ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পুতুল খেলার দিন, মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

পুতুল খেলার দিন, মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া শৈশব

মোরসালিন মিজান ॥ মাটির পুতুল। বিভিন্ন আকারের। আকৃতির। কোন কোন গড়ন খুব চেনা। সেই শৈশবে দেখা হয়েছিল। মনে পড়ে যায়। না, এ জন্য মেয়ে হওয়া জরুরী নয়। ছেলেরাও পুতুল খেলার অংশ। জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত প্রদর্শনী মধুর সেই স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। টেপা পুতুলের ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে শহুরেদের জানার সুযোগ করে দিয়েছেন আয়োজকরা। নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে এই প্রদর্শনী। সাম্প্রতিক সংগ্রহ হিসেবে এতে স্থান পেয়েছে ৫৩৪টি পুতুল। ময়মনসিংহ বিভাগের ছয় জেলা ঘুরে পুতুলগুলো সংগ্রহ করেছেন চিত্রশিল্পী সামিনা নাফিজ। মূলত তার সংগ্রহ নিয়েই প্রদর্শনী। তবে আরও একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহ করা বেশ কিছু পুতুল দিয়ে সাজানো হয়েছে আলাদা কর্নার। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশেষ কর্নার প্রদর্শনীর গুরুত্ব আরও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। সমৃদ্ধ করেছে আয়োজনটিকে। দর্শনার্থীরা একই ছাদের নিচে পুতুলের একাল এবং সেকাল দেখার সুযোগ পেয়েছেন। জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহের কথা আগে বলা যাক। সংশ্লিষ্টরা জানেন, শিল্পাচার্য বাংলার লোকঐতিহ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে গ্রামীণ আর্ট ফর্ম সংগ্রহ করতেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে অন্যদের হয়ত একটি বার্তা দিতে চাইতেন। বলতে চাইতেন, নিজের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ভালবাস। বাঁচিয়ে রাখ। উর্ধে তুলে ধর। শিল্পাচার্যের আবেগ ভালবাসা এবং দায়িত্বশীলতার স্মারক হয়ে প্রদর্শনীতে এসেছে পুতুলগুলো। একাধিক গ্লাস শোকেসে ৪১টি টেপা পুতুল। এসবে মাটিসংলগ্ন মানুষের সরল চিন্তা। সহজ বহির্প্রকাশ। অধিকাংশ পুতুলের শরীর অমসৃণ। আগুনে পোড়া মাটি পুরনো হতে হতে অমূল্য প্রতœসম্পদের চেহারা পেয়েছে। জাদুঘরের সংরক্ষিত নিদর্শনের মতো মনে হয়। বেশ কয়েকটি ট্র্যাডিশনাল পুতুল। কোন কোনটির গা অলঙ্কৃত করা হয়েছে। ছোট্ট পরিসরে অনেক কাজ। আছে পাখি, মাছ, চাকাওয়ালা ঘোড়ায় আদি ফর্ম। পুতুলগুলোর গড়ন ও বৈশিষ্ট্য অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। কোন কোন পুতুলের ফর্ম জয়নুল আবেদিন নিজের আঁকা ছবিতে চমৎকার ব্যবহার করেছেন। পুতুলের দিকে তাকিয়ে সেটি বোঝা যায়। বোধ করি শিল্পাচার্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই নিজের কালে তৈরি হওয়া পুতুল সংগ্রহে মন দিয়েছেন সামিনা নাফিজ। গ্যালারিতেই পাওয়া যাচ্ছে তাকে। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, পুতুল সংগ্রহের জন্য ময়মনসিংহ বিভাগের ছয় জেলাকে প্রাথমিকভাবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। গত তিন/চার বছর স্থানীয় মেলায় উৎসবে সশরীরে হাজির হয়ে পুতুল সংগ্রহ করেছেন। গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে এমন ৫৩৪টি। জেলাভিত্তিক ভাগ করে পুতুলগুলো সাজানো হয়েছে। এর ফলে কোন্ জেলার পুতুলের কী বৈশিষ্ট্য, গড়নের দিক থেকে কেমন পার্থক্য আগ্রহীরা তা বিষদে জানতে পারছেন। একটি গ্লাস শোকেসে দেখা গেল শুধু নেত্রকোনা অঞ্চলের পুতুল। এখানে নারী প্রতিমা। সিং উঁচু করে তেড়ে আসা ষাঁড়। হাতি। কিছু কিছু পুতুলের গায়ে আবার উজ্জ্বল রং করা। পুতুলগুলো তৈরি করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারী শিল্পীরা। নিশা রানী পাল, সরস্বতী পাল, শিখা রানী পাল, বাসন্তী রানী পাল, রমা রানী পালের বয়স হলেও চর্চা থামাননি বলে জানা যায়। আরেকটি গ্ল্যাস শোকেসে করিমগঞ্জের পুতুল। এগুলোর গা ঘষে বেশ মসৃণ করা হয়েছে। মাটির চেনা রং হলেও বেশ গাঢ় দেখতে। পাখি, ময়ূরসহ কিছু ক্ষুদ্রাকৃতির কাজ আ॥ে আকর্ষণ করে খুব। কিছু পুতুল আবার ছাঁচে তৈরি। রতি রঞ্জন এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু কাজ করেছেন। মুক্তাগাছা থেকে সংগ্রহ করা পুতুলের কয়েকটিতে আদি রূপটা খুঁজে পাওয়া যায়। কিছু আবার নবনির্মাণ। জামালপুরের পুতুল বিশেষ একটা ফিল দেয়। পুরনো রাজবাড়ির দেয়ালে, সীমানা প্রাচীরে কিংবা প্রবেশদ্বারে ব্যবহার করা ঘোড়া বা সিংহ মূর্তির অনরূপ আকৃতি খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। মনে হয় দেয়াল থেকে খসে পড়া কোন টেরাকোটা শিল্পকর্ম। তরাইলের পুতুল আবার আকারে বেশ বড়। এখানে দুটি চিত্রিত গরু শিল্পীর বর্তমান প্রবণতাকে তুলে ধরছে বলেই মনে হয়। অধিকাংশ জেলার পুতুলে সন্ধান মেলে গ্রামীণ নারীর দৈনন্দিন জীবন। ঘরগৃহস্থালি। কেউ মাছ কুটছে, ধান ভানছে, কেউ এমনকি মসলা বাটায় ব্যস্ত। তবে খেলার যে পুতুল, বিয়ে দেয়ার যে পুতুল তা তৈরি হয় সব জেলাতেই। এগুলো দেখতে দেখতে পুতুলখেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায় শৈশব। গ্যালারিতে কথা হচ্ছিল সংগ্রাহক সামিনা নাফিজের সঙ্গে। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলছিলেন, তারও শৈশবের স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেয় মাটির পুতুল। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে পুতুল তৈরি হচ্ছে। তবে শিল্পীদের টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। ভাল বিক্রির আশায় কেউ কেউ নিজস্ব ঢং বাদ দিয়ে অন্যেরটা কপি করছেন। এভাবে কিছু স্বকীয়তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিষয়গুলো নিয়ে জরুরী ভিত্তিতে কাজ করা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। প্রদর্শনী আজ রবিবার পর্যন্ত চলবে।
×