ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দেশে নিষিদ্ধ বিট কয়েনের রমরমা বাজার!

প্রকাশিত: ১২:০৩, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

দেশে নিষিদ্ধ বিট কয়েনের রমরমা বাজার!

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নিষিদ্ধ বিট কয়েনের (মুদ্রার অবৈধ ভার্চুয়াল বিনিময় পদ্ধতি ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ বা সাংকেতিক মুদ্রা) গোপন বাজার এখন অনেকটাই রমরমা। লেনদেনকারী তার আসল নাম-ঠিকানা ব্যবহার করছেন না। বেশিরভাগ আর্থিক লেনদেন হয় ছদ্মনামে। তালিকায় আছেন একদল দক্ষ সাইবার অপরাধী। যাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ও বাইরের বহু দেশের সাইবার অপরাধী চক্রের যোগসূত্রের তথ্য পাওয়া গেছে। এ চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে দেশে এই অপরাধের যোগসূত্র বের করেছে সাইবার ক্রাইম পুলিশ বগুড়ার সদস্যরা। হবিগঞ্জ ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দুদিন টানা অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারদের কাছ থেকে ভার্চুয়াল মুদ্রা কেনাবেচার কাজে ব্যবহৃত দুটি ল্যাপটপ, ১৬টি মোবাইল, ২০টি সিম উদ্ধার ও লেনদেনের কাজে ব্যবহৃত দুটি ওয়েবসাইট শনাক্ত করা হয়েছে। বগুড়ার সাইবার পুলিশ সূত্র জানায়, অনলাইনে ভার্চুয়াল মুদ্রায় লেনদেন করার ক্ষেত্রে সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ক্ষেত্রে বিটকয়েনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশের মাধ্যমে বিষয়টি সাধারণ মানুষের নজরে আনার চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিটকয়েন এক ধরনের ক্রিপ্টোকারেন্সি (সাংকেতিক মুদ্রা) বা ভার্চুয়াল মুদ্রা। মুদ্রাটির দাম ওঠা-নামার মধ্যেই রয়েছে। যদিও বাস্তবে এর অস্তিত্ব নেই। ইন্টারনেট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রোগ্রামিং করা আছে যেটি চাইলে কেনা যায়। ইন্টারনেট সিস্টেমকে ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি এটি গড়ে তুলেছেন। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়, এটা এক ধরনের জুয়া খেলার মতো, যেটার ভিত্তিতে টাকা খাটিয়ে লাভজনক কিছু করা যেতে পারে। সেজন্য অনেক মানুষ সেদিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। শুক্রবার দুপুরে বগুড়ার পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঞা বলেন, সাইবার পুলিশ বগুড়ার ইন্সপেক্টর এমরান মাহমুদ তুহিনের নেতৃত্বে একটি টিম গত ২৩ ও ২৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর ও লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এ চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করে। তারা হলেন- হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার আন্দিউড়া গ্রামের আহসান হাবিব ওরফে শাহ তাসনিম (২২), একই গ্রামের সোহেল মিয়া ওরফে কাজি সোহেল (২৭) এবং লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার উলফাতনগর গ্রামের মাসুম হোসাইন ওরফে মারুফ বিল্লাহ (২৫)। প্রত্যেককে তাদের নিজ নিজ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভুঁঞা বলেন, অনলাইনে যেসব ডিজিটাল মুদ্রা পাওয়া যায় সেগুলোকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বলে। এই ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রানজেকশনের সময় আদান-প্রদানকারীদের তথ্য গোপন থাকে। বেশির ভাগ সময়েই থাকে অজ্ঞাত। এ ধরনের মুদ্রার বিনিময়ে ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি নামের একটি পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে প্রচলিত ভাষা বা সংকেতের লেখা তথ্য এমন একটি কোডে লেখা হয়, যা ভেঙ্গে তথ্যের নাগাল পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ফলে বাংলাদেশে এসব ক্রিপ্টোকারেন্সি জুয়া খেলা বা কালো টাকাকে সরকারের চোখ থেকে লুকানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। একই সঙ্গে গুপ্তহত্যার লেনদেনও এ পদ্ধতিতে করা হয়। গ্রেফতার হওয়া এই চক্র িি.িবধংুঢ়ধরফ.পড়স এবং িি.িনফফড়ষষধৎপধংয.পড়স নামের দুটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবৎ লেনদেন করে আসছিল। বাংলাদেশে অবৈধ এসব ক্রিপ্টোকারেন্সির মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যবান বিটকয়েন। এ ছাড়া স্ক্রিল, লাইটকয়েন, ওয়েবমানি, নেটেলার, ইথিরিয়াম, পারফেক্ট মানি কেনাবেচা করা হতো। অনেকেই তাই বেশি লাভের আশায় বিটকয়েন কিনে রাখেন, দাম বাড়লে বিক্রির আশায় এই ব্যবসায় ঝুঁকছেন। বিপিএল এবং আইপিএল এর সময় ‘বেট ৩৬৫’সহ আন্তর্জাতিক অনলাইনে জুয়ার আসরে অংশ নিতেও বাংলাদেশ থেকে এসব ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচার হিড়িক পড়ে যায়। এ ছাড়া এসব ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে ডার্কওয়াভসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিশ্বেরর যে কোন প্রান্তে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন করা হয়। যেসব অর্থ অপরাধ সংঘটনের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। গ্রেফতাররা পুলিশকে জানিয়েছেন, তাদের ওয়েবসাইট দুটির মাধ্যমে অনলাইন ওয়ালেট হিসেবে ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাদের গ্রাহক সংখ্যা সাত হাজার ৩৬২ জন এবং এ পর্যন্ত তারা ২৭ হাজার আটশরও অধিক লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। তাদের কাছ থেকে বিকাশ, রকেট এবং কিছু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এ্যাকাউন্ট পাওয়া গেছে। গ্রাহকদের সঙ্গে এসব মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করা হতো। পুলিশ বলছে, প্রথমপর্যায়ে তাদের এসব মোবাইল এ্যাকাউন্টে সাত লক্ষাধিক টাকা পাওয়া গেছে। অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের টাকা তারা এ সকল এ্যাকাউন্টে জমা রাখত। অনেক সময় গ্রাহকের টাকা নিয়ে কারেন্সি না দিয়ে মোটা অংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন। এ চক্রের সঙ্গে আরও কয়েকজন জড়িত বলে তারা জানিয়েছেন। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩০ এর ১ (খ) ধারায় মামলা হয়েছে। গোয়েন্দারা অনুসন্ধানে জেনেছেন যে, নিষিদ্ধ এ সিস্টেমের সঙ্গে জড়িতদের তালিকায় আছেন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, মাফিয়া শ্রেণীর স্বর্ণ ও মাদক পাচারকারী, হুন্ডি ব্যবসায়ীসহ আরও সুবিধাভোগী শ্রেণীর লোকজন। বিট কয়েনের লেনদেনের ফলে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। আবার অর্থ আসছেও বিভিন্ন দেশ থেকে। সাইবার বিশেষজ্ঞদের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামের একদল সফটওয়্যার ডেভেলপার নতুন ধরনের ভার্চুয়াল মুদ্রা বা ‘ক্রিপ্টোকারেন্সি’ প্রচলন করে। এর নাম দেয়া হয় বিট কয়েন। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে দুজন ব্যবহারকারীর মধ্যে এটি সরাসরি (পিয়ার-টু-পিয়ার) আদান-প্রদান হয়। নিজের পরিচয় প্রকাশ না করে এ পদ্ধতিতে লেনদেন করা যায়। লেনদেনটি যে সার্ভারে সুরক্ষিত থাকে সেটির নাম হলো মাইনার। এ মাইনারের মাধ্যমে বিট কয়েন তৈরি হয়। একটি লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন বিট কয়েন তৈরি হয়। বিট কয়েন মূলত ইন্টারনেট সিস্টেমে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কে প্রোগ্রামিং করা আছে, যা চাইলে কেনা যায়। তবে এটি কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা কোন দেশের জারি করা মুদ্রা নয়। ইন্টারনেট সিস্টেমকে ব্যবহার করে কিছু ব্যক্তি এই সিস্টেমকে ডেভেলপ করেছে, যা দিনের পর দিন জনপ্রিয় হতে থাকে। বগুড়ার পুলিশ সুপার বলেন, বিট কয়েন উৎপন্ন হওয়ার পর তা গ্রাহকের ডিজিটাল ওয়ালেটে থাকে। সেই কয়েন দিয়ে কোন পণ্য কেনা হলে তা বিক্রেতার এ্যাকাউন্টে পাঠানো হয়। বিক্রেতা পরবর্তী সময়ে সেই বিট কয়েন দিয়ে পুনরায় পণ্য কিনতে পারেন। আবার সমান পরিমাণ বিট কয়েন ক্রেতার লেজার থেকে কমিয়ে দেয়া হয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জারি করা এক নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, বিট কয়েনের আইনী কোন ভিত্তি নেই। ঝুঁকি এড়াতে এ দিয়ে লেনদেন কিংবা এর প্রসারে সহায়তা কিংবা প্রচার থেকে বিরত থাকতে সবাইকে অনুরোধ করা হয়।
×