ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হিমেল আহমেদ

রবীন্দ্রনাথের বিজয়া

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৩ মে ২০১৯

 রবীন্দ্রনাথের বিজয়া

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর জন্ম ১৮৯০ সালের ০৭ এপ্রিল। যিনি নিজেই ছিলেন একজন বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী, লেখিকা ও সাহিত্য সমালোচক। তাৎকালীন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলার কবি আর ভিক্টোরিয়া ছিলেন আর্জেন্টাইন এক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদিকা। বয়সেও ছিল তাদের বিরাট পার্থক্য! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩। আর ওকাম্পোর ৩৪। যেন আকাশ পাতালের ব্যবধান! পাঠকের মনে প্রশ্ন আসতেই পারে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমের উপাখ্যান তাহলে শুরু হলো কিভাবে? ১৯২৪ সালের কথা। সারা বিশ্বে ইতোমধ্যে গীতাঞ্জলি নিয়ে আলোড়ন। অনুবাদ হয় বিভিন্ন ভাষায়। ইংরেজী, স্প্যানিশ ও ফরাসি ভাষায়। রবি ঠাকুরকে অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ গীতাঞ্জলি লেখার জন্য সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয় ১৯১৩ সালে। যা বিশ্বে তুমুল হৈচৈ তোলে। বিশ্বজুড়ে পাঠক পিপাসা মেটাতে সক্ষম হয় গীতাঞ্জলি। কবি গুরু শুধু বাংলার কবি নন নিমেষেই হয়ে ওঠেন বিশ্বের কবি। গীতাঞ্জলির নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। দেশে বিদেশে তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন রবীন্দ্র ভক্ত! তাদেরই একজন ছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। যিনি পারদর্শী ছিলেন ভাষাজ্ঞানে। ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ যেন তার জীবনে শান্তির পরশ নিয়ে এসেছিল। কেননা তখন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাংসারিক জীবনে চলছিল টানাপোড়েন! ওকাম্পোর স্বামী লিপ্ত ছিলেন পরকীয়ায়! হতাশা আর দুঃখময় জীবনে গীতাঞ্জলি কবিতা ওকাম্পোকে স্বস্তি এনে দেয়। ওকাম্পো হয়ে ওঠেন রবীন্দ্র অনুরাগী। গল্প, কবিতা লেখা ও পড়ায় খুব আগ্রহ ছিল ওকাম্পোর। যে সাহিত্যিকের লেখা ভাল লাগত তার তিনি তাকে নিজ গৃহে নিমন্ত্রণ জানাতেন। ওকাম্পোর নিজের বাবার বাড়ি যেটা পরিবর্তীতে উত্তরাধিকার সূত্রে ওকাম্পোই পেয়েছিলেন। নাম রেখেছিলেন ভিলা ওকাম্পো! ওকাম্পোর এই বাসায় বিভিন্ন সময় আপ্যায়িত হয়ে এসেছিলেন ইগোর স্ত্রাভিনস্কি, গ্রাহাম গ্রীন, ফেড্রেরিকো গার্সিয়া লোরকা, আঁদ্রে ম্যালরাস, হর্হে লুইস বর্হেস, এ্যাদেলফো বিয় ক্যাসেরাস, আলবেয়ার কামু, কাইজারলিঙ, অক্টাভিয়ো পাজ, ইন্দিরা গান্ধীসহ মান্যগণ্য গুণীজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যগুণে আকৃষ্ট হয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছায় ব্যাকুল ছিলেন। তিনি যে রবি ঠাকুরের প্রেমে পরে গিয়েছিলেন সেটা বলাটা অত্যুক্তি হবে না! অনেকের মতে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন রবি ঠাকুরের শেষ বয়সের প্রেম! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা যান মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে। একে একে পিতা আর সন্তানদের মৃত্যুর পর সাহিত্যকেই বেছে নিয়ে ছিলেন বেঁচে থাকার সম্বল হিসেবে। রবি ঠাকুরের পারিবারিক অবস্থা সচ্ছল হওয়ায় কবি প্রায় বিদেশ ভ্রমণে বেড়ুতেন। আর নোবেল পাওয়ার পর কবির ডাক পরে বিশ্বজুরে। গীতাঞ্জলির নোবেল পাওয়ার প্রায় দশ বছরের মাথায় ওকাম্পো সাক্ষাত পান রবি ঠাকুরের। সেটা আবার কাকতালীয়ভাবে নতুবা সৌভাগ্যক্রমে! ১৯২৪ সালে দেশ পেরুর স্বাধীনতা দিবসে কবিতা আবৃতির প্রস্তাব দেয়া হয় কবিকে। পেরু যাওয়ার পথে হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। ফলে মাঝ রাস্তায় চিকিৎসা আর বিশ্রামের জন্য বাধ্য হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান নেন তিনি। মহাকবি, প্রাণপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওকাম্পোর নিজ দেশে এসেছেন এটি ছিল তার কাছে মহা আনন্দের বিষয়। ওকাম্পো ছুটে চলে আসেন রবি ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাত করতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে অনেকটা জোর করেই তাঁকে হোটেল থেকে তুলে নেন ওকাম্পো, থাকার বন্দোবস্ত করলেন তাঁর এক আত্মীয়ের বাসায় । যে বাড়িটির ছিল নাম ‘মিরালরিও’। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর অতিথি পূজায় মুগ্ধ হন কবি। তাই তো সাত দিন থাকার কথা ছিল অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওকাম্পোর অতিথি হয়ে ছিলেন প্রায় দুই মাসের অধিক সময়। কবিগুরুর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সহকারী লেনার্ড এলমহার্স্ট। রবীন্দ্রনাথ নিজেও হয়ত ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রেমে পড়েছিলেন বলে অনেকেই ধারণা করেন। তাই তিনি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে বিজয়া বলে ডাকতেন। রবি ঠাকুরের পছন্দ অনুযায়ী ওকাম্পো সাজিয়েছিলেন মিরালরিও বাসাটি। তবে ভিলা ওকাম্পো নামক তাৎকালীন তার বাবার বাড়িতেও সময় কাটত কবির। রবীন্দ্রনাথ রাতযাপন করতেন মিরালরিও বাড়িতে। আর প্রায় প্রতিদিন বিকেলে এখান থেকে যেতেন ভিলা ওকাম্পোয়, অবসর যাপন করতে। সেখানে বাগানে গল্পগুজব, চা-পান আর সাহিত্য আলোচনার পর আবার ফিরে আসতেন এখানে। ওকাম্পোর বাড়িতে বসেই কবিগুরু ৩০টির মতো কবিতা রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের পূরবী কাব্যগ্রন্থের বেশির ভাগ কবিতা আর্জেন্টিনা নিয়ে লেখা। গ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে। প্রথম সাক্ষাতেই যে রবীন্দ্রনাথের মন জয় করে নিয়েছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর লেখা সে সময়ের কবিতাগুলো পড়লে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওকাম্পোকে চিঠিতে লিখেছিলেন ‘তুমি জানো যে ভাস্বর সেই দিনগুলি আর তার কোমল শুশ্রƒষার স্মৃতিপুঞ্জ ধরা আছে আমার কবিতাগুচ্ছে, হয়ত আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা (পূরবী)। পলাতক স্মৃতিগুলো আজ কথায় বন্দী। তোমাকে নিশ্চিত বলতে পারি যে, এ কবিতা বেঁচে থাকবে অনেক দিন।’ রবি ঠাকুরের অতিথিসেবায় যেন ত্রুটি না হয় সে জন্য ওকাম্পো নিজের হাতের প্রিয় হীরার আংটি বিক্রি করে দেন। ওকাম্পোর বাসায় যেদিন কবিগুরু আসেন সেদিনই রচনা করছিলেন ‘পূরবী’র অন্তর্গত বিখ্যাত ‘বিদেশী ফুল’ কবিতাটি। তার পর অতিথি, আন্তর্হিতা, আশঙ্কার মতো প্রেমময় কবিতা লেখেন তিনি। যা কবি নিজেই পড়ে বিব্রত বোধ করতেন। কারণ এই কবিতা সমূহ মাত্রাতিরিক্ত রোমান্টিক ছিল! ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রোমান্টিসিজমে জড়িয়ে পড়েন কবি নিজেও! ওকাম্পোর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো কবি কখনও ভুলতে পারেননি। অনেকের ধারণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর প্রেমের উপন্যাস শেষের কবিতা তিনি নিজ জীবন থেকেই লিখেছেন। আর উপন্যাসের লাবণ্য চরিত্র ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। কবিগুরু কখনও এই কথাটির খোলাসা করেননি। তবে শেষের কবিতা উপন্যাস লিখতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন লাবণ্য তার খুব কাছের একজন! ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন আত্মনির্ভর, সাহসী আর স্বাধীনতাকামী নারী। যিনি পরবর্তীতে আর্জেন্টিনার নারী অধিকার রক্ষা আর বাস্তবায়নের অন্যতম নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে পরিচয় কবিগুরুকে নতুন এক রূপ দিয়ে ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল মহান এক চিত্রকর যা ওকাম্পোর উৎসাহের কারণে প্রকাশ পেয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রথম চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন ভিক্টোরিয়া। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ওকাম্পোর দেখা হয়েছিল মাত্র দুইবার; দ্বিতীয়বার ১৯৩০ সালে প্যারিসে। দ্বিতীয়বারও ওকাম্পো কবিগুরুর জন্য যথেষ্ট করেছিলেন। অনেক খেটে-খুটে প্যারিসে প্রখ্যাত ‘পিগাল গ্যালারিতে কবিগুরুর আঁকা ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর আর ওকাম্পোর সঙ্গে কবিগুরুর দেখা হয়নি। তারপর কবিগুরু অনেকবার ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিজ গৃহ শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানান। জানিনা কোন ক্ষোভে তিনি কবিগুরুর এই নিমন্ত্রণ কখনও গ্রহণ করতে চাননি! ভিক্টোরীয় ওকাম্পোর ভিলা ওকাম্পো বাড়িটি আজও আছে। স্মৃতি ও সংগ্রহশালা হিসেবে প্রতিদিন অনেকেই এই বাসায় আসেন। কবিগুরুর পাশাপাশি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি আছে, বই আছে। আছে সুর পত্রিকার পা-ুলিপি। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোও নিজে একজন লেখিকা ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একাধিক লেখা লিখেছেন তিনি। ওকাম্পোর নারীবাদীতার কারণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কবি গুরু নারীদের নিজস্ব গ-ির মধ্যে থাকা পছন্দ করতেন। কিন্তু ওকাম্পোর সান্নিধ্য পাওয়ার পর রবি ঠাকুর নারীদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। ওকাম্পো যতটা রবিপ্রেমী ছিলেন ততটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ওকাম্পোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বাংলার মানুষের প্রতি ছিল তীব্র মমতাবোধ। যা আমরা জানতে পেরেছিলাম ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর বয়স ছিল ৮১ বছর। বয়সের ভারে দুর্বল হয়ে গেলেও ওকাম্পো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানীদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংস গণহত্যার প্রতিবাদে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স এয়ারসে একটি মিছিলের আয়োজন করেছিলেন এবং মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। আমার বিশ্বাস কিংবদন্তি এই দুই ব্যক্তিত্বকে এই পৃথিবী শেষ প্রলয় পর্যন্ত মনে রাখবে। তাদের প্রতি রইল আমার অফুরান শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×