন করে সাদা পোশাক পরা পরিচারিকা দাঁড়িয়ে ছিল। এরাও উত্তম স্বাস্থ্যের অধিকারী। অতএব, বেঁটে খাটো স্তম্ভের মতোই মনে হচ্ছিল। এই বিমানবন্দরের রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করেই আমি আর স্যার একটা চারকোণা টেবিলে স্থান করে নিলাম। বসার সঙ্গে সঙ্গেই বলা নেই কওয়া নেই, এক পরিচারিকা আমাদের টেবিলের ওপরে এনে রাখল দুটো ডিশ ভর্তি প্রচুর সসেজ, মাখন এবং ফল। এর আগে ইন্টারফ্লুগের বিমানে এত খেয়েছি যে, খাবার ইচ্ছে আর ছিল না। অতএব, ফলের রস খেয়েই আমরা আবার বিমানে ওঠার জন্য তৈরি হলাম। শোয়েনেফেল্ড পূর্ব বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ এর অন্তর্গত একটি অপেক্ষাকৃত ছোট বিমানবন্দর। এই বিমানবন্দরে বিকেল ৫টা নাগাদ আমাদের ইন্টারফ্লুগের ফ্লাইটটি অবতরণ করল। এখানে আজেকের আধুনিক বিমানবন্দরগুলোর মতো কোন বোর্ডিং ব্রিজ ছিল না। শোয়েনেফেল্ড দেখতে অনেকটা আমাদের যশোর বিমানবন্দরের মতো। প্লেন থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ইমিগ্রেশন এবং কাস্টম্স হয়ে বেরিয়ে আসতেই দেখলাম এক সুদর্শন নারী একটি প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাতে আমাদের নাম লেখা। আমরা এগিয়ে যেতেই সহাস্যে আমাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি এক বিশাল শক্ত ওজনদার স্যুটকেস হাতে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। স্যুটকেসটা মেঝের ওপরে রাখতেই ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। এই স্যুটকেসে কোন চাকা ছিল না এবং সেই যাত্রায় আমাকে বড্ড ভুগিয়েছিল। কারেন্ রয়েডার, সেই সুন্দরী রমণী, ছিলেন আমাদের দোভাষী, যতদিন আমরা পূর্ব জার্মানির সরকারের আতিথ্যে ছিলাম। কারেন সঙ্গে করে একটি মাইক্রোবাস নিয়ে এসেছিলেন। আমরা সবাই তাতে উঠে বসলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। কারেন্ জার্মান ভাষায় ইংরেজী বলতো। পাঠক, আপনারা হাসবেন না। আমরা বাঙালীরাই যে কেবল বাংলা ভাষায় ইংরেজী বলি, তা নয়। বিশ্বের বহু ভিন্ন ভাষার মানুষই ইংরেজী ভাষাটাকে রপ্ত করে তার নিজের ভাষায়। যেমন আমরা বাংলা ভাষায় ইংরেজী বাক্যটিকে নিজের মনে গঠন করি, তারপর সেটি আমাদের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ‘আমি এখন যাব’ হতেই পারে ‘I shall nwo go’। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমরা সবাই একইভাবে অনুবাদ করে ভিন্ন ভাষায় কথা বলি। আমি লক্ষ্য করেছি, যদি একজন জার্মানকে বলতে হয় ‘সেখানে তোমার দেখা হবে মন্ত্রীর সঙ্গে’ তারা বলতেই পারে ‘There is possibility of meeting the Minister there।’ হবে, করবে, যাবে এসব শব্দগুলোর সামনে ওরা possibility ব্যবহার করবেই। যাক্ গে। শোয়েনেফেল্ড থেকে পূর্ব বার্লিনের মাঝখানে পৌঁছুতে আমাদের প্রায় এক ঘণ্টার ওপরে লেগেছিল। এই গোটা সময়টাই কারেন্ রয়েডার কথায় কথায় ভরিয়ে রেখেছিল। অবশেষে বার্লিনের আলেক্জান্ডার প্লাৎজ-এ অবস্থিত ইন্টারহোটেল স্টাড বার্লিনের সামনে গিয়ে গাড়ি থামল। আমরা নামলাম। হোটেল লবিতে ঢুকে দেখি এলাহী কান্ড। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লোক সমাগম ঘটেছে বার্লিনে, বার্লিন উৎসব উপলক্ষে। সমস্ত তথ্য বিশাল এক খাতার মধ্যে টুকে নিয়ে আমাদের রুম বরাদ্দ করতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। তারপর আমাদের ঘরের চাবি দেয়া হলো। আমি ১৩ তলায় আর মুস্তাফা নরূউল ইসলাম স্যার ১১ তলায়। কারেন্ এতক্ষণ চুপচাপ দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। এবারে হাসিমুখে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো এবং বলল কালকের প্রোগ্রাম সম্বন্ধে তোমাদের আমার কিছু বলার আছে। আমি বললাম বলো। ও বলল, নাহ, তোমরা মালপত্র নিজেদের ঘরে রেখে ফ্রেশ হয়ে লবিতে চলে এসো, তখন কথা হবে। একটু বিরক্তই হলাম। এত লম্বা ফ্লাইটের পরে বড় ক্লান্ত লাগছিল। ভাবছিলাম ঘরে ঢুকেই সোজা শুয়ে পড়ব। সেটা আর কপালে নেই। অতএব!
×