ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

নিরাপদ সড়ক নিয়ে আরও কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৯:০২, ২৯ এপ্রিল ২০১৯

  নিরাপদ সড়ক নিয়ে আরও কিছু কথা

আমি বাংলাদেশের অনেক উপজেলা, জেলা শহর, গ্রাম-নগর-বন্দরে বিভিন্ন রকমের যানবাহন চড়েছি। এখন আমেরিকাতে এসে যখন উন্নত যানবাহনে চলাফেরা করি, তখন ভাবি বাংলাদেশের রাস্তাঘাট যদি এ রকম হতো তাহলে দেশের মানুষ একটু স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারত। তাছাড়া আমার এ লেখা সড়ক নিরাপদ করতে একজন মানুষেরও যদি কাজে লাগে সেই আশা নিয়েই, দিনের শেষে কর্মক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন লিখতে বসি, তখন বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকার রাস্তাগুলোর যানজটের যে অবস্থা চোখের সামনে ভেসে ওঠে- তখন মনে হয়, কবে যে যানজটের উন্নতি হবে। কবে যে দেশের মানুষ শান্তিতে চলাফেরা করতে পারবে। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনেলসের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ যা শুনে গভীর মর্মাহত হই এই ভেবে যে- একটা সম্ভাবনাপূর্ণ তরুণ অকালেই ঘাতকের চাকায় পৃষ্ট হয়ে ঝরে পড়ল। তার চেয়ে আরও মানসিকভাবে আঘাত পাই, যখন আবরার বাবা ব্রিগেডিয়ার (অব.) আরিফ আহ্ম্মদ চৌধুরীকে বলতে শুনি ‘ছেলের এই অকস্মাৎ মর্মান্তিকভাবে চলে যাওয়ায় মনে হলো আমার জীবনের সকল অর্জন যেন ম্লান হয়ে গেল।’ একজন বাবার মর্মবেদনা কি পরিমাণ হলে এই রকম মন্তব্য করতে পারেন তা কেবল সন্তানের বাবা-মায়েরা উপলব্ধি করতে পারবেন। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ঢাকা শহরেই ৭০ হাজার ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলছে। যেহেতু গাড়ির ফিটনেস নেই ধরে নেয়া যায় ড্রাইভারেরও ফিটনেস নেই। ফিটনেসবিহীন ড্রাইভার ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালিয়ে ঢাকা শহরের মানুষের জীবনকে যে কোন সময় শেষ করে দিতে পারে, যে কেউ এর শিকার হতে পারেন। এই ফিটনেসবিহীন গাড়ির মালিক কারা এবং কি পদ্ধতিতে তারা আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকা শহরে এই গাড়িগুলো চালাচ্ছেন, কারা এগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করেন তা বের করা দরকার। তা না হলে তারাই সড়ক নিরাপত্তার জন্য নেয়া যে কোন উদ্যোগকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। তাই এদের অচিরেই আইনের আওতায় এনে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। জানিনা আর কত মানুষ মারলে এগুলো বন্ধ হবে। এই ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ না করা হলে এরা আরও নিরীহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোর মালিকদের নাম ঠিকানা গাড়ির মালিকের নাম এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে জনগণকে জানতে দিন। সাধারণ মানুষকে বাঁচার সুযোগ করে দিন। হয় গাড়িগুলোর চলাচল বন্ধ করেন, না হয় গাড়ির সামনে বা এর গায়ে ফিটনেসবিহীন গাড়ি লিখে দিন তা হলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে এই গাড়ি নিরাপদ নয়, কেউ আর এই গাড়িতে চড়বে না। দেখবেন এই গাড়িগুলো আর রাস্তায় মালিক পক্ষ নামাবেন না। মানুষের সবচেয়ে আগে দরকার নিজের ও ছেলেমেয়েসহ সকলের জীবনের নিরাপত্তা, যদি নিরাপত্তা না থাকে তাহলে উন্নয়নের সুফলকে ভোগ করবে। তখন উন্নয়ন মুখথুবড়ে পড়বে। যাদের জন্য উন্নয়নের এত আয়োজন তারাই যদি নিজে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তাহলে এ উন্নয়নের দরকার কি। কবিগুরু রবি ঠাকুরের তোতা কাহিনীর তোতার মতো কি শেষ পরিণতি দেশের মানুষের ভোগ করতে হবে, কে জানে। এ পর্যন্ত যত সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে তার দুই একটি ঘটনা ছাড়া সবগুলোতে চালককে পাওয়া যায় না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরারের ঘাতক বাসের চালক হেলপার, সহকারী, মালিক সবার নাম এসেছে এবং মালিককেও আইনের আওতায় আনা হয়েছে। দেরিতে হলেও সকল পক্ষকে আইনের আয়তায় আনা হচ্ছে তাই কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ পাবেন। একটা শহরের পরিকল্পনা সুন্দর করে দীর্ঘমেয়াদী করতে হলে, তা করতে হবে সকল বিভাগের সমন্বয়ে। তা না হলে দীর্ঘমেয়াদী ফল বয়ে আনবে না। অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি তৈরি অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বিভিন্ন সংস্থার বিভিন্ন রকমের পাইপলাইন, বিচ্ছিন্নভাবে বসানো, সমন্বয়হীন ড্রেন তৈরির কারণে অল্প বৃষ্টি হলে ঢাকায় বন্যা দেখা দেয়, যেখানে সেখানে বস্তি, বাজার গজে ওঠা, কোথাও যেন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সেদিন টেলিভিশনে যখন বনানী টাওয়ারে আগুন লাগার দৃশ্য দেখছিলাম যে উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে আসা ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা চেষ্টা করছিল তখন হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতির কারণে উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে বেগ পেতে হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন এদের ঠেকাতে পারল না, তাঁরা কেন সময় মতো আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে না কোথায় তাদের দুর্বলতা। পৃথিবীর কোন মানুষ বিপদের সময় এভাবে ভিড় করতে দেখিনি। দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কেন ফিতা দিয়ে এলাকা চিহ্নিত করে মানুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে পারল না এ ব্যাপারে পুলিশের বক্তব্য শোনা দরকার। একেকটি ঘটনা আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে যায় তারপরেও কেন আমরা শিক্ষা নিতে পারি না এখানেই আমাদের দুর্বলতা। প্রত্যেকটি ঘটনা অধিক জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। তাই ঢাকার জনসংখ্যা কিভাবে কমানো যায় সেই দিকে লক্ষ্য রেখে ভবিষ্যতের সকল কর্মসূচী তৈরি করতে হবে। জানা যায়, ঢাকা শহরের অধিকাংশ যান বাহনের মালিক দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাবেক আমলা রাজনীতিক নেতৃবৃন্দ এমনকি যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারের রয়েছে আজমেরী পরিবহন নামক বাস সার্ভিস। সমাজে এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গই পরিবহন সেক্টরের নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাদের স্বার্থেই পরিবহন চলে। অনেকে মনে করেন এই কারণে সরকারের কোন দিক-নির্দেশনাই কার্যকর হচ্ছে না। যারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার কথা তাদের কারও না করার ফিটনেস বিহীন গাড়ি চলছে। একটি শক্তিশালী গ্রুপ প্রতিটি পরিবহন কোম্পানিতে ঢাকা থেকে সকল জেলা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকাসহ জেলা উপজেলা পর্যন্ত সকল স্থানে অসংখ্য ও হরেক রকম নামে পরিবহন শ্রমিক সংগঠন আছে তাদের সঙ্গে একশ্রেণীর স্থানীয় নেতা এবং পুলিশের সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিদিন এই পরিবহন শ্রমিক নামের সংগঠনের সদস্যরা প্রতিটি যানবাহনের কাছ থেকে প্রতি ট্রিপে (ক্ষেপ) কি পরিমাণ চাঁদা নেয় তা চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। এই চাঁদাবাজরাই পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করে। তারা এমনভাবে পরিবহন জগতে প্রতিষ্ঠিত এবং ক্ষমতাবান তা বোঝা যায় পরিবহন ধর্মঘট চলাকালে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি এরাই নিয়ন্ত্রণ করে। যখনই ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া হবে তখনই তারা ধর্মঘটের ডাক দেবে, তাই একসঙ্গে বন্ধ না করে একেক সড়কে একেক দিন বন্ধ করতে হবে এবং ধর্মঘট মোকাবিলা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি রাখতে হবে। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ২০১১ সালে ৯ সদস্যের একটি উপ-কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি ৫২ দফা স্বল্পমেয়াদী, ১৪টি মধ্যম মেয়াদী এবং ২০টি দীর্ঘমেয়াদীসহ মোট ৮৬টি সুপারিশ প্রণয়ন করে। ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস ব্যবস্থাপনা ও গণপরিবহন চলাচল সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নে ২০১৭ সালের এপ্রিলেও একটি কমিটি গঠন করা হয়। কয়েকটি সভা করে ৬টি সুপারিশ দেয়া হয় এবং ২২টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়েছে কি-না জানা যায়নি। পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি সাবেক মন্ত্রী শাহজাহান খানের প্রণিত ১১১টি সুপারিশ এবং দেশবাসীর মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করার জরুরী ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং এর সঙ্গে সড়ক পথে যত অনিয়ম চলমান তা চিরতরে নির্মূল করতে হবে। এখন আগে থেকে দেয়া যাদের বিভিন্ন কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল তাদের কাছ থেকে জবাব নিতে হবে। জানতে হবে কোন কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে, কোনগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ, প্রতিটি সুপারিশ কোন সংস্থা বাস্তবায়ন করবে তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। পরিবহন শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে মালিক সংগঠন, স্থানীয় প্রভাবশালী, মালিক সমিতির সদস্য, পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারী-বেসরকারী আমলা, পুলিশসহ সকল সদস্যই চাঁদাবাজির সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এসব বন্ধ করা গেলে সড়কে মৃত্যুর হার কমানো যাবে। লেখক : আহ্বায়ক: ক্যাম্পেন ফর রোড সেফ্টি, নিউইয়র্ক
×