ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর রান্নার বিবর্তন

প্রকাশিত: ০৮:১৭, ২৯ এপ্রিল ২০১৯

 বাঙালীর রান্নার বিবর্তন

প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন। চাঁদ সওদাগরের বাড়িতে সানাই বাজছে। তার বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে এসেছে বেহুলা। সওদাগর বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানে বড় বড় কটাহ বা কড়াইয়ে, হাঁড়িতে কাঠের আগুনে রান্না হচ্ছে দেদার। রান্না হয়েছে ১৮ ধরনের মাছের পদ বেসন দিয়ে চিতল মাছের কোল ভাজা, মাগুর মাছ দিয়ে মরিচের ঝোল, বড় বড় কৈ মাছে কাটার দাগ দিয়ে জিরা-লবঙ্গ মাখিয়া তেলে ভাজা, মহাশোলের অম্বল, ইচা (চিংড়ি) মাছের রসলাস, রোহিত মাছের মাথা দিয়ে মাস কলাইয়ের ডাল, আম দিয়ে কাতলা মাছ, পাবদা মাছ ও আদা দিয়ে শুকতুনি, আমচুর দিয়ে শোল মাছের পোনা, তেঁতুল মরিচসহ বোয়াল মাছের ঝাঁটি, ইলিশ মাছ ভাজা, বাচা, ইচা, শোল, শোলপোনা, ভাঙ্গনা, রিঠা ও পুঠা (পুঁটি) মাছ ভাজা। বাঙালী বাড়ি, অতিথিদের মাংস না খাওয়ালে চলে? তাই খাসি, হরিণ, মেষ, কবুতর, কাউঠা (ছোট কচ্ছপ) প্রভৃতির মাংস দিয়ে রান্না হয়েছে নানাবিধ ব্যঞ্জন ও অম্বল। চাঁদ সওদাগরের বাড়ির এই বিবরণ থেকে উচ্চবিত্ত বাঙালীর খাবারের কিছুটা হদিস পাওয়া যায়। সময়রেখা ধরে আর একটু পিছিয়ে গেলে প্রাকৃতপৈঙ্গল থেকে জানা যায়, ফেনা ওঠা ভাত, যা খাওয়া হতো কলা পাতায়, তাতে থাকতো গাওয়া ঘি, পাট শাক, ময়না/মৌরালা মাছ আর সঙ্গে দুধ। মোটামুটি এই হলো সাধারণ মানুষের খাবারের প্রাচীনতম নমুনা। ভাত তর্কাতীতভাবে বাঙালীর আদি ও অকৃত্রিম খাবার। সঙ্গে বিভিন্ন শাক, সবজি আর মাছ। মাংস খাবার প্রচলনও ছিল। ছিল মুড়ি, মুড়কি, দই, চিড়া, বিভিন্ন রকম পিঠা, মিষ্টি, ফল, বিভিন্ন ধরনের কাসুন্দী, তৈলা¤্র বা আমের আচার ইত্যাদি। নদীমাতৃক প্রাচীন বাংলার জীবন ব্যবস্থা ছিল কৃষিপ্রধান, ফলে সাধারণত যূথবদ্ধ। স্বাভাবিকভাবে তার রান্নাঘর ছিল আয়তনে বড়। আয়োজন ছিল বিশাল। গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ আর গোয়াল ভরা গরুর যে প্রবাদ বাঙালীর মুখে মুখে ফেরে, সেটা নিহায়ত বাতুলতা ছিল না। এ কারণে গ্রামীণ জনপদে রান্নার পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি। তবে বিভিন্ন কারণে বাঙালী রান্নার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে মূলত নগরে। স্থূলভাবে ১২০০-১৮৫৮ সাল, এই প্রায় সাড়ে ছয় শ’ বছর কালপর্বে ভারতবর্ষে দুটি মোটাদাগের পরিবর্তন ঘটে। তার একটি হলো সেলাই করা বস্ত্রের আমদানি আর অন্যটি নতুন ধরনের খাবার। পার্সী, তুর্কি, আফগান, আরবরা তখন প্রায় পুরো ভরতের দখল নিয়ে রাজ্যবিস্তারের পাশাপাশি ধর্ম, পোশাক আর খাদ্যেরও বিস্তার করে চলেছে। এরই মাঝে ১৫১৬ সালে বাংলায় আসে পর্তুগীজরা, ১৬০৮ সালে আসে ইংরেজরা, ১৬৩০ সালে ওলন্দাজরা আর ১৬৭৪ সালে ফরাসিরা। মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায়, ১৬১০ (মতান্তরে ১৬০৮) সালে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানীর মর্যাদা পায়। এ ঘটনা বাংলার রান্নার ভূগোল পাল্টে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। উল্লিখিত সময়ে পুরো বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠে ভিনদেশী মানুষের নতুন নতুন জনপদ। আর সেইসব জনপদ থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে নতুন নতুন খাবারের খোসবাই। স্থানীয় ও বিদেশীরা পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করতে থাকে তাদের বিভিন্ন খাবার। শুরু হয় বাঙালীর ভাতের বদলে কোফতা, বিরিয়ানির স্বাদ নেয়ার পালা, মাংসের তরকারিতে ডুমো ডুমো আলু মিশিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে ঝাল ঝাল ঝোল খাওয়া, বেকারির রুটি আর কেক-পেস্ট্রি খাওয়া, আম আর বেল ‘পানা’র পরিবর্তে গোলাপজল মেশানো ‘শরবত’ পান করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে রাজধানী হিসেবে ঢাকার আত্মপ্রকাশের ফলে নগর ঢাকা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বাড়তে থাকে ঢাকার এবং নগর হিসেবে ঢাকা ধারণ করতে থাকে ‘কসমোপলিটন’ বৈশিষ্ট্য। এই কসমোপলিটন নগরের মানুষ এক মিশ্র জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। ফলে মুঘল রান্নার মসলাদার খাবারের সুঘ্রাণ যেমন যেতে থাকে পর্তুগীজ হেঁশেলে, তেমনি পর্তুগীজদের হাত ধরে বাঙালী রান্নায় ঢুকে যায় মরিচ আর আলু, বেকারির রুটি, কেক-পেস্ট্রি, জ্যাম-জেলি আর চাটনি। আনারস, পেয়ারা, আতা, লিচু, টম্যাটো ইত্যাদি সুস্বাদু ফল ও সব্জি জায়গা করে নেয় আম-কাঁঠাল-জাম-জামরুলের পাশে। ধির পায়ে বাংলায় আসে বিলেতি সাহেবরা। তাদের সঙ্গে আসে তাদের পছন্দসই খাবারদাবার, আদবকেতা। তবে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে রাজনৈতিক মেরুকরণে যেহেতু ইংরেজরা শেষপর্যন্ত টিকে যায়, তাই খাদ্যসংস্কৃতিতে তাদের প্রভাবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে। আবার দীর্ঘদিনের চর্চিত মোঘল, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ ইত্যাদি জাতির খাবারের প্রভাবও ছিলো বাঙালী হেঁশেলে, তাই সেগুলোও একেবারে বাদ পড়লো না। ঢাকার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে প্রথম দিকে বাঙালী খাবারে মোঘলদের খাদ্যসংস্কৃতির প্রভাবের বিষয়টি আমাদের চোখে পড়ে। এখনও পুরান ঢাকার মোগলাই খাবারের বৈচিত্র্য আমাদের সে কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ছাড়া পর্তুগীজসহ ফরাসী-ইংরেজ ইত্যাদি জাতির খাবারের ভগ্নাবশেষ খুঁজলেই পাওয়া যায় বাঙালীর রান্নাঘরে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তৈরি হওয়া স্থানীয় বাঙালী অভিজাত শ্রেণী মূলত সেইসব খাবারের অনুকরণ করেছে একটা দীর্ঘ সময়। ফলে বাঙালী রান্নার ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে মোগলাই, পর্তুগীজ, ফরাসী বা ইংরেজ রান্না। আমরা আগেই বলেছি, বাংলার কৃষিপ্রধান ও যূথবদ্ধ জীবন ব্যবস্থায় রান্নাঘর ছিল আয়তনে বড়। তাতে রান্না হতো দু’মুখো, তিন মুখো কখনোবা এক মুখো মাটির উনুনে, শুকনো বাঁশ-কাঠ, গাছের শুকনো পাতা অথবা পাঠকাঠির আগুনে। সাধারণ মানুষ রান্না ও খাওয়ার কাজে ব্যবহার করতো মাটির বাসনকোসন। এ কাজে কাঁসাপিতলের তৈজস ব্যবহৃত হতো উচ্চবিত্তের ঘরে। এইসব বাসনকোসনে বা তৈজসে রান্না হতো বিভিন্ন ব্যঞ্জনসহযোগে শ্বেত শুভ্র সুসিদ্ধ ভাত। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থনৈতিক কারণে সারা পৃথিবীর মতো বাঙালীর পারিবারিক জীবনেও বাজতে থাকে ভাঙ্গনের সুর। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গড়ে উঠতে থাকে ‘একক’ পরিবার। ফলে রান্নাঘর হয়ে পড়ে সংকুচিত, কমতে থাকে রান্না করা পদের সংখ্যা। এর ফলে ‘রান্নাঘর’ বা ‘পাকশালা’ শব্দের যে ব্যাপ্তি তা সংকুচিত হয়ে ঢুকে পড়ে শহুরে মধ্যবিত্তর ফ্ল্যাটবাড়ির ‘কিচেনে’। বাজারসদাই ভাড়ার ঘরের পরিবর্তে ঢুকতে থাকে রেফ্রিজারেটরের শীতলতায়। ‘সময় নেই’ এর অজুহাতে বাড়িতে মুড়ি ভাজা, চিড়ে কোটা, মোয়া বানানো, দইপাতা বন্ধ হয়ে বাঙালীর ডাইনিং টেবিলে উঠে আসে বাটার টোস্ট, ডিমের ‘মামলেট’র জায়গায় সানি সাইটআপ কিংবা হানি ব্রেড, বানানা। এরপর থেকে বাঙালী মধ্যাহ্নে আর ভোজ সারে না, লাঞ্চ করে; রাতে খায় ডিনার।
×