ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দিনাজপুরে এবার লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ১১:২২, ১ মে ২০১৯

দিনাজপুরে এবার লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর থেকে ॥ লিচুর জেলা হিসেবে দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে দিনাজপুর। এই জেলার ১৩ উপজেলাতেই লিচু চাষ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। আর প্রতি বছর এর ধারাবাহিকতায় বাড়ছে লিচু চাষের জমির পরিমাণ। এদিকে এবার মধুমাসের অন্যতম ফল লিচুর বাম্পার ফলনে আশাবাদী চাষীরা। এখনই প্রতিটি লিচু গাছে শোভা পাচ্ছে থোকায় থোকায় মুকুল। দিনাজপুর হর্টিকালচার বিভাগের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ প্রদীপ কুমার গুহ জানান, প্রতিবছর এই জেলায় উৎপাদিত লিচু দেশের বিভিন্ন জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তিনি জানান, লিচু লাভজনক ব্যবসা হওয়ায় প্রতিবছরই জেলাতে লিচু চাষ বেড়েই চলছে। অনুকূল আবহাওয়া ও কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার জেলায় রেকর্ড পরিমাণ লিচুর ফলন হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। প্রদীপ বলেন, লিচু বাগানে ও বসত বাড়ির লিচু গাছের মুকুল এখনও ভাল রয়েছে। ভাল ফলনের আশায় লিচু চাষীরা পরিচর্যা পুরো দমে চালিয়ে যাচ্ছে। চাষীদের সহযোগিতা করতে কৃষি অধিদফতর এবং হর্টিকালচার বিভাগ থেকে অব্যাহতভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোঃ তহিদুল ইকবাল জানান, ২০০৯ সালে জেলায় লিচু চাষের জমির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫০০ হেক্টর। ২০১০ সালে তা এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৮০ হেক্টরে, ২০১১ সালে ১ হাজার ৯৫৬ হেক্টর এবং ২০১২ সালে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর এবং ২০১৫ সালে ২ হাজার ৭শ’ হেক্টর, ২০১৭ সালে ৩ হাজার ২শ’ হেক্টর, ২০১৮ সালে ৪ হাজার ১শ’ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। চলতি বছর ২০১৯ সালে লিচু চাষের জন্য জমির পরিমাণ ৫ হাজার ৭শ’ ৮১ হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। গাছের সংখ্যা ৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৩টি। দিনাজপুরের লিচু সুস্বাদু ও মিষ্টি হওয়ায় সারাদেশব্যাপী এর চাহিদা বেশি। দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একজন প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা জানান, লিচু চাষে ব্যাঘাত না ঘটার জন্য কৃষি কর্মকর্তারা চাষীদের নিয়মিত পরামর্শ দেন। কোন সময়ে কোন কীটনাশক, বালাইনাশক ব্যবহার করা উচিত তা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। দিনাজপুরের লিচুর মধ্যে চায়না থ্রি, চায়না ফোর, বেদেনা, বোম্বাই ও মাদ্রাজি উল্লেখযোগ্য। জেলার সদর উপজেলার আউলিয়াপুর, মাসিমপুর, পুলহাট, সিকদারগঞ্জ, মহব্বতপুর, উলিপুর, খানপুর এলাকায় ঐতিহ্যবাহী বেদেনা লিচু চাষ উল্লেখযোগ্য। এই এলাকার মাটির কারণেই উৎপাদিত বেদেনা লিচু সুস্বাদু এবং উন্নত মানের হয়ে থাকে। অন্য এলাকার বেদেনা লিচুর চেয়ে এই এলাকার বেদেনা লিচু সকল ধরনের গ্রাহকের নিকট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। হাইব্রিড জাতের লিচু চায়না টু, চায়না থ্রি, চায়না ফোর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম, বিরল, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, ফুলবাড়ীসহ জেলার ১৩ উপজেলাতেই ব্যাপকহারে বাগান গড়ে উঠেছে। মৌসুমের শুরুতেই বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে লিচুর বাগান আগাম কিনে লিচু গাছের পরিচর্যা শুরু করেছেন। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিনাজপুরের প্রতিটি বাড়ির বসতভিটায় বা আঙ্গিনার লিচু গাছে মুকুল বের হয়েছে। লিচু গাছের মুকুলের সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ফুলে মৌমাছির গুঞ্জন আর ঝি ঝি পোকার ঝি ঝি শব্দে এলাকা মুখরিত হয়ে উঠেছে। ফুল আসা থেকে লিচু আরোহন পর্যন্ত ৩-৪ মাস লিচু বাগানের সঙ্গে সম্পৃক্তদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায়। ফুল আসার ১৫ দিন আগে এবং ফুল আসার ১৫ দিন পরে সেচ দিতে হয়। সেই অনুযায়ী গাছে মুকুল আসার সঙ্গে সঙ্গে মুকুলকে টিকিয়ে রাখতে লিচু চাষী ও ব্যবসায়ীরা গাছে স্প্রে করে চলেছেন। এছাড়াও মুকুল যাতে ঝড়ে না পড়ে সে জন্য গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি ও সার দেয়া হচ্ছে। দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুর গ্রামের লিচু চাষী ইমতিয়াজ আহমদ (৫২) জানান, লিচুর ফুল আসা শুরু করার পর পরিচর্যা শুরু করতে হয়। নিয়মিত স্প্রে ও সেচ দেয়া শুরু হয়েছে। লিচু গাছগুলোতে ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার লিচু ব্যবসায়ীরা আসতে শুরু করেছেন। তারা আগাম লিচু বাগান কিনছেন। তার ৩ একর জমির দুটি লিচু বাগান রয়েছে। ২৯৫ লিচু গাছের মধ্যে ৮২ রয়েছে বেদেনা লিচুর গাছ এবং দেশী ও হাইব্রিড জাতের চায়না থ্রির গাছ রয়েছে ২১৩। এ দুটি বাগান তিনি ১ বছরের জন্য সাড়ে ৯ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। বাগানের বয়স প্রায় ১২ থেকে ১৬ বছর হবে। যত দিন যাবে লিচুর গাছে ফল বেশি ধরবে এবং দামও বাড়তে শুরু করবে। এছাড়াও তার বাড়িতে ৪ লিচুর গাছ রয়েছে এর মধ্যে ১ বেদেনা ও ৩ মাদ্রাজী ও বোম্বে লিচু। এ ৪ গাছের লিচু তার পরিবারের খাওয়া ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনকে দেয়া এবং বিক্রি করা যায়। বিরল উপজেলার বটেরহাট গ্রামের লিচু বাগানের মালিক দৌলত তালুকদার জানান, এবারে যে পরিমাণ ফুল আসতে শুরু করেছে, তাতে করে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার লিচুর ফলন হবে। তার দেড় একর জমিতে চায়না থ্রি লিচু বাগান রয়েছে। তার বাগানে ১৫২ গাছ রয়েছে। চলতি বছর ফেনী জেলার ব্যবসায়ী সারওয়ার জাহান ৩ লাখ টাকায় বাগানটি কিনেছেন। বাগানের লিচুর গাছের বয়স ১৫ বছর হতে চলছে। তার এলাকায় আরো ২০ বাগানে বাম্পার লিচু ফলন হয়েছে। দিনাজপুর জেলা কৃষি অধিদফতরের ফল বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, দিনাজপুরের প্রসিদ্ধ বেদেনা লিচু সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ব্যাপকভাবে হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আউলিয়াপুর ইউনিয়নে কসবা, উলিপুর, মাসিমপুর, খানপুর, দাইনুর, মহদেবপুর, রসুলপুর, চেরাডাঙ্গী, শিকদারহাট এসব এলাকায় বেদেনা লিচুর জন্য প্রসিদ্ধ।
×