ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মলয় বিকাশ দেবনাথ

তরুণ নির্দেশক আহমেদুল কবির

প্রকাশিত: ১২:৪৭, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

তরুণ নির্দেশক আহমেদুল কবির

স্বভাবে আপাত অন্তর্মুখী; তার মানে এই নয় হাসি-ঠাট্টা আর আড্ডায় কম পারদর্শী। পেশা শিক্ষকতা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহমেদুল কবির। তরুণ এই শিক্ষক অল্প বয়সেই বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছেন। তার দায়িত্বপ্রাপ্তিতে বিভাগে লেগেছে তারুণ্যের ছোঁয়া। ডিজিটাইজেশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তরুণ এ চেয়ারম্যানের হাত দিয়ে বিভাগেও পড়েছে প্রযুক্তির ছাপ। স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রতিটি ক্লাসরুমে ওয়াই-ফাই সুবিধা, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর স্থাপন ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য কম্পিউটারের ব্যবস্থা করেছেন। ১৫ লাখ টাকার ফান্ড সংগ্রহ বিভাগকে করেছে সমৃদ্ধ। ফলে প্রতি বছর চার জন শিক্ষার্থীকে চার বছরের জন্য বৃত্তি প্রদান করা যায়। এ বিভাগটি অন্যান্য বিভাগ থেকে একটু আলাদা। একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভাগ থেকে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। এ ছাড়া সমসাময়িক সঙ্কট, বিশেষ দিবস উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা পথনাটক করে থাকে। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে টিএসসিতে নাট্যোৎসবের আয়োজন করা হয়। আহমেদুল কবিরের দিকনির্দেশনায় গত ডিসেম্বরের নাট্যোৎসব পেয়েছিল ভিন্নমাত্রা। তারই ভাবনায় অডিটরিয়াম ও অডিটরিয়ামের বাইরে নাটকগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, সপ্তাহব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেন উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল। এবারের বর্ষবরণেও দেখা গিয়েছে শেকড় সন্ধানী ছাপ। অনুষ্ঠানে চিরায়িত পান্তা-ইলিশের পর ছিল বাউলগান, বেঁদেদের সাপের খেলা, বানরের খেলা, হিজড়াদের নাটক। বিশেষ আকর্ষণ ছিল আমাদের নিজস্ব খেলা কাবাডি। সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া এসব লোকজ সংস্কৃতি দেখতে পেয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা দর্শকরা যেমন আনন্দ পেয়েছেন তেমনি বাচ্চারা হয়েছিল রোমাঞ্চিত। শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতোমধ্যে তিনি নিজেকে একজন সফল মঞ্চ নাট্যনির্দেশক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। গত ২৫ এপ্রিল হতে নাটম-ল মঞ্চে প্রতি সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হচ্ছে আহমেদুল কবিরের নির্দেশিত শাস্ত্রীয় নাটক রসপুরাণ। চলবে ৪ মে পর্যন্ত। রসপুরাণ নাটকটি নিয়ে নির্দেশক বলেন, ‘অভিনয়ের তত্ত্ব’ ও ‘রস’-এর ধারণার নির্ভরযোগ্য প্রাচীন প্রামাণিক পা-ুলিপি ভরত মুনি রচিত নাট্যশাস্ত্র। শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস ও অদ্ভুতÑ এই আটটি রস ‘নাট্যরস’ বলে কথিত। রসসমূহের স্থায়ী ভাব রয়েছে। রতি ভাব থেকে শৃঙ্গার, হাস থেকে হাস্য, শোক থেকে করুণ, ক্রোধ থেকে রৌদ্র, উৎসাহ থেকে বীর, ভয় থেকে ভয়ানক, জুগুপ্সা থেকে বীভৎস এবং বিস্ময় থেকে অদ্ভুত রস তৈরি হয়। ধ্রুপদী আঙ্গিকের এই প্রযোজনাকে দর্শকের সামনে উপস্থাপনের জন্য পা-ুলিপি নির্বাচনের কাজ শুরু হয় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। নাট্যশাস্ত্রের আটটি রসকে প্রাধান্য দিয়ে ধ্রুপদী বিভিন্ন উৎস থেকে পা-ুলিপির কাঠামো নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের দুটি মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ এবং অন্যান্য ধ্রুপদী নাটক থেকে আখ্যান-বস্তু চিহ্নিত করা হয়। এরপর নির্বাচিত অংশগুলো নিয়ে পুনঃসৃজনের লক্ষ্যে শুরু হয় তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন (ইম্প্রোভাইজেশন) ভিত্তিক মহড়া। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সৃজনশীল উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণ ও রূপায়ণ করা হয়। রসভিত্তিক এই নাট্য নির্মাণে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় আঙ্গিকাভিনয়ে। নাট্য নির্মাণের শুরুতেই আমাদের চিন্তা ছিল রসভিত্তিক একটি প্রযোজনা তৈরি করা, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টিশীল সংযোগ স্থাপন এবং উভয়ের উদ্ভাবনী গবেষণার মাধ্যমে রসসমূহকে একই আধারে সংশ্লেষিত করা। অষ্টরসাখ্যান স্বরূপ এই প্রযোজনায় যে অদৃশ্য সুতোটি এক দৃশ্যের সঙ্গে আরেক দৃশ্যের মধ্যে ভাবগত সংযোগ স্থাপন করেছে তা হলো রস। ধারণাগত কাঠামো (কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক) রূপে রসনিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার পটভূমিতেই খ- খ- দৃশ্যের সংশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সঙ্কটময় পরিস্থিতি থেকে সুন্দর ও নির্মল পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় আমাদের প্রযোজনা রসপুরাণ।’ নাটক অন্তঃপ্রাণ কবির সবসময়ই সৃজনশীল পা-ুলিপি তৈরি করে নাটক নির্দেশনা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। সৈয়দ হকের ত্রয়ী মিথষ্ক্রিয়ায় বহ্নি বিসর্জন ব-দ্বীপ এর আরেক নিদর্শন। নির্দেশক আহমেদুল কবির এই নাটকের সংলাপে বর্ণনাত্মক রীতি এনে নাটকটির ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। অন্যদিকে নাটকটিতে ব্রেখটিয় রীতিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এ ছাড়া তার নির্দেশিত নাটকের মধ্যে রয়েছে দ্য এ্যান্ড গেম, দ্য ওয়াইল্ড ডাক, এ্যান্ড মিড সামার নাইটস ড্রিম, দ্য উইভার, বিসর্জন, তৃষ্ণায়, দ্য ইনস্পেক্টর জেনারেল, কয়েদি হায়াৎ, প্রথম পাঠ্য উল্লেখযোগ্য। আশাবাদী ব্যক্তিত্ব আহমেদুল কবিরের মতে, ‘তরুণ প্রজন্মের হাত ধরেই পরিবর্তন হয়। আমরাই পারব মঞ্চ নাটককে দর্শকপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যেতে।’
×