ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আব্দুর রাজ্জাক

সায়েন্স ফিকশন যুগে যুগে

প্রকাশিত: ০৯:৩০, ৩ মে ২০১৯

সায়েন্স ফিকশন যুগে যুগে

কল্পনা মানব মনের সহজাত প্রবৃত্তি। সভ্যতার অগ্রযাত্রা বিনির্র্মাণে যে সকল মনীষীর অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের কল্পনাও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মর্যাদা পেয়েছে। মূলত তাঁরা কল্পকাহিনীগুলো বিনোদনের জন্যে রচনা করলেও পরবর্তীতে তা সাহিত্যে বিচারে বিশ্বসাহিত্যে স্থান দখল করে আছে। এ সকল সাহিত্য সম্পদ বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে হয়ে উঠেছে সভ্যতার অমূল্য সম্পদ। যার সুফল উপভোগ করছে মানবজাতি। কল্পনা থেকে কল্পকাহিনী বা কল্পসাহিত্য (ইংরেজী : Speculative Fiction)। মানব সভ্যতা মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশের সময় যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের বিকাশ ঘটে তার অনিবার্য ফসল ছিল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। বর্তমান সময়ে এই বিষয়টিকে Science Fiction বলা হয়ে থাকে তবে এই সায়েন্স ফিকশন শব্দ জুটি ভিন্ন মাত্রা বহন করে। ১৮৫১ সালে সায়েন্স ফিকশন শব্দ জুটি ব্যবহার করেন সমালোচক উইলিয়াম উইলসন। তাঁর বইটির নাম ছিল ‘এ লিটল আর্নেস্ট বুক আপন এ গ্রেট ওল্ট সাবজেক্ট’। কল্পকাহিনীনির্ভর মুভি সায়েন্স ফিকশন শব্দ জুটি তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয়, অর্থবহ এবং কৌতূহলের বিষয়। আলোচ্য প্রবন্ধে সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানের বিকাশ, মানব সভ্যতার উৎকর্ষে কল্পবিজ্ঞানের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার প্রচেষ্টা থাকবে। কল্পসাহিত্য অথবা কল্পবিজ্ঞান কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ বর্গ, যেখানে বাস্তব জগতের সঙ্গে অসম্পর্কিত এক কল্পিত জগতের বর্ণনা দেয়া হয়। কল্পকাহিনীমূলক সাহিত্য বিশ^সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা যাতে ভবিষ্যৎ বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত আবিষ্কার, উদ্ভাবন এবং মানব সভ্যতাকে কেন্দ্র করে পটভূমি রচনা করা হয়। কল্পকাহিনী ধরনটিতে সাহিত্যের কোন কোন বিষয়গুলোকে স্থান দেয়া হবে তা নির্ধারণ করা বেশ দুঃসাধ্য ব্যাপার। এ কারণেই কল্পবিজ্ঞানের ব্যাপ্তি বা পরিসর ব্যাপক। সে হিসেবে এর উৎপত্তি, কোথায় হয়েছিল তা সঠিক বলা সম্ভব নয়। তবে কেউ কেউ মনে করেন সুপ্রাচীনকালের সুমেরীয় সভ্যতার মেসোপটেমীয় মহাকাব্য ‘গিলগামেশ’ (খ্রিস্টপূর্ব ২১০০) ছিল বিজ্ঞান কল্পকাহিনীমূলক রচনা বা কল্পসাহিত্যকর্ম। অনেকই এর বিরোধিতা করে বলেন বিজ্ঞান কল্পবিজ্ঞান লেখা হতে পারে কেবল প্রকৃত বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই। ১৬৩৪ সালে জ্যোর্তিবিদ জোহানেস কেপলার চন্দ্রাভিযান নিয়ে ‘সোমনিয়াম’ নামের একটি সায়েন্স ফিকশন লিখেন। আধুনিক বিজ্ঞানের স্রষ্টা হিসেবে পরিচিত বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস বেকন ১৬২৭ সালে লেখেন ‘দ্য লস্ট আটলান্টিস’ নামের সায়েন্স ফিকশনটি। ১৬৪৪ সালে ফ্র্যান্সিস চেনেলে প্রকাশ করেন ‘অলিকাস’। জ্যাকুইস গুটিননের সায়েন্স ফিকশমূলক বই ‘দ্য স্টোরি অব ফিউচার সেঞ্চুরি’। ইংরেজ কবি শেলির স্ত্রী ম্যারি উলস্টোনক্রফট শেলি (১৭৯৭-১৮৫১) রোমান্টিক এবং গথিক ধারার উপন্যাস রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন : অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ (১৮১৮) সালে প্রকাশিত হয়। তিনি সায়েন্স ফিকশনকে বিশ্বসাহিত্যের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত এ উপন্যাসকেও কল্পবিজ্ঞানের স্বার্থক কর্ম বলে মনে করা হয়। উপন্যাসের বিষয়বস্তু ছিল এক মৃত ব্যক্তির জীবিত হওয়ার কাল্পনিক কাহিনী। বিজ্ঞানের সাহায্যে এই মৃত ব্যক্তিকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে চায় কিন্তু মৃত ব্যক্তি হয়ে উঠল এক অতিমানবীয় দৈত্য। ‘স্পেকুলেটিভ ফিকশন’ শব্দটির স্রষ্টা মনে করা হয় রবার্ট এ হাইনলাইনকে। রবাট এ হাইনলাইন (১৯০৭-১৯৮৮) প্রখ্যাত মার্কিন লেখক। যার লেখার সাহিত্যে মান ও সংবেদনশীলতা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য নামক ঘরানাটি বিনির্মাণেও তাঁর অনেক ভূমিকা রয়েছে। ‘স্টারশিপ ট্রুপার্স’ তাঁর রচিত একটি বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। উপন্যাসটিতে ভবিষ্যতের পৃথিবী ও মহাকাশে মানবজাতির সঙ্গে দূর গ্রহের পতঙ্গ প্রজাতির সঙ্গে সংঘর্ষের কথা বলা হয়েছে। উপন্যাসটি ১৯৬০ সালে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী পুরস্কার ‘হুগো এ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে। মূলত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয় তিনি দক্ষতার পরিচয় দেন। এক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য ছিল আকাশচুম্বী। আইজাক আসিমভ (১৯২০-১৯৯২) রাশিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক। তিনি দৃঢ় বিশ্বাস করতেন, ‘সত্য বিজ্ঞান কথাসাহিত্য প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্বহীন হতে পারে না যতক্ষণ না মানুষ বিজ্ঞানের যুক্তিবাদীতা বোঝে এবং তাদের গল্পগুলোর সঙ্গে সম্মানজনকভাবে ব্যবহার করতে শুরু করে।’ যোগ্যতার বিবেচনায় এই মহান বিজ্ঞানীকে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর গ্র্যান্ডমাস্টার বলা হয়। তাঁর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কল্পকাহিনী বিষয়ক রচনা হচ্ছে ‘ফাউন্ডেশন সিরিজ’। অন্যান্য প্রধান সিরিজের মধ্যে রয়েছে ‘গ্যালাক্টিক সাম্রাজ্য সিরিজ’, ‘রোবট সিরিজ’। তাঁর অসংখ্য ছোটগল্পের মধ্যে ‘নাইটফল’ ১৯৬৪ সালে সাইন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা কর্তৃক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান কল্পকাহিনী শীর্ষক ছোটগল্পের সম্মানে ভূষিত হয়। তিনি পল ফ্রেঞ্চ ছদ্মনামে শিশুদের জন্যও লিখতেন। আর্থার সি, ক্লার্ক (১৯২০-১৯৯২) বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক এবং উদ্ভাবক। তিনি ‘অডিসি সিরিজ’-এর স্রষ্টা। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রকাশিত একটি বিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধে ক্লার্কই প্রথম উপগ্রহভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারণা প্রদান করেন। তাঁর এই আবিষ্কার পেটেন্ট করে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারতেন কিন্তু তা তিনি করেননি। তাঁর কল্পবিজ্ঞানবিষয়ক প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ পাঠ নেয়া যাক : ‘অনেকে অনেক রকম দাবি করলেও ভবিষ্যদ্বাণী আসলে কারও পক্ষেই করা সম্ভব না। এবং আমি সবসময় অতিমানবীয় লেভেলটি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। অতিমানবের চেয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাদাতা লেভেলটি আমার কাছে অনেক বেশি পছন্দের। আমার লেখা ননফিকশনগুলোর মাধ্যমে কেবল সম্ভাব্য ভবিষ্যতের রূপরেখা প্রণয়নের চেষ্টা করেছি। তাছাড়া, অদূর ভবিষ্যতে এমন কোন উদ্ভাবনও ঘটে যেতে পারে যাকে এখন সম্পূর্ণ অমূলক মনে হচ্ছে। ভবিষ্যতের কথা বলা সহজ নয় মোটেই। আগের কোনো ভবিষ্যদ্বাণী শুনলে ভীষণ হাস্যকর মনে হতে পারে, আবার কখনো মনে হতে পারে বিস্ময়কর। আইবিএম-এর চেয়ারম্যান ১৯৪৩ সালে বলেছিলেন, ‘বিশ^বাজারে খুব বেশি করে হলে পাঁচটি কম্পিউটারের চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে।’ অবশ্য টমাস ওয়াটসনের সমালোচনা করাটা আমার ঠিক হচ্ছে না। কারণ ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ‘ট্রানজিট অফ আর্থ’ বইয়ে আমি বলেছিলাম, ১৯৭৪ সালে মানুষ মঙ্গলে অবতরণ করবে। এখন তা মনে হচ্ছে ২০১০ সালেও তা সম্ভব না। আবার ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ‘প্রিলিউড টু স্পেস’ বইয়ে বলেছিলাম, ১৯৭৮ সালে মানুষ চাঁদে যাবে। নিল আর্মস্ট্রং আর বাজ অলড্রিন আরও দশ বছর আগে চাঁদে গিয়ে আমাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরও একটি কারণে গর্ব না করে পারি না। ১৯৪৫ সালে আমি যেখানে বলেছিলাম ঠিক সেখানেই বর্তমানে কৃত্রিম উপগ্রহগুলো ঘুরচ্ছে। অনেকে উপগ্রহের এই কক্ষপথকে ‘ক্লার্ক অর্বিট’ বলেন। আবার ১৯৯০ সালে আমার ‘দ্য ঘোস্ট ফ্রম দ্য গ্র্যান্ড ব্যাংকস’ উপন্যাসের ‘দ্য সেঞ্চুরি সিনড্রম’ অধ্যায়ে মিলেনিয়াম বাগের কথা বলেছিলাম। বর্তমানে বহুল প্রচলিত মিলেনিয়াম ধারণা প্রযুক্তিগত লেখালেখির বাইরে সাধারণ সাহিত্যে প্রথম সেখানেই প্রকাশিত হয়েছিল। এই বাগের কারণ ও প্রতিকার উভয় নিয়েই সেখানে আলোচনা করেছিলাম।’ কল্পনায় চিন্তাশীল মানুষ ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। সজ্জিত কল্পনাও সভ্যতার অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখে। চিন্তাশীল মন ভেসে গেছে কল্পনার রাজ্যে। আর এ কল্পনা থেকে আবিষ্কার হয়েছে সভ্যতার বিস্ময়কর উপাদানগুলো। জুল ভার্ন (১৮২৮-১৯০৫) অসামান্য সব কল্পকাহিনী রচনার জন্যে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। উড়োজাহাজ, রকেট, কিংবা সাবমেরিনের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগের অনেক পূর্বেই তিনি মহাকাশে ভ্রমণ ও সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। বিশ্বে আগাথা ক্রিস্টির পরেই তাঁর লেখা বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর বিখ্যাত কল্পকাহিনীমূলক রচনা হলো ‘Five weeks in a Ballon’, ‘রাউন্ড দ্য ওয়াল্ড ইন এইটটি ডেজ’, ‘ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস’, ‘ ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’, ‘মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’। তাঁর চাঁদে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন সফল হয়েছে। ফরাসি রেনেসাঁর কিংবদন্তির শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি হেলিকপ্টারের নকশা এঁকেছিলেন। তিনি হয় তো কল্পনা করেছিলেন একদিন মানুষ পাখির মতো আকাশে উড়তে পারবে। ১৪৮৬ থেকে ১৫১৪ সালের মাঝামাঝি তিনি অনেকগুলো উড়ুক্কু যন্ত্রের নকশা এঁকেছিলেন। তাঁর আঁকা ‘টেন্ট রোফ’ আধুনিক প্যারাশুট নামে প্রকৃত বিজ্ঞানের বিস্ময়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জগতে গ্রেগরি বেনফোর্ড (১৯৪১-বর্তমান) সবচেয়ে পরিচিত তাঁর ‘গ্যালাস্টিক সেন্টার সাগা সিরিজ’-এর উপন্যাসের মাধ্যমে। ১৯৭৭ সালে ‘ওসিয়ান অফ নাইট’ উপন্যাসটির মাধ্যমে এই সিরিজ শুরু করেছিলেন। এই সিরিজে এমন একটি ছায়াপথের কাহিনী বলা হয়েছে যেখানে সচেতন জীব সম্প্রদায়ের সঙ্গে সচেতন যান্ত্রিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে। ‘ইন দ্য ওসিয়ান অফ নাইট’ (১৯৭৬), ‘এ্যাক্রস দ্য সি অব সান্স’ (১৯৮৪) তাকে বিখ্যাত করে রেখেছে। ডেভিড ব্রিন এর উপন্যাস ‘পোস্টম্যান’-এ উত্তর এ্যাপোক্যালিপ্টিক যুগের বৈজ্ঞানিক কল্পনাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। হারবার্ট জর্জ ওয়েলস (১৮৬৬-১৯৪৬) তাঁর কল্পকাহিনীভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস (১৮৯৫)’ ওয়েলস মঙ্গলগ্রহের এলিয়ানদের বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর লেখা কল্পকাহিনীমূলক বই ‘টাইম মেশিন’ সারা বিশে^ হইচই ফেলে দিয়েছে। ‘দ্য ফাস্ট ম্যান ইন দ্য মুন’ (১৮৯৫), ‘অদৃশ্য মানব’ তাঁর লেখা সেরা সায়েন্স ফিকশন। আকেজান্ডার বেলায়েভ-এর ‘উভয়চর মানব’ উপন্যাসের বিষয় ইকথিয়েন্ডারদের জলে স্থলে বসবাস। এইচ জি ওয়েলসের পর থেকে শুরু হয় সময় পরিভ্রমণ নিয়ে সায়েন্স ফিকশন লেখা। যুক্ত হয় সায়েন্স ফিকশনে নতুনমাত্রা। এক্ষেত্রে আধুনিক চলচ্চিত্র জগতও পিছিয়ে নেই। সায়েন্স ফিকশনে ঘটে রোবট নামের যান্ত্রিক চরিত্রের। আধুনিক যুগে সায়েন্স ফিকশন যাঁদের হাতে পূর্ণতা পায় তাঁরা হলেন : রে ব্র্যাডবেরি, আইভান ইয়েফ্রেমভ, স্থানিসোয়াভ, ফ্রেড্রিক ব্রাউন, পিটার কার্টার রজার ডি, জ্যাক ফিনি, স্টুয়ার্ট ফ্রিডম্যান, এ্যাডওয়ার্ড গ্রেনডন, ড্যামন নাইট, ফ্রিটজ লেইবার, এ্যালান নেলসন, পেটার, ফিলিপস, ম্যাক রেইনোলডস, এরিক ফ্র্যাঙ্ক রুসেল, ওয়াল্ট শেলডন, র‌্যালফ উইলিয়ামস, ফিলিপস, গাই এনডোর, জোসেফ পেনি ব্রেননান, বিলব্রাউন, উলিয়াম স্যামব্রোট, পল আর্নস্ট, এইচ পি লাভক্র্যাফট, জেমস হিলটন প্রমুখ। এঁরা সবাই আধুনিক যুগের সায়েন্স ফিকশন লিখে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বর্তমান বিশ্বে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে অনেক মুভি হচ্ছে। এ মুভির মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম সায়েন্স ফিকশন নিয়ে ভাবতে পারে। `A Space Odyssey (1969), `The Andromena Strain (1971), `Alien (1979),` Apollo 13 (1995)`। এ রকম জনপ্রিয় মুভিগুলো সায়েন্স ফিকশনকে মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলছে। বাংলা ভাষায় প্রথম কল্পকাহিনী লেখা শুরু হয় উনিশ শতক এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। বাংলা ভাষার লেখকগণ ভারত বিভাজনের পূর্বে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনী লিখতেন। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে (১৮৫৮-১৯৩৭) বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর জনক বলা হয়। ১৮৯৬ সালে তিনি লিখেছেন ‘নিরুদেশের কাহিনী’। আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণের এই কাহিনী বাংলা ভাষায় রচিত বিজ্ঞান কথাসাহিত্যের মধ্যে অন্যতম। গল্পের বিষয়বস্তু ছিল একটি ছোট্ট এক বোতল চুলের তেল ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড় থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। এর পরে তিনি ‘পলাতক তুফান’ নামে কল্পকাহিনী লিখেছেন। বাংলা বিজ্ঞান কল্পকাহিনী কথাসাহিত্যে জগদানন্দ রায়ের (১৮৬৯-১৯৩১) ‘শুক্র ভ্রমণ’। এ বইটি লিখে বাংলা সাহিত্যে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন। গল্পটি সাহিত্যের ইতিহাসবিদদের নজর কাড়ে। কারণ গল্পটি অন্য গ্রহে যাত্রা বর্ণনা করে। হেমলাল দত্ত ‘দ্য মিস্ট্রি’ নামে কল্পকাহিনী লিখে সুনাম অর্জন করেছিলেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের (১৯০৪-১৯৮৮) প্রথম কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস ‘কুহোকের দেশে’। হেমেন্দ্রকুমার রায় (১৮৮৮-১৯৬৩)-এর ‘মেঘদুতের মর্তে আগমন’ বিখ্যাত কল্পকাহিনীমূলক বই। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক সত্যজিৎ রায় বহুসংখ্যক কল্পকাহিনী লিখেছেন। প্রফেসর শংকু তাঁর কল্পকাহিনীর কল্পিত চরিত্র। তিনি ‘আং’ উপজাতিকে নিয়ে ‘দ্য এলিয়েন’ নামে একটি কাহিনী লিখেছেন। তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কথাসাহিত্য এগিয়ে নিতে বিশেষ অবদান রাখেন। হেমেন্দ্র কুমার রায়, সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, সুনীল গাঙ্গুলি, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ, সমরজিৎ কর, অনীশ দেব, বিশ^জিৎ গাঙ্গুলি, সিদ্ধার্থ ঘোষ, রাজেশ বসু এবং অভিজত রায় চৌধুরী বাংলা কল্পসাহিত্য রচনায় অবদান রাখেন। বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২)ও কল্পকাহিনী লিখেছেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ একটি নারীবাদী বিজ্ঞান কথাসাহিত্যের প্রাচীনতম উদাহরণ। কাজী আবদুল হালিমের মহাশূন্যের কান্না (কসমস-এর কান্না) প্রথম আধুনিক পূর্ব বাংলার বিজ্ঞান কথাসাহিত্যের উপন্যাস। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) দেশের আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর পথিকৃৎ। ‘তোমাদের জন্য ভালোবাসা’ ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটি প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশী বিজ্ঞান কথাসাহিত্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ‘তারা ছিল তিন’, ‘ইরিনা’, ‘অনন্ত নক্ষত্রবীথি’, ‘ফিহা সমীকরণ’ নামে জনপ্রিয় অসংখ্য বই রয়েছে। বাংলা কল্পসাহিত্যের আর একজন পথিকৃৎ মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। তাঁর জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক বই হলো প্রথম সায়েন্স-ফিকশন গল্প ‘কপোট্টনিক ভালোবাসা’। তারপর লেখেন ‘কপোট্টনিক সুখ দুঃখ’, ‘ওমিক্রমিক রূপান্তর’, ‘টুকুনজিল’, ‘ক্রোমিয়াম অরণ্য’, ‘বেজি’, ‘নয় নয় শূন্য তিন’। এ ছাড়াও বাংলাদেশের বেশ ক’জন কল্পকাহিনী লেখকের নাম শুনতে পাই। তারা হলেন : অনিরুদ্ধ আলম, মোশতাক আহামেদ, নিপুণ আলম, রাকিব হাসান, মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, আলতামাশ পাশা, জাকারিয়া স্বপন প্রমুখ। প্যারালালা ওয়ার্ল্ড ও বর্তমান সময়ের যুক্তিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক রহস্যপূর্ণ বিষয় নিয়ে বেশি আগ্রহী অনিরুদ্ধ আলম। ‘পিঁপড়ে (সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস)’, ‘অপারেশন ক্যালপি বত্রিশ’, ‘ক্রিনোর অপেক্ষায়’ এবং ‘তেইশ শত দুই সালের এক জানুয়ারি’ এ সায়েন্স ফিকশনশগুলো লিখে বাংলাদেশের কল্পবিজ্ঞানে বেশ জনপ্রিয় আছেন মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনগুলোর যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। মহাকাশ, মহাসাগরের তলদেশে কাল্পনিক ভ্রমণের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক চিন্তার দ্বার প্রসারিত হয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রও বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘সমুদ্রের গভীরে কয়েক হাজার ফুট নিচে সে এক অদ্ভুত জগত! সাজানো-গোছানো সুন্দর এক শহর। সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করতে করতে একদল অভিযাত্রী পৌঁছে গেলেন সেই শহরে। সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে নাম না জানা অদ্ভুত সব প্রাণী, মাছ, জলজ উদ্ভিদ, আর তাদেরই পাশে বহাল তবিয়তে বসবাস করছে মানুষ। তাদের বাড়িঘরও রয়েছে। আছে খেলাধুলোর ব্যবস্থাও। ডাঙার মানুষ কিন্তু এতদিন টেরই পায়নি যে জলেরে নিচে রয়েছে আশ্চর্য এক সভ্যতা’! এ অংশটি একটি কল্পকাহিনীর অংশ। এভাবেই কল্পকাহিনীগুলো এগিয়ে নিয়েছে আমাদের প্রকৃত বিজ্ঞানের গবেষণার কাজ। ১৯২৯ সালে শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল লিখেছিলেন, ‘ম্যারাকট ডিপ’ নামে এ সায়েন্স ফ্যানটাসি। তাঁর গল্পে ছিল হারিয়ে যাওয়া এক শহর ‘আটলান্টিস’-এর কথা। পৃথিবীর বড় সব মনীষীরা এই আটলান্টিসর বিষয় মন্তব্য করেছেন। প্লেটোর কথা অনুযায়ী আটলান্টিস ছিল এক স্বর্গ উদ্যান। অত্যন্ত উর্বর এখানকার মাটিতে ফলমূল, শাকসবজির কোন অভাব ছিল না। মনমাতানো গন্ধে ভরা রঙ-বেরঙের সুন্দর ফুলে ভরা থাকত সবুজ এ রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা। আটলান্টিস নিয়ে গবেষকদের আলোচনা-গবেষণার শেষ নেই। কল্পকাহিনীর সূত্র ধরে মানুষ খুঁজে পাচ্ছে প্রাচীনতম সভ্যতার। সভ্যতা কথাটি মানব জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, শিল্প-সাহিত্য, কলা, দর্শন ও বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর ব্যাপক উন্নতির সঙ্গে জড়িত একটি বিষয়কে বুঝানো হয়। সে ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক অনুঘটনটির উন্নতি মানুষের জীবনকে আরও বিকাশিত করে। কল্পবিজ্ঞান এ ক্ষেত্রে প্রকৃত বিজ্ঞানের ছায়া হিসেবে কাজ করে। আমরা এখানে রোবট আবিষ্কারে কথা উল্লেখ করতে পারি : ‘কৃত্রিম মানুষের এবং সঙ্গীদের ধারণাগুলো মূলত ক্যাডমাসের প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনীগুলো থেকে নেওয়া, যাতে বলা হয়েছে যে ড্রাগন দাঁত বপনের মাধ্যমে তারা সৈন্যে পরিণত হবে। রোবট ইতিহাসের উৎপত্তি প্রাচীন বিশ্বেই এবং তা ছিল কল্পকাহিনীভিত্তিক। এর আধুনিক বিকাশ সাধিত হয় শিল্প বিপ্লবের সূত্রপাত ধরে। মানবজাতির ইতিহাসে রোবট এখন বিশে^র বিস্ময়। রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের গবেষণা কাজে। অফিস-আদালতে এবং সাংসারিক নানা কাজে মানুষকে রোবট সাহায্য করে থাকে। আবিষ্কার হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পূর্ণ রোবট যা মানুষের কাজকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। উৎকর্ষ এনেছে মানব সভ্যতায়। অনেক প্রকৃত বিজ্ঞানের উদ্ভাবের পিছানে কল্পবিজ্ঞানের রয়েছে ভূমিকা। ভৌতবিজ্ঞান বা প্রকৃত বিজ্ঞান বর্তমান নিয়ে কথা বলতে চেষ্টা করে আর সেখানে কল্পবিজ্ঞান অনেক এগিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে। আর এই ভবিষ্যদ্বাণীই বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মানব জাতির জীবনযাত্রায় অবদান রাখে এবং সভ্যতাকে নিয়ে যায় অনেক উচ্চতায়।
×