ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীলঙ্কার হামলার পরে দেশে উগ্রপন্থীরা এখন বেশি আগ্রাসী

প্রকাশিত: ১১:০৭, ৩০ এপ্রিল ২০১৯

শ্রীলঙ্কার হামলার পরে দেশে উগ্রপন্থীরা এখন বেশি আগ্রাসী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শ্রীলঙ্কার গির্জায় হামলার পর ধর্মীয় উগ্রবাদীরা আরও বেশি আগ্রাসী হয়েছে বলে দাবি করেছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি আমাদের দেশে দুই মাস আগে জঙ্গীবাদের যে ঝুঁকি ছিল, শ্রীলঙ্কায় হামলার পর তা কিছুটা বেড়েছে। তবে এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলেও জানান তিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই বিষয়ে পুরো সতর্ক রয়েছে। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ নিয়ে সচেতনতা বেশি দরকার। সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে বাংলাদেশ অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ) আয়োজিত ‘বিশ্ব সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মূল আলোচক হিসেবে তিনি এসব কথা বলেন। সিটিটিসি প্রধান বলেন, নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর ‘উগ্রবাদীরা প্রতিশোধ নেবে’- এমন চিন্তা-ভাবনা আমরা বেশকিছু লোকের মধ্যে দেখেছি। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। শ্রীলঙ্কার ঘটনার পর তারা বেশ উত্তেজিত হয়েছে। ‘তারা পারলে আমরা কেন পারব না- এমন একটা ধারণা তাদের মধ্যে তৈরি হয়। ফলে ঝুঁকিটা আগের চেয়ে বেড়েছে। দুই মাস আগে আমাদের ঝুঁকির যে মাত্রা ছিল সেটা এখন একটু বেশি। তবে এটা নিয়ে বিশেষভাবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমরা সতর্ক আছি। আমাদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও যদি সতর্ক থাকে তাহলে এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। জাতীয় প্রেসক্লাবে সিটিটিসি প্রধান যখন বক্তব্য রাখছিলেন তখনই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বছিলার মেট্রো হাউজিং এলাকায় র‌্যাবের জঙ্গীবিরোধী অভিযান চলছিল। নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার হামলার প্রসঙ্গ তুলে মনিরুল ইসলাম বলেন, নিউজিল্যান্ডের ঘটনার পর ওই লোকগুলো কিছুটা উত্তেজিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা খুব কাছের দেশ। একেবারে আঞ্চলিক জোটের একটি দেশ, ফলে এরা আরও বেশি উত্তেজিত হয়েছে। যেহেতু তাদের ওপর প্রভাব ফেলেছে, সেহেতু তারা হামলা করার চিন্তা করতে পারে। আমাদের চিন্তায় সেটা আছে, আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। আমরা সবাই মিলে যদি চেষ্টা করি তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের এ আশঙ্কা নস্যাত করে দিতে পারব। বাংলাদেশ থেমে থেমে জঙ্গীবাদের উত্থান হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কখনও কখনও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে। যারা উগ্রবাদে জড়িত তাদের কেউ কেউ কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিটা বোঝে না। এরা কিন্তু কোন কোন সময় ভিকটিম। কখনও কখনও তারা ব্রেইনওয়াশ হয়ে এ পথে যাচ্ছে এবং অসৎ উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কী, পেছনে কে আছে, এরা তা দেখতে পায় না। ফলে এই লোকগুলোই উত্তেজিত হয় কারণে অকারণে। কারণ আমরা হলি আর্টিজানের পরে দেখেছি যে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো যেগুলো ছিল সেগুলো ভেঙ্গে গেছে। অনেকগুলো বড় বড় পরিকল্পনা ছিল হলি আর্টিজনের ঘটনার পরে। কিন্তু সেগুলো তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। মনিরুল বলেন, জঙ্গী, সন্ত্রাসীদের কোন দেশ নেই, ধর্ম নেই, জাত-গোষ্ঠী কিছু নেই। তাদের একটাই পরিচয় তারা সন্ত্রাসী। যেকোন দেশ বা ধর্ম থেকেই এই সন্ত্রাসী উঠে আসতে পারে। এই সন্ত্রাসবাদের পেছনে বৈশ্বিক রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার শুরু থেকেই জিরো টলারেন্স ভূমিকা নিয়ে সন্ত্রাস নির্মূলে কাজ করছে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটা অপচেষ্টা হয়েছে। আমরা সবটা বলিও না, কারণ বললে মানুষ আতঙ্কিত হবে। হলি আর্টিজনের ধাক্কা কিন্তু আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এখনও অনেক বিদেশী জিজ্ঞাসা করেন, কোন রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাবে, কোনটাতে যাওয়া যাবে না। কথায় কথায় ট্রাভেল এ্যালার্ট ইস্যু হয়। কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের জন্য ৩০টি দেশে ট্রাভেল এ্যালার্ট ইস্যু করে। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ছিল না। নিউজিল্যান্ডের হামলার পর আমরা দেখেছি, জঙ্গীবাদের পেছনে যে একটা শক্তি আছে তা কিন্তু পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি। কারণ হামলার চিন্তা করার মতো লোকজন এখনও অনেক আছে কিন্তু হামলা বাস্তবায়নের জন্য যে সক্ষমতা দরকার সেটা অনেক কমে গেছে। সাংবাদিকদের একটা দায়িত্ব আছে উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, একটা দেশের ঘটনা, সেটা দেশের মানুষকে প্রভাবিত করে। ফলে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে কিছু শব্দের ব্যবহার নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। ধর্মীয় কিছু শব্দ আছে সেসব শব্দের ব্যাখ্যা আছে। এরা কেউ মুজাহিদ নয়, এরা জিহাদ করছে না। তাদের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে শহীদ হিসেবে আখ্যা করলে- এই কথাগুলো ধর্মপ্রাণ কেউ কেউ হয়ত উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। তাই লাদেন কিংবা আমাদের দেশের তামিম- এদের এমনভাবে চিত্রায়িত করা যাবে না যে তাদের অনুকরণীয় মনে করা যায়। এ দায়িত্ব মিডিয়ার। ইমাম-ওলামা-মাশায়েখদের একটা দায়িত্ব আছে। ওনারা যতই প্রচার করবেন, যতই কথা বলবেন, ততই উগ্রবাদ মাথা থেকে নেমে যাবে। মনিরুল ইসলাম বলেন, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা অর্থনৈতিক, সামাজিক সব সূচকেই উন্নতি করছি। ফলে আমাদের দেশের শত্রু আছে দেশের ক্ষতি করার জন্য। তিনি আরও বলেন, দু’একটি রাজনৈতিক দল ছাড়া কেউ সন্ত্রাস চায়না। এ সময় তিনি বলেন, কেউ এ ধরনের জঙ্গীবাদের জড়িয়ে পড়লে তার নানা ধরনের পরিবর্তন আসবে। যা পরিবারই প্রথম বুঝতে পারে। তাই সন্তানের দিকে খেয়াল রাখার কথা বলেন। এছাড়াও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ হিসেবে নাগরিক হিসেবে বসবাসরত এলাকায় নতুন ভাড়াটিয়াদের আচরণ সন্দেহপ্রবণ কিনা তারা লোকসমাজ এড়িয়ে চলছে কিনা সে বিষয়ে সবাইকেই সচেতন থাকার কথাও বলেন। আলোচনা অংশ নিয়ে প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিকুর রহমান বলেন, আমরা নিজেরাই বুঝতে পারিনা বলে আমরাই জঙ্গীবাদে পৃষ্ঠপোষকতা করি অনেক সময়ই। এর ব্যাখা দিয়ে তিনি বলেন, নুসরাত নামের যে মেয়েটা মারা গেল যার কারণে মারা গেল সেই অধ্যক্ষ সিরাজ একজন জামায়াত নেতা। আর তাকে স্থানীয় কিছু দলীয় নেতা পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। স্কুল-কলেজ সব জায়গাতেই রাজাকার বা তাদের এজেন্ট নানাভাবে ষড়যন্তমূলক কাজ করছে। শফিকুর রহমান বলেন, সরকার তার কাজ করবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাজ করবে। নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কিছু দায়িত্ব আছে। সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ এসব দূর করতে আমাদের ভূমিকাই রাখতে হবে। তিনি বলেন আমাদের সচেতনতা দরকার। আর ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা না শুনে ইসলাম নিয়ে বাংলায় বহু বই রয়েছে। নিজে নিজে পড়লেও জানা যায় সঠিক পথ কোনটি। তিনি বলেন, অর্থলোভে যারা জামায়াতীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদের বিরুদ্ধেও শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে। এই দেশে কোন সন্ত্রাস রাষ্ট্র হতে দেয়া হবে না বলেও জানান তিনি। বোয়াফ সংগঠন মনে করে, বাংলাদেশেসহ পুরো বিশ্বের উচিত হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক তৎপরতা আর রাষ্ট্রযন্ত্রগুলোর দক্ষতা বাড়ানোসহ সকল কর্মকা-ের একটা সমন্বয় তৈরি করা। কেননা, আর্থ-সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্রের অদক্ষতা,দুর্বলতা সমন্বয়হীনতার সুযোগ বুঝেই জঙ্গী সংগঠনগুলো হামলা করে থাকে। উদাহারণ হিসেবে শ্রীলঙ্কাকে উল্লেখ করে সংগঠনের পক্ষে আরও বলা হয়, এই ঘটনা থেকেও সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। সেই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে সন্ত্রাসী-জঙ্গীবাদ নির্মূলে প্রচুর গবেষণা করে মানবতাকে সুরক্ষা রাখতে যথাযথ উদ্যোগ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। বোয়াফ সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়ের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন লেখক ও কলামিস্ট মাসুম বিল্লাহ নাফি, ব্লগার মারুফ রসুল প্রমুখ।
×