১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। তিনি এক কোটি বাংলাদেশীকে আশ্রয় ও খাওয়া-পরার ব্যবস্থাই করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করেন। আর বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমথর্ন আদায়ের চেষ্টা চালিয়েছেন। এমনকি মার্কিন রক্তচক্ষুর বিপরীতে এক অনন্য অবস্থানও নেন তিনি। মুক্তিবাহিনী প্রধান সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী রামগড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন এবং চট্টগ্রামের খবরাখবর নেন। পরিদর্শন শেষে তিনি মীর শওকত আলীকে যে কোন প্রকারে অন্তত আরও দু’দিন রামগড়কে মুক্ত রাখার নির্দেশ দেন, যাতে নিরীহ জনতাসহ সবাই নিরাপদে ভারতে আশ্রয় নিতে পারে। অমরখানার কাছে মাগুরামারীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ১০ জন যোদ্ধার একটি ছোট দলের ওপর পাকবাহিনী আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এতে ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং অন্য ২ জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে আহত হয়। চট্টগ্রামের চিকনছড়া নামক স্থানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে বাগানবাড়ী নামক স্থানে এসে অবস্থান নেয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী বিপি কৈরালা কাঠমান্ডুতে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনসাধারণের করুণ অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা জয়ী হবেনই।
ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে, স্বাভাবিক কৃষিকাজে হস্তক্ষেপ করা হলে কঠোর শাস্তিদান করা হবে। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বকেয়া খাজনা পরিশোধ করতে হবে। আঙ্কারায় অনুষ্ঠিত সেন্টো সম্মেলনে পাকিস্তানী প্রতিনিধি ইফতেখার আলী মুক্তিযুদ্ধকে ভারতীয় চক্রান্ত বলে উল্লেখ করেন। লিবিয়ার নেতা কর্নেল গাদ্দাফী ত্রিপোলীতে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আবদুর রউফ খানকে জানান, পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার জন্য জন্য ইয়াহিয়া খান সঠিক ব্যবস্থাই নিয়েছেন। মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রামের রামগড়ে শক্ত প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তোলে। সিলেট শান্তি কমিটির আহ্বায়ক নাজমুল হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক খন্দকার আবদুল জলিল সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রদত্ত ভাষণে জনগণের প্রতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খতম করার আহ্বান জানান। খুলনার দৌলতপুরের দিয়ানায় সবুর খানের সভাপতিত্বে শান্তি কমিটির সভা হয়। সভায় সবুর খান খুলনাবাসীকে দেশদ্রোহীদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান। রংপুরে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলের নেতৃত্ব দেন জাতীয় পরিষদের সদস্য সিরাজুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আমিন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা অনুযায়ী একাত্তরের এই দিনে রংপুর কারমাইকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থারত (অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন, অধ্যাপক রামকৃষ্ণ অধিকারী ও অধ্যাপক সুনীল চক্রবর্তী) অধ্যাপকগণকে রাতের অন্ধকারে নির্মমভাবে হত্যা করে দমদমা ব্রিজের পাশে এক বাঁশঝাড়ে গণকবর দেয়। এ ছাড়াও অধ্যাপক কালাচাঁদ রায় ও তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় হত্যা করা হয় অধ্যাপক আব্দুর রহমান ও অধ্যাপক সোলায়মানকে। এ সময় হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল ছিল রংপুর টাউন হলো।
একাত্তরের এই দিনে মুজিবনগ থেকে ইউএনআইয়ের রিপোর্টে বলা হয় গত বুধবার ফরিদপুরের নিকটবর্তী গোয়ালন্দে একটি যুদ্ধে ১শ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি স্টিমার নিমজ্জিত হয়েছ বলে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। সংবাদে আরও জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থানকে ধূলিসাত করা হয়েছ- শুধু কুকুর ও সৈন্যরা সেখানে অবস্থান করছে। শহরে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ধূলিসাত করা হয়েছে এবং পাইকারি বাজারটি লুণ্ঠিত ও বিধ্বস্ত হয়েছে। ওই দিনই ফরিদপুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গুরুত্বপূর্ণ পাট ব্যবসা কেন্দ্র ভাঙাতেও যুদ্ধ হয়। প্রায় ২৫ লাখ টাকা মূল্যের পাট বিনষ্ট করা হয়েছে। ফেনী শহরের নিকটবর্তী এলাকায় এক শ’ পাকসৈন্য নিহত। চট্টগ্রাম রণাঙ্গনের কোন এক স্থান থেকে মুক্তিফৌজের কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন যে, গত মঙ্গলবার নোয়াখালী জেলার ফেনী শহরের শুভপুর সেতুর কাছে সংগ্রামে প্রায় এক শ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। তিনি সফররত জনৈক ইউএনআইয়ের প্রতিনিধিকে লিখিতভাবে জানান যে, ২৭ এপিল এক ব্যাটালিয়ন পাকিস্তানী সৈন্য শুভপুর সেতু আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করে। শত্রুসৈন্যরা ট্যাংক এনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর গোলাগুলি চালায়। অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানাচ্ছে প্রায় ৯০০ লোক যারা হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারতের দিকে যাচ্ছিল তাদের পাকিস্তানী আর্মি নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ছয় জন রিফিউজি, একাধিক বুলেটের ক্ষত নিয়ে বাংলাদেশের ডোমার পুলিশ স্টেশন থেকে হলদিবাড়ী এসে উপস্থিত হয়েছে এবং এখন হাসপাতালে আছেন। তারা বলেছেন যে, তারাও ওই আক্রান্তদের মাঝে ছিলেন যাদের পাকিস্তানী আর্মি গুলি করেছে, কিন্তু কোন মতে বেঁচে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। তারা বলেন- একই এলাকার প্রায় ৮ হাজার মানুষ যখন ভারতের দিকে আসছিল তারা পাকিস্তানী আর্মির বাঁধার মুখে পড়ে এবং আর্মিরা তাদের ক্যাম্পে যেতে বাধ্য করে। পাকবাহিনী এরপর সবল দেহের পুরুষদের গ্রুপ থেকে আলাদা করে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য করে এবং তারপর ব্রাশফায়ার করে। ভীতসন্ত্রস্ত বাকিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়িমরি করে ছুটতে থাকে। আমাদের দিনহাটা প্রতিনিধি যোগ করেন- কুচবিহার রাজ্যের অন্তর্গত দিনহাটার বনশপচাই ছিটমহলের লুটতরাজসহ বিভিন্ন রিপোর্ট এখন পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে দুই দিনের অনুপ্রবেশকালে পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণে প্রায় ১৫০ জন মানুষ মারা যায় এবং সব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। এই ছিটমহলে প্রায় ৩০০ মানুষের বসবাস ছিল। বেঁচে যাওয়া বাকিরা দিনহাটা সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে আসে। পাকবাহিনী সকাল ১০টার সময় ভারতের ছিটমহলের পার্শ্ববর্তী ধীরখাতা এবং শিবেরকুঠি গ্রামে প্রবেশ করে অনেক সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে। দিনহাটা হাসপাতালে বুলেটের ক্ষত নিয়ে আসা কিছু মানুষকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]