ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ ফ্লোর

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ৩ মে ২০১৯

গল্প ॥ ফ্লোর

বারো নম্বর আউটপুট টেবিল। এখান থেকে আট নম্বর আউটপুট টেবিলের সামনের পিলারে ঝোলানো দেয়াল ঘড়িটিকে ঠিক বুঝতে পারা যায় না। আছরের আজান হয়ে গেছে। কামাল মোল্লা নামাজ শেষে আবারও তার কলার জয়েন মেশিনে কাজ শুরু করেছে- এতটুকু লক্ষ্য করে সময়কে আন্দাজ করার চেষ্টা করল পলাশ। সে হিসেবে এখন বড়জোর সোয়া চারটা। লাভ কী? দশটা তো কমন ব্যাপার। রাত বারোটাও হতে পারে। অবসপ্রায় পা দুটির একটি পা তার সামনের বক্সের কোনায় তুলে দিয়ে সে খানিকটা আরাম পেল। কিন্তু হাঁটুটি উঠে আসছে তার তলপেটেরও ওপরে। ব্যাপারটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকল পলাশের নিজের কাছেই। তাই আস্তে করে তার পা খানা নামিয়ে আগের জায়গায় রাখল। তার পায়ের নিচে চেপ্টা একটা বালিশ। বালিশটা তার যৌবনে হয়ত এমন ছিল না। রেলের চাকায় চেপ্টা কয়েনের মতো আজ বালিশটাও চেপ্টা হয়ে গেছে। পলাশের ডান পাশে দাঁড়িয়ে শার্টের ইনসাইড চেক করছে জোসনা। তার পায়ের নিচের বালিশটা পলাশের বালিশটার থেকে কম চেপ্টা। জোসনার বালিশটার বয়স খুব বেশি নয়। সময়ের চাপে সেটাও হয়ত পলাশের বালিশটার মতোই চেপ্টা হয়ে যাবে। পলাশের তুলনাতে জোসনা খানিকটা খাটোখুটো সাইজের হওয়ায় সে অনায়াসে বক্সের কোনায় পা তুলে কাজ করতে পারে। জোসনা চিন্তা-ভাবনায় একমুখী হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে। বয়স ছাব্বিশ অথবা আটাশ অথবা আরও এক বছর বেশি। গায়ের রং এখানে দেখে যতটা ফর্সা মনে হয় আসলে অতখানি উজ্জ্বল নয়। এখানকার বন্দীদশা এবং সে সঙ্গে নিরবছিন্ন সাদা বাল্বের আলো তার গায়ের রঙে এ পরিবর্তন ঘটিয়েছে। কথাবার্তা কিংবা পোশাক-আশাকে দুটোতেই সে খুব সাধারণ। এর মধ্যে তার দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গেও ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। দ্বিতীয় স্বামীর ঘর বেশিদিন টেকেনি। আগের ঘরে একটা মেয়ে আছে। তাই যতকিছুই হোক, সব সহ্য করে- ওখানেই পড়ে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। শেষমেশ মেয়েটাকে তার মায়ের কাছে রেখে- সে এখানে চলে আসে। আগে থেকেই তাদের গ্রামের তিনজন মেয়ে এখানে ছিল। তাদের চেষ্টা-তদ্বিরে এখানে তার কাজটা মিলেছে। এখানকার অসহ্য পীড়াদায়ক শুরুর সেই দিনগুলোতে সে এই তিনজনের সঙ্গে আরও একজনকে ভরসা করেছিল। নিজেকে কিছুটা হলেও ভারমুক্ত রাখা যাবে- এই আশায় জোসনা দ্বিতীয়বার নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করেছিল। যদিও নিয়মিত সকাল আট থেকে রাত দশ পর্যন্ত ডিউটি করে, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন বলতে তাদের তেমন কিছুই থাকত না। অধিকাংশ শুক্রবারে তাদের ডিউটি থাকত। কোনটি ফাঁকা থাকলে- বৃহস্পতিবার রাতে থাকত নাইট ডিউটি মানে রাত তিনটা পর্যন্ত। এছাড়াও তাদের স্যালারির দিনে তার বিশ্বাসের লোকটি হয়ে উঠতে লাগল অচেনা-অপরিচিত। অল্প ক’দিনের মধ্যেই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল- জোসনার বুকে গড়া বিশ্বাসের মন্দির। তারপর থেকে জোসনার একটাই পরিচয়, সে এই শার্ট ফ্যাক্টরির একজন কোয়ালিটি। আর প্রত্যেকটা শার্টের সর্বোচ্চ কোয়ালিটি নিশ্চিত করায় তার বর্তমান ধ্যান-জ্ঞান। পলাশ অনেক বডি জমে গেল যে, চালু চেক দেন- নইলে কন্ট্রোলার আসলে বাঁশ দিবেনি। সাইড সিয়েমে সুতা যেন যাই না, দেখেন। অডিট টেবিল থাইকি সাথী বস আইছিল। হাফস্টিজের কথা কইয়া গ্যাছে। বাটনের হাফ স্টিজ দেইখেন। জোসনার কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই আউটপুট সেকশনের শেষ মাথায় ভীষণ হৈচৈ- ফ্লোর ইনচার্জের গলা। পলাশের লাইনের আউটপুট সুপারভাইজারকে বলছে, এই মহিলা, কি যে করতাছে, হামার বুঝেই আসতাছে না। এত জোরের কাম কি মহিলাক দি হয় নাকি? মেশিন চালাচ্ছিল ওই ঠিক আসিল। এই মহিলা এই, এ ঘন্টাই টার্গেট না হলে, পিএম স্যার, এইবার আর বাঁশ দিয়ে থামবে নানি। গোটা তালগাছ দিবেনি। তালগাছ তুমার সহ্যি হলেও, ওয়া হামার লিয়ার জাইগা নাই খো। বস, আপনার বিচি ফাটা নাকি- দেখতে পাইতাছেন না? এইহানে ষাট পিচের বেশি ব্যাটন হই গেছে গা। আর ওকে বডি নামছে আরও ষাট পিস, তা হলেই তো হইছে, না। তা হলে তো হইয়া গেল। আর মহিলা, মহিলা কইরা গলা ফাটান ক্যান? আপনার এই ফ্লোরে আরও তো ছয়খান লাইন আছে। ওইগুলা কি ঘণ্টায় তিনশ’ দিতাছে নাকি? বহুত দেইখা এইখানে আইছি। বেশি চুদাবেন না বস...। ক্যান বাটন হয়ে গেলেই রিপোর্টারে মানে লইবো? ইনপুটে সমস্যা হইছিল। আমি পিএম স্যারকে দেখাইছি। পিএম স্যার বইলা গ্যাছে। এবার ফ্লোর ইনচার্জ অনেকটা শান্ত হয়ে লাইনের ইনপুট সেকশনের দিকে হাঁটতে লাগল। ফ্লোর ইনচার্জ নিজেও এই সুপারভাইজারকে বুঝতে পারে না। চুলের খোঁপার মধ্যে কলম গুঁজে রাখে। দুই ঠোঁটে চার কালারের লিপস্টিক দেয়। সকাল আটটায় তাকে দেখলে, তার বয়স কেউই তেইশ-চব্বিশের বেশি বলার সাহস করবে না। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বয়সও যেন বাড়তে থাকে। দিন ফুরাতে ফুরাতে তার বয়সকে আড়াল করে রাখা প্রসাধনীগুলো হয়ে যায় সম্পূর্ণ অকেজো। তবে পিএম স্যারের সঙ্গে এই সুপারভাইজারের কোথাও বিশেষ একটা সম্পর্ক আছে- এই আপাত গোপন কথাটি- এ ফ্লোরের কম-বেশি সবাই জানে। এটা তিনতলার ফ্লোর। এর ওপরে আরও চারতলা আছে। সব পদ মিলিয়ে কম করে হলেও রোজ এখানে হাজার-বারোশো লোকের চলাচল করে। কিন্তু ফ্লোর ইনচার্জ আর সুপারভাইজারের মধ্যে কিছুক্ষণ যে কথাগুলো হলো, মনে হচ্ছে সেগুলো কেউই শুনেনি। হয়ত তাদের পাশের জনকে অবস্থাগত কারণে শুনতে হয়েছে। কিন্তু মন দিয়ে শোনেনি। এখানে একজনকে বলা কথাতে অন্য কেউ কান দেয় না। এমন কি যাকে বলা হয়, তার মাথাতেও সে কথাগুলো খুব বেশিক্ষণ থাকে না। কোনমতে কথকের চোখের সামনে থেকে মুখটা একবার ঘুুুরিয়ে নিতে পারলেই হয়েছে। বেমালুম সব ভুলে যায়। এ রকম ঝাগড়াঝাটি- এখানে লাইনে চালিত অন্যান্য মেশিনের শব্দের মতোই গণ্য করে সবাই। নতুন যারা আসে- এ রকম ঘটনা দেখলে- হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তবে টিকে থাকতে পারলে আর তাকায় না। এ রকম ঘটনাগুলোতে কারও কান জোড়া অবাক হয়ে ওঠা কিংবা চোখ জোড়ার সজল চাহনি- তার অপক্বতার প্রমাণ দেয়। জোসনা খেকিয়ে উঠে বলল, পলাশ ওইসব দেখি কাম নাই, নিজের কামে মন লাগান। এইডা কিয়ামতের মাঠ- বুঝলেন। এইহানে কেউই কারোটা দেহে না। চালু-চালু চেক দেন। আমি ফিনিশিং থাইকা আসি। সরেন আমাকে বারাইতে দেন দেখি... এই কথাগুলো বলতে বলতেই জোসনা বেরিয়ে ফিনিশিংয়ে গেল। জোসনার টেবিল প্রায় খালি, তিন-চারটি শার্ট পড়ে আছে। এটা ব্যাপার না। কিন্তু পলাশ কিছুতেই তার টেবিলটাকে তার আয়ত্তে আনতে পারছে না। ইনসাইড চেক করা শার্টগুলো তার টেবিলে জমা হচ্ছে। তাকে চেক দিতে হচ্ছে সেই শার্টগুলোর টপসাইড। কিন্তু টপসাইড চেক করে সে কভার করতে পারছে না। জোসনা যেন ইনসাইড চেক না করেই সোজা বাটন মেশিন থেকে শার্টগুলো তুলে ছুড়ে দিচ্ছে তার টেবিলে। তবু সবখান থেকেই আসছে টপসাইডের অলটার। ইনসাইডে যেন অন্য লাইনের কাজ। অফিস টাইম ঘুরে দু-একটা ইনসাইডের অলটার পাওয়া যাচ্ছে। পলাশ যত নিখুঁত চেক করতে যাচ্ছে- তত পাহাড় জমে যাচ্ছে তার টেবিলে। এই জমার পাহাড়- চুষে নিচ্ছে এখানে পলাশের টিকে থাকার সাহস। নতুন নতুন কয়দিন তাকে কেউই কিছু বলেনি। তবে আজ এখানে তার চাকরির বয়স সাতাশ দিন। ধীরে ধীরে সবাই তাকে কথা শোনাতে শুরু করেছে। তাদের দাবি, যত নতুন লোকই হোক, পনেরো-বিশ দিনের পর আর কেউ নতুন থাকে না। এ ক’দিনেই কাজ বুঝে যায়। এই বছরের আর একটা দিন আছে। তা হলেই জানুয়ারি মাস। কিন্তু পলাশদের মাথার ওপর সমানে ফ্যান ঘুরছে। যে ফ্যানগুলোর একটারও রেগুলেটর নেই। সুইচ চাপা মাত্র ডাইরেট ঘোরা শুরু করে। ফ্যানের বাতাসও ভাল। তবুও কখনও তাদের শরীর থেকে ঘামা ঘামা ওই ভাবটি যায় না। জোসনা অনেকক্ষণ থেকে নেই। এই সুযোগে পলাশ তার নিজের টেবিলটা অনেকটা ফাঁকা করতে পেরেছে। বাটন মেশিনের পাশে দুজন সুতা কাটা হেলপার। বাটন লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে তারা ছো মেরে শার্টগুলো হাতে তুলে নিচ্ছে। সুতা কেটে জমা করছে জোসনার টেবিলে। জোসনা থাকলে তারা কাজ জমাতে পারে না। কিন্তু সে টেবিলে নেই। এ কারণে পলাশের টেবিলের মতো জোসনার টেবিলেও অনেকগুলো শার্ট তারা দুজনে জমিয়ে ফেলেছে। এই পলাশ, অনেকখানি দূর থেকে পলাশের কন্টোলারের হাঁক। সে তার টেবিলের বাইরে বের হতে যাচ্ছিল। ততক্ষণে কন্ট্রোলার নিজেই তার টেবিলের সামনে এসে হাজির। লোকটি ছয় ফুটের ওপরে লম্বা। আর ফ্লোরের মধ্যে সে হাঁটেও খুব জোরে জোরে। এ ব্যাপারে প্রাডাক্টশন সেক্টরে তার একটা সুনাম আছে। পলাশের মুখ থেকে কোন শব্দ বেরুনোর আগেই কন্ট্রোলারের হাতে থাকা পাঁচটা শার্ট সে ছুড়ে মারল পলাশের টেবিলের ওপর। এই তোর, কপালে কি চোখ নাই, না কোছাতে ধন নাই। ধড়ের দিক তো কম না। কি ধোন চেক দিচ্ছিসরে... মাদার চোদ। এই বার বার বলা হচ্ছে, হাফ স্টিজ আর সাইট সিয়েমে সুতা ভাল করি দেখ। তোর লাগি আমাক অডিট টেবিলে কথা শোনা লাগবে ক্যান রে মাদার চোদ। সুতা আসতাছে এইহানে আটকা দেখ, আমি হেলপারের পাছাত থাকি সুতা টানি বার করছি। আর যেন এক পিস বডিও অডিট টেবিলে না যাই। আর সাইট সিয়েম রিচেক দিয়ে আই, এই ঘণ্টার মাল ফেল দিছে। মাথা নিচু করে পলাশ কেবলই কথাগুলো শুনছিল। এখানে এটাই নিয়ম। এর মধ্যে ফিনিশিংয়ের অলটারগুলো লাইনের মধ্যে যার যার মেশিনে ভাগ করে দিয়ে- জোসনাও তাদের টেবিলে এসে দাঁড়াল। কন্ট্রোলার তার সামনের দিকে পা বাড়িয়েছে- এমন সময় জোসনা বলে উঠল, বস, ফিনিশিংয়ের অলটার আনা, অডিটের রিচেক, রিপোর্ট করা আর রেগুলার বডি চেক তো আছেই- সব মিলাইয়া আমার পায়জামা তো আমার পাছায় থাকতাছে না বস, খুইলা জাইতাছে। আমি এত পারতাছি না। আপনি পলাশরে বদলাইয়া দেন। হে তো এক্কেবারে নতুন। আর স্লো। এ এত রেগুলার বডি চেক দিয়েই ফুরাইতে পারে না। কন্ট্রোলার এবারের ধাক্কায় একটা শ্বাস ভেতরের দিকে টেনে, বাটন মেশিনে ঝোলানো রিপোর্ট কার্ডটি হাতে নিল। মাগরিবের নামাজ শেষ হয়ে গেছে। এ ফ্লোরের যারা নিয়মিত নামাজে যায়। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল রিপোর্টার একজন- নামাজ শেষে উজ্জ্বল আউটপুট টেবিলের ওকে বডিগুলো গুনে গুনে নামাচ্ছে। নামাজের কারণে এ ঘণ্টার কয়েক মিনিট সময় চলে গেছে। তাই সে বেশ তাড়াহুড়ো করছে। উজ্জ্বল নামাজের আগে এক বান্ডেল নামিয়ে গেছে। আর উজ্জ্বলের আগে রিপোর্টার রাজু নামিয়েছে আরও এক বান্ডেল। শার্টের কলারগুলো সাদা চুলের ব্যাংক ক্যাশিয়ারের দক্ষতায় গুনে নিল উজ্জ্বল। শেষ লাইন। তাই দম ছেড়ে সে নিজেকে কিছুটা হাল্কা করে নিল এবং টানা সুরে বলে উঠল, পলাশ ভাই চালু চেক দেন গো, আরও বিশ পিচ লাগতো। আগের ঘণ্টার ডিউ তো আছেই। ও আপনার টেবিলে তো মাল জমা নাই। আপনারে সুপারভাইজার কই? এই লাইনের সুপারভাইজার, লাইন চিপ- কেউই মরদ না। প্রডাক্টশন দিতে মরদ মানুষ দরকার। তার কথা শুনলেও পলাশের চোখ ও হাত থেমে নেই। সে কোন উত্তর দিচ্ছে না। উজ্জ্বল এবার পলাশের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, বক্সের মধ্যে ওগুলি কী রাখতাছেন ভাই, কী সমস্যা? উজ্জ্বলের এ প্রশ্নটি সাধারণ- যেখানে অভিযোগের কোন সুর নেই। উত্তর না পেয়ে উজ্জ্বল আবারও প্রশ্ন করলো, ভাই বক্সের মধ্যে ওগুলো কী রাখতাছেন? স্থির গলাতে বললো, ওকে বডি তবে সাইট সিয়েমে সুতা আছে, টাকও উঠানো নাই। তাহলে সাইট সিয়েমের হেলপারকে ডাকেন, আর বাঁশ দেন। বাঁশ খাবেন আর বাঁশ দেবেন। চালু চেক দেন ভাই- বলে সে এগারো নম্বর লাইনের দিকে হাঁটতে লাগল। সাধনা, এই সাধনা- পলাশের হাঁক। সাধনা, সাইট সিয়েমের হেলপার। সে শুনতেই পাচ্ছে না। তারপর হেমের হেলপার হেলেনাকে পলাশ ডেকে সাধনার ব্যাপারে ইশারা দিল। কন্ট্রোলার ও জোসনার কাছে ঘণ্টা দুয়েক আগে পলাশ যেভাবে অপমান-অপদস্থ হয়েছে। সেগুলো এখন সুদে-মূলে তার ফেরত দেয়ার সুযোগ। আটটা অলটার এখন পলাশের হাতে জমা- যার মধ্যে পাঁচটাই সাইট সিয়েমের। বাকিগুলোর একটা মেকের আর দুইটা ইনপুটের অলটার। সাধনা জড়সড় হয়ে পলাশের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। সাধনার বয়স একেবারে কম, তবে নিশ্চিত কোন না কোনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত সে আঘাতের চিহ্ন তার চোখেমুখে স্পষ্টত। যেই চিহ্নগুলো লাল রঙের যান্ত্রিক চোখে স্ক্যান হয় না। শুধু সাধনা নয় এ লাইনের সবারই পেছনের একটা করে গল্প আছে। পলাশ সাইট সিয়েমের অলটারগুলো বক্স থেকে তুলে তার টেবিলের ওপর দিলে সাধনা কাঁপা কাঁপা হাতে ধরল। অলটারগুলো হাতে ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। এখন সাধনার হৃৎপি-ের গতি কত- তা পরিমাপের কোন যন্ত্র হয়ত পৃথিবীতে আজও আবিষ্কার হয়নি। তবে পলাশ তাকে তেমন কিছুই বলল না। ছোট করে শুধু বলল, যাও, কিন্তু একটু দেখো। এগুলোর কারণে অনেক কথা শোনা লাগে। সাধনাকে বলার মতোন অনেক কিছুই ছিল। বুকের ভেতরের জ্বলনটা এখনও কমেনি। যে জ্বলনের অনেকখানি তার নাক আর চোখ দিয়ে কিছুক্ষণ আগে গড়িয়েছে। যার প্রভাবে তার পকেটের রুমালটি হয়ে উঠেছে স্যাঁতসেঁতে। কিন্তু সেই জ্বলনের তাপ তার পাশের জনকেও লাগেনি। তাপ লাগলে তো মানুষ ঘাড় ঘুরিয়ে অন্তত দেখে নেয়। তাও দেখেনি। দেখলে না হয় বোঝা যেত পলাশ পোড়ার তাপ তাকেও কিছুটা পুড়িয়েছে। প্রচ- খরতাপে ঝরা চোখের জল এখানে খুবই সাধারণ একটা ব্যাপার। এসব এখানে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে চলে। এই বারো নম্বরের কোয়ালিটি- কথার এই অংশটুকু পলাশ তার নিজের কানে এটুকু শুনতে পেল। এর আগেও হয়ত আরও দু-একরার তাকে ডেকেছে। সে শুনতে পায়নি। ফ্লোরে কেউ তার নিচের পদের কাউকে ডাকার সাধারণ অর্থ- যার নাম ধরে ডাকা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে নিশ্চয় কোন অভিযোগ রয়েছে। আর মাইকে ডাকলে- বুঝে নিতে হবে- একেবারে নিশ্চিত-নিখাত অভিযোগ। মেশিন চালুর পর- কেউ কাউকে এমনি এমনি ডাকে না। পলাশ বুঝতে পারল, ডাকটা ফিনিশিংয়ের দিক থেকে আসছে। চোখ জোড়া ফিনিশিংয়ের দিকে ঘুরাতেই- সুফিয়ার উত্তোলিত একখানা হাত তার চোখে ধরা পড়ল। নিশ্চয় গুরুতর কোন অলটার। তা ছাড়া সুফিয়া ডাকার কথা নয়। তবে এ রকম অলটারের কারণে ফিনিশিংয়ের অন্যান্য কোয়ালিটিরা, লাইনের কোয়ালিটিদের ওপর যেমন চড়াও হয়। এ পলাশকে সে রকম কিছুই বলে না- শুধু বলে বস দেখলে রক্ষা হবে নান। সাবধান। শুরু থেকেই মেয়েটি আজ পর্যন্ত পলাশের সঙ্গে কোন ধরনের খারাপ ব্যবহার করেনি। বরং পলাশের লাইনের মালের জন্য তাকে জরিমানা পর্যন্ত দিতে হয়েছে। তবু পলাশ তা জেনেছে ফিনিশিংয়ের অন্য একজন কোয়ালিটির কাছ থেকে। পলাশের টেবিল থেকে তার মুখখানি যতটুকু দেখা যায়- তা অবিকল হলদে রঙের নিখাত ধান শিষের মতো। যে ধানশিষে ভরে ওঠে কৃষকের বুক। তবে তার নাকের ডগায় বড় বেমানান একটা নাকফুল। যার মানে পলাশ বুঝতে পারে। কিন্তু বিষয়টা মানতে তার বড়ই কষ্ট হয়। তবুও সুফিয়ার মুখের দিকে তাকালে পলাশের নিজেকে একটু রিফ্রিশ লাগে। সুফিয়ার প্রশ্ন, এতখানি জোয়ান মরদ, কি দ্যাখেন? বডিতে একটাও বাটন নাই, যান লাগায় নেন। পলাশ ধাপ তুলতেই আবারও ডাক দিল, এই মিয়া অলটার নেই, নিয়ে যান। মরদ খালি, ধড়। পলাশ তার বাঁ হাতের আঙ্গুলের মাঝখানে সুফিয়ার দেয়া অলটার বডিটাকে আলাদাভাবে রেখে- তার বাঁ হাতে বাটনের অলটারগুলো আর ডান হাতে সুইংয়ের অলটারগুলো বুকের সঙ্গে জড়িয়ে তার টেবিলে ফিরে এলো। টেবিলে অলটারগুলো রাখতেই কন্ট্রোলারের মোটা গলার প্রশ্ন- এত অলটার গেল, তোরা দু’জন এখানে কি ধন চেক দিছিস? এক কাজ কর সব বডি ফিনিশিংয়ে পাঠায় দে- ওরা চেক দিক আর তোরা অলটার নিয়ে আয় আর দিয়ে আয়। সব বলদ কত্তিকার। আজ সুইং দশটা পর্যন্ত। ফিনিশিং বারোটা। একটা সিদ্ধ ডিম সঙ্গে একটা ডাল-পুরি খেয়ে পলাশ টয়লেটের দিকে গেল। টয়লেটের দরজায় পলাশের আগে থেকে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে। একটা বড় রুমের মধ্যে মুখোমুখি দরজা করা ছয়টি করে মোট বারোটি ঘর। তবে এখানে স্যান্ডেলের সংখ্যা চৌদ্দ জোড়া। তার পরও পলাশেরা দু’জন বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে যারা আসে- তাদের অধিকাংশই আসে মোবাইলে কথা বলার জন্য। ফ্যাক্টরির নিয়মানুসারে লেবারেরা কেউ মোবাইল আনতে পারবে না। তবে এ নিয়ম বলতে গেলে কেউই মানে না। তারা মোবাইল আনে এবং দরকার হলে টয়লেটে এসে কথা বলে। মোবাইল ফোনের পরিবর্তে সবার বাসায় জরুরী হেল্পলাইন নম্বরটি দিতে বলা হয়Ñ কিন্তু কেউই সে কথা শোনে না। আর এক-দেড় ঘণ্টা আছে, তা হলেই আজকের মতো শেষ। তাই এ মুহূর্তে পলাশ খুব সতর্ক হয়ে কাজ করছেÑ শেষ ঘণটায় গালি খেলে রাতটাই শেষ। যদিও রাত বলতে তাদের তেমন কিছুই নেই। রাতের নামে তাদের প্রাপ্ত বিশ্রামটুকু, তাদের বুকের নিশ্বাসকে আসা-যাওয়ার অনুমতি দেয় মাত্র। এর বেশি কিছু নয়। পলাশের ভয়ই তাকে জাপটে ধরল। মাইকে বলা হচ্ছে- বারো নম্বর লাইনের কন্ট্রোলার ও আউটপুট কোয়ালিটি তাড়াতাড়ি জিএম স্যারের রুমে আসো। সাধারণত জিএম স্যারের রুমে কোয়ালিটিদের তো ডাকা হয় না। এই মাইকের মুখের কাছে কান লাগিয়ে থাকে কন্ট্রোলার, ফ্লোর ইনচার্জ অথবা কোয়ালিটি ম্যানেজার। মাইকটিকে ধড়ের দিক থেকে দেখলে- খুব একটা জিন্দা নয়। খাটোখুটো-গুটমুটে সাইজের। কিন্তু তার মুখ থেকে যার নামটি নির্গত হয়- ওই ব্যক্তির কানে ধরে যায় বিষজ্বালা। জিএম স্যারের রুমে ডেকে এদের যে ভাষায় কথা বলা হয়- তাই কয়েকগুণ শক্তি সঞ্চয় করে আঘাত হানে ফ্লোরে। লাইনের ইনপুটের দিকে কোথাও কন্ট্রোলার ছিল- দ্রুত পায়ে টেবিলের সামনে এসে বলল, এই জোসনা-পলাশ আইডি কার্ড লাগা, চল। বারো নম্বর লাইনের আউটপুট সুপারভাইজার, লাইনচিপ, ফ্লোর ইনচার্জ, কোয়ালিটি ম্যানেজার, পিএম স্যার- আগে থেকেই বসে ছিল। কোয়ালিটি ম্যানেজার বলতে শুরু করল- তোমাদের গত তিন দিন থেকে বলা হচ্ছে, সলসের ২১১০ স্টাইলের কোন বডি কারও টেবিলে যেন পড়ে না থাকে। এরপর মাইকেও এ কথা বার বার বলা হয়েছে। তার পরও এই দুই পিস বডি কেন তোমাদের টেবিলে পাওয়া গেল? সকালে এ স্টাইলের মালের শিপমেন্ট চলে গেছে। পলাশদের ক›েশ্রালার কি যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু জোসনার বলার গতি কন্ট্রোলারের কথাকে অতিক্রম করায় সে তার কথা আটকে রাখার চেষ্টা করল। জোসনার প্রশ্ন- স্যার, এই বডি দুটো আমাদের টেবিলে ছিল না। আর যদি থাকে স্যার, তাহলে যে পাইছে সে আমাদের না দেখাইয়া কিংবা আমাদের কন্ট্রোলার বসকে না জানাইয়া সোজা এখানে কেন এনেছে স্যার? এই বডি আমাদের টেবিলে ছিল না স্যার, কারণ কন্ট্রোলার বস রোজ ছুটির পর আমাদের টেবিল চেক করি, তারপরে আমাদের হাজিরা কার্ড দেয়। জোসনার কথাতে কন্ট্রোলারের বুক ফুলে উঠল। জোসনার এই কথাগুলো কন্ট্রোলারকে হয়ত কোয়ালিটি ইনচার্জ হয়ে ওঠার রাস্তাটুকু অনেকখানি এগিয়ে দেবে। মিনিট দুয়েক সবাই চুপচাপ থেকে জিএম স্যার বলল, আচ্ছা তোমরা যাও। কন্ট্রোলার ছাড়াও কোয়ালিটি ইনচার্জ, কোয়ালিটি ম্যানেজার সবাই জোসনার ওপর খুশি। সে কোয়ালিটি সেকশনের নাম রেখেছে। শত্রুপক্ষের ছোড়া গ্রেনেডে সে খতম করেছে, শত্রু শিবির। ফ্লোরে ফেরার পর সুযোগ মতো সবাই জিজ্ঞাসা করতে থাকল- কি ব্যাপার, কি বলল...। কিছুক্ষণ পরই মাইকে ঘোষণা এলো, সলসের ২১১০ স্টাইলের দুটি বডি বারো নম্বর লাইনের সুপারভাইজারের জিম্মায় পাওয়া গেছে- তার পাঁচ শ’ করে দুটি বডির জন্য এক হাজার টাকা জরিমানা করা হলো এবং সেই সঙ্গে সবাইকে সাবধান ও সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। কোয়ালিটি ও প্রডাক্টশনের এমন রাজনীতি শুরু থেকেই চলতে আছে। আর মেশিনে সেলাই হলে এ ধরনের রাজনীতি চলবেও। পলাশ কিছুতেই এসবের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। খোলা আকাশের রোদ-পানির কাছে সে কখনই পরাস্ত হয়নি। তবে এখানকার আরও দু’চারজন মানুষ যদি সুফিয়ার মতোন হত! পলাশ প্রতিদিনই কোন একটা ঘটনার পর ভাবে আজই শেষ- কোনমতে গেট পার হতে পারলে আর আসবে না। কিন্তু তাকে আসতেই হচ্ছে। রাণীক্ষেত ধরেছিল। রাতের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল- তার মামার উঠোনে তৈরি মুরগির খামার। তা-বের পর সচেতন থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি। সঙ্গে যেই দোকান থেকে তারা মুরগির বাচ্চা আর খাদ্য-ওষুধ নিয়েছিল। সেই দোকানের দেনার দায়ে তাকে রাতারাতি পালিয়ে আসতে হলোÑ এ ঢাকায়। পলাশ ঢাকাতে আসার পরেও কিছুদিন সচেতন ও সেই দোকানের লোকজন তাদের বাড়িতে আসত। তার বাবাকে ডেকে এটাসেটা বলত। ইদানীং আর আসে না। কারণ শোধ দেয়ার মতো কিছুই পলাশের বাবার কাছে নেই। জীবনভর তার সম্বল বলতে- ওই হাত দু’খানা। হাত দু’খানারও বয়স হয়েছে। তবু এখনও সে জমিতে নিড়ানি দেয়ার মতো হাল্কা পাতলা কাজগুলো করতে পারে। মেয়ে দুটি ছিল- বিয়ে হয়ে গেছে। তারা দু’জন লোক- কোনমতে দিন কেটে যায়। আর গ্রামের সবাই জানে, পলাশ নিরুদ্দেশ, তার কোন খবর নেই। সবার কাছে মুখ লুকিয়ে থাকার জন্য এখানকার থেকে ভাল জায়গা পলাশ আর পায়নি। তবে শেষ নিশ্বাসের মতোন এখনও তার বুকের ভেতর লুকিয়ে আছে এক চিলতে গ্রামীণ সবুজ। যেটুকুর হিসাব মেলাতে মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে। তারপর পুরনো নিয়মে ঠিক হয়ে যায় সবকিছু। মেশিন বন্ধের বেল বেজে উঠেছে। এখন সবাই গুছিয়ে নেবে নিজেদের কাজগুলো। ছুটির বেল বাজবে আরও পাঁচ মিনিট পর। প্রত্যেকে তখন কড়া চেকের মাধ্যমে অতিক্রম করে যাবে ফ্যাক্টরির মূল দরজা। আবারও তাদের ফিরতে হবে- আগামীকাল সকাল সাতটা পঞ্চান্ন মিনিটের আগে।
×