শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২ মে দিনটি ছিল রবিবার। ২৪ বছর বাংলাদেশ শোষিত হয়েছে ধর্ম আর সংহতির নামে। পশ্চিম পাকিস্তানী শোষক গোষ্ঠী লুণ্ঠন করেছে বাংলার সম্পদ, ধ্বংস করেছে বাংলাদেশের আর্থিক মেরুদন্ড প্রধান অর্থকরী ফসল পাট। আর এ পাট রফতানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা। কিন্তু পাটচাষীরা তাতে কোন উপকৃত হয়নি। বাংলার গরিব চাষী-শ্রমিকেরা আরও গরিব হয়েছে- তাদের ওপর নেমে এসেছে নির্যাতনের চরম দ-।
বাংলাদেশ এবং বাংলার জনগণকে বাঁচাবার জন্যই আজ তাই শুরু হয়েছে মরণপথ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এ সংগ্রামে শরিক বাংলার বুদ্ধিজীবী, বাংলার কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-জনতা সবাই। এই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি নতুন কোম্পানি ‘সি-কোম্পানি’ নাম ধারণ করে নায়েক সুবেদার হাজী মুরাদ আলীর নেতৃত্বে পাক বাহিনীর অমরখানা ঘাঁটির সন্নিকটে মাগুরায় একটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নির্মাণ করে। সকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কামান ও মর্টারের সাহায্যে রামগড়ে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধাদের চট্টগ্রাম সেক্টরের সদর দফতরে দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে আক্রমণ চালায়। আর্টিলারির শেলিংয়ের ফায়ার কাভার করে এগিয়ে এসে তারা করের হাট-রামগড় রাস্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেঙ্গে দেয়। সারাদিন যুদ্ধের পর মুক্তিসেনারা পিছু হটে, সীমান্ত পার হয়ে ভারতের সাবরুমে অবস্থান নেয়। পাকসেনারা রাতে রামগড়ে প্রবেশ করে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো নারকীয় কর্মকা- চালায়, নিহত হয় আসংখ্য মানুষ। মুক্তিযোদ্ধাদের অসম প্রতিরোধ লড়াইয়ের পর পতন হয় রামগড়ের। মুক্তিযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জে অবস্থানরত পাক বাহিনীর ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। অপরদিকে পাক বাহিনী কিশোরগঞ্জ থেকে দশ মাইল দূরে অবস্থিত বিরল নামক স্থান থেকে দূরপাল্লার অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। ভারত সীমান্তের রাধিকাপুর নামক স্থানের শরণার্থী শিবিরে পাকবাহিনী বোমা নিক্ষেপ করে। এতে একজন নিহত ও অনেকে আহত হয়। তেলিয়াপাড়া এলাকাকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে রাখার তৎপরতার প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন মতিন, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, একজন নবাগত অফিসার ও তাঁর দল নিয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে শাহজিবাজার পৌঁছান। ক্যাপ্টেন মতিনের কাজ হচ্ছে শত্রুপক্ষের চলাচল’ পথে এ্যামবুশ করা। এভাবে মুক্তিযোদ্ধারা তেলিয়াপাড়া এলাকা ডিফেন্স দেয়। পিরোজপুরে সিরাজ শিকদার গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভানেত্রী জাহানারা বেগম , শাহনেওয়াজ প্রধান কমান্ডার, মুজিব গণসংযোগ ও মাহতাব সদস্য নির্বাচিত হন। ঘাঁটি এলাকাকে কয়েকটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশের আশ্রয় প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৮ লাখ ৬৭ হাজার ৪২৮ জন। লে. জেনারেল টিক্কা খান বরিশাল ও ফরিদপুর সফর করেন। সেখানে সেনাবাহিনীর সদস্যদের আরও সক্রিয়ভাবে দুষ্কৃতকারীদের দমন করার ব্যাপারে তৎপর হবার নির্দেশ দেন। পাকিস্তানে তুরস্কের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মি. এইচ সারাবুর্ক পাকিস্তানের প্রতি তার সরকারের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে ঘোষণা করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হানাদার বাহিনীর পক্ষে শেরে বাংলার মেয়ে রইসি বেগম এক বিবৃতি দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় দালাল আমাদের স্বাধীনতা ও সংহতি বিপন্ন করে তুলেছিল। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী শত্রুর সে চেষ্টা সফল হতে দেয়নি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে জানান, আমরা প্রতিশোধ নিতে জানি। শত্রুদের আমরা রুখবোই। শান্তি কমিটির উদ্যোগে খুলনায় এক সভায় সবুর খান বলেন, কিছু ব্যক্তি ব্যতীত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পাকিস্তানীরা প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা কোন মতবাদই নয়। বহু ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। পাকিস্তানকে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না আমরা সবাই পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের পক্ষে। জীবন দিয়ে হলেও আমরা পাকিস্তানকে রক্ষা করব। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পর্দগানি পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে এক পত্রে রক্তপাত বন্ধ ও শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার অনুরোধ জানান। এই দিন দৈনিক সংগ্রাম ‘হিন্দুস্তানী সৈন্যের বর্বরতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করছে যে, যেখানে যে অঞ্চলেই ভারতীয় সৈন্যরা অনুপ্রবেশ করেছে, সেখানকার জনগণ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় আমাদের পাক সেনাবাহিনীর আগমণের অপেক্ষা করেছে। পাকবাহিনীর আগমনে শান্তি ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে। এই দিন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল তার কিছু অংশ হলো এমন’ ‘মার্চে শাসনতান্ত্রিক এই সঙ্কট যখন সৃষ্টি হয় তখন শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। সাধারণ বাঙালীর কাছে তার কাপড় স্পর্শ করা ছিল তাবিজে শুভ ফল পাওয়ার মতো। তাঁর বাক্যই হয়ে উঠেছিল আইন। ধানমন্ডিতে তাঁর বাসা থেকে তিনি সব করছিলেন, সবার সঙ্গেই ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, তাঁর কাছে যাওয়ায় কোন বাধা ছিল না। প্রতিদিন দেখা করতেন অজস্র লোকের সঙ্গে। সম্পদ বা পদমর্যাদার দিকে তাঁর কোন নজর ছিল না, সম্পূর্ণভাবে আন্তরিক ছিলেন জনগণের প্রতি। প্রতিটি বাঙালী, তিনি যত তুচ্ছ বা গরিবই হোন না কেন, তিনি তাকে মানুষের মর্যাদা ও সম্মান দিয়েই বিবেচনা করতেন, সাহায্য করতেন। তাঁর নাম তাঁর পরিবারের অবস্থা কখনও ভুলতেন না, প্রতিদানে বাঙালীরা তাঁকে বিশ্বাস করতেন, তাঁর সততা, আত্মত্যাগ, সাহস ও তাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার বিষয়টিও বিশ্বাস করতেন।’ বঙ্গবন্ধুকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কখনও পছন্দ করেনি। তবুও তারা কী চোখে দেখত বঙ্গবন্ধুকে তার একটি উদাহরণ ১৯৭০ সালে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেলের যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো রিপোর্ট। রিপোর্টটিতে লেখা হয়েছিল- ‘মুজিব সারাজীবনই একজন রাজনীতিবিদ। ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বছর তিনি কাটিয়েছেন পাকিস্তানী জেলে, যার চূড়ান্ত পরিণতি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এই মামলা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর কাছে তাঁকে মহানায়ক করে তোলে এবং তাঁর ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করে। মানুষ মুজিবকে ছাঁচে ফেলা কঠিন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি আত্মবিশ্বাসী, শান্ত, চমৎকার। বেশ ঘুরেছেন তিনি এবং শাহরিক। মঞ্চে তিনি জ্বালাময়ী বক্তা। মুষল ধারায় বৃষ্টির মধ্যেও তাঁর বক্তৃতা সাধারণকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে পারে। দলীয় নেতা হিসেবে কঠিন এবং কর্তৃত্বপরায়ণ, অনেক সময় একগুঁয়ে। বাঙালীদের অভিযোগের কথা বলতে গেলে তিনি হয়ে পড়েন স্বতঃস্ফূর্ত এবং আবেগপ্রবণ। এমনকি ঘোরতর শত্রু পাকিস্তানীরাও বঙ্গবন্ধুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে। উদাহরণস্বরূপ স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাবেক পাকিস্তানী অফিসার মেজর জেনারেল তোজাম্মেল হোসেন মালিক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, পাকিস্তানে তাঁকে ব্যাপকভাবে দেশদ্রোহী অপবাদে চিত্রিত করা হলেও বস্তুত মুজিব দেশদ্রোহী ছিলেন না। নিজ জনগণের জন্য তিনি ছিলেন এক মহান দেশপ্রেমিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী পড়লেই বোঝা যায় তিনি আসলে কেমন ছিলেন। তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন : একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালী হিসেবে যা কিছু বাঙালীর সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালবাসা, অক্ষয় ভালবাসা, যে ভালবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। মানুষের প্রতি তাঁর যে অসীম মমত্ববোধ তা এই কয়টি ছত্রেই ফুটে ওঠে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]