ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হামলার হোতা

কট্টর মতবাদের কারণে বার বার বহিষ্কৃত হন জাহরান

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

কট্টর মতবাদের কারণে বার বার বহিষ্কৃত হন জাহরান

শ্রীলঙ্কায় এক দশকের মধ্যে ভয়াবহ বোমা হামলার ‘হোতা’ মোহাম্মদ হাশিম মোহাম্মদ জাহরান নিজের কট্টর মতের কারণে বার বার নানা জায়গা থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। ভারত মহাসগারের তীরের ছোট্ট দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কার কাত্তানকুড়িতে দুই কক্ষের একটি বাড়িতে পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন জাহরানের পিতা-মাতা। জাহরানের বাবা রাস্তায় রাস্তায় খাবার বিক্রি করতেন। মাঝে মধ্যেই যার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উঠতো। খবর ওয়েবসাইট ১২ বছর বয়সে জাহরান ‘জামিয়াতুল ফালাহ এ্যারাবিক স্কুল এ্যান্ড কলেজ’ এ লেখাপড়া শুরু করেন। জাহরানের জন্য তার বাবা তেমন কিছু করতেন না বলে জানান কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল এস. এম. আলিয়ার। নিজের অসাধারণ স্মরণশক্তি দিয়ে শুরুর দিকে শিক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন ছোট্ট জাহরান। সেখানে তিন বছরে তিনি মুসলসমানদের ধর্মগ্রন্থ কোরান মুখস্ত করে হাফেজ হন। তারপর তিনি ইসলামী আইন নিয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। কিন্তু দিন দিন শিক্ষকদের সঙ্গে জাহরানের মতবিরোধ বাড়তে থাকে। আলিয়ার বলেন, শিক্ষকরা কোরানের উদার ব্যাখ্যা করতেন, যেটা জাহরানের পছন্দ ছিল না। সে চরমপন্থী ইসলামের দিকে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে, ‘শিক্ষকদের সঙ্গে তর্ক করা শুরু করে। দিন দিন সে এতটাই অবাধ্য হয়ে উঠছিল যে আমরা তাকে স্কুল থেকে বের করে দেই। আলিয়ারের বয়স এখন ৭৩। এখনও তিনি ২০০৫ সালে জাহরানকে স্কুল থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা স্পষ্ট মনে করতে পারেন। তিনি বলেন, ‘তার বাবা আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেন ‘সে কোথায় যাবে?’। এক সময় একগুঁয়ে জাহরানকে শিক্ষকরা ভুলে গিয়েছিলেন। আবার তারা জাহরানের নাম শুনলেন, যখন পুরো বিশ্ব তার নাম জানে। গত ২১ এপ্রিল ইস্টার সানডের পূর্বে শ্রীলঙ্কার তিনটি গির্জা ও চারটি অভিজাত হোটেলে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৫৩ জন নিহত হয়, আহত হয় পাঁচ শতাধিক মানুষ। এক দশক আগে দীর্ঘ ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধ অবসানের পর ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে একদিনে এত রক্ত ঝরেনি। শ্রীলঙ্কা সরকারের ধারণা, ভয়ঙ্কর ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী জাহরান। যে নিজেও হামলায় অংশ নিয়েছে। জাহরান শাংরি লা হোটেলে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে বলে জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট মৈত্রীপালা সিরিসেনা। মোট নয় আত্মঘাতী হামলাকারী ওই দিন আট জায়গায় হামলা চালায়। তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, হামলাকারীরা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা এবং উচ্চশিক্ষিত। তাদের কেউ কেউ বিদেশেও লেখাপড়া করেছেন; ব্যতিক্রম একমাত্র জাহরান। ‘বখে যাওয়া এক তরুণ’॥ জাহরান ২০০৫ সালে স্কুল থেকে বহিষ্কার হওয়ার পর নিজের শহর কাত্তানকুড়িতে ফিরে যান। রাজধানী কলম্বো থেকে সড়ক পথে কাত্তানকুড়ি যেতে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। অসংখ্য তালগাছ, সড়কের পাশে বুদ্ধমূর্তি আর ঝোপের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়ার হাতির শহর কাত্তানকুড়িতে ৪০ হাজার মানুষের বাস। বিশ্ব মানচিত্রে শ্রীলঙ্কার পূর্ব উপকূলে বিন্দুর মতো দেখতে শহরটিতে স্কুল থেকে বহিষ্কার এক সদ্য তরুণের কোন ভবিষ্যত ছিল না। ২০০৬ সালে জাহরান ‘দারুল আথার’ নামে একটি মসজিদে যোগ দেন এবং সেটির ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হন। কিন্তু তিন বছর পর তাকে সেখান থেকেও বের করে দেয়া হয়। মসজিদের ইমাম এম.টি.এম. ফাওয়াজ বলেন, ‘তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন, বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শ না নিয়ে তিনি নিজের ইচ্ছামত বয়ান করতে চাইতেন।’ জাহরান কট্টর রক্ষণশীল ছিলেন বলেও জানান তিনি। বলেন, এমনকি নারীদের চুড়ি ও কানের দুল পরা নিয়েও তার ঘোর আপত্তি ছিল। ‘আমাদের বাকিরা সমাজের নেতা হিসেবে সকলের জন্য কথা বলতেন। কিন্তু জাহরান শুধু নিজের বিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে চাইতো। ‘সে একটা কুলাঙ্গার ছিল যাকে খোলা ছেড়ে দেয়া হয়েছিল।’ ২০০৯ সালে মসজিদ কমিটি জাহরানের বয়ান দেয়ার ওপর তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। মসজিদ কমিটির প্রধান মোহাম্মদ ইসমাইল মোহাম্মদ নওশাদ বলেন, ‘আমরা তাকে বিগড়ে যাওয়া যুবা হিসেবে বিবেচনা করতাম, যে খুব সঙ্কীর্ণ মনের ছিল এবং সবসময় সমস্যার কারণ হতো।’ মসজিদ থেকে জাহরানকে বের করে দেয়ার পর তিনি একদল অনুসারী জোগাড় করেন, যারা একটি কুঁড়েঘরে বৈঠক করতেন বলেও জানান ইমাম ফাওয়াজ। ২৩ বছরের জাহরান কলম্বো উপকণ্ঠের একটি ছোট্ট শহরে বিয়ে করেন এবং স্ত্রীকে কাত্তানকুড়িতে নিয়ে আসেন।
×