ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ চোখ খুলে দেয়া ছোট দেশের বড় মনের প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৮:৪৮, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

সিডনির মেলব্যাগ ॥ চোখ খুলে দেয়া ছোট দেশের বড় মনের প্রধানমন্ত্রী

লোটে শেরিং আমাদের মন জয় করলেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বয়সে তরুণ। আমাদের দেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। সাধারণ ডাক্তার না হয়ে সে দেশের রাজনীতিতে নতুন দল গঠন করে আজ তিনি প্রধানমন্ত্রী। বাংলা নববর্ষের দিন মেডিক্যাল কলেজ মিলনায়তনে আয়োজিত বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাবেক সহপাঠী আর শিক্ষকদের সামনে পেয়ে তিনি মেলে ধরলেন স্মৃতির ঝাঁপি। ১৯৯৯ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এমবিবিএস পাস করা ডাঃ শেরিং আজকের শিক্ষার্থীদের বাংলায় বলেন, ‘ভাল চিকিৎসক হতে হলে আগে একটা ভাল মানুষ হতে হবে। তা না হলে মাঠ ভাল না হলে যাই রোপি (রোপণ করি) না কেন কিছু উঠবে না সেখানে।’ ৫১ বছর বয়সী লোটে শেরিং চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করার জন্য তারুণ্যে প্রায় এক যুগ সময় কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। ময়মনসিংহ মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস করার পর ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্জারিতে নিয়েছেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। দেশে ফিরে প্রায় এক দশক চিকিৎসকের পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ২০১৩ সালে চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন ডাঃ শেরিং। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দল ড্রাক নামরূপ শকবা চমক সৃষ্টি করে, নবেম্বরে তিনি হন ভুটানের নতুন প্রধানমন্ত্রী। ভদ্রলোক তাঁর তারুণ্যকে জয় করেছেন জ্ঞান আর অভিজ্ঞতায়। আমি তো রীতিমতো চমকে গেছি। কি দারুণ তাঁর বলা। শুধু বলাটা না তাঁর কথার ওজনও আছে। চমকে দিয়েছেন এই বলে সরাসরি অনুষ্ঠানে বলছেন কথা শুনে লাভ নেই। তাঁর কথায় চমৎকৃত না হতে অনুরোধ করেছেন তিনি। এটা কি সহজ? আমরা তো ধরেই নিয়েছি নেতা মানে বলবেন আর বকবেন। তাঁদের বকবকানি শুনতে যাওয়া বা শোনাটাই হলো জনগণের কাজ। সে ধারণাটা এখন এত বেশি পোক্ত যে এটাই নিয়ম। সে সমাজে তিনি এ কি কথা বলে গেলেন? বুঝে দেখুন কতটা কাজের লোক হলে এমন করে বলতে পারেন। আমাদের সমাজে এখনও কাজের চেয়ে কথা বেশি। বলতে বলতে নেতারা এমন জায়গায় পৌঁছে গেছেন কাজ হোক বা না হোক কথাই আমাদের পাওনা। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী কি সে জায়গায় চোখ খোলার কাজটা করলেন? এমন নয় যে, এ ধরনের মানুষ প্রথম এলেন বাংলাদেশে। অমর্ত্য সেনের মতো কাজের মানুষও আসেন মাঝে মাঝে। তাঁর কথা শুনে আমরা মুগ্ধ হই হাততালি দেই তারপর ঠিকঠাক মতো ভুলে যাই। কত দেশের সাধারণ জীবনের অসাধারণ মানুষরা আসেন। তাতে কি হয়? দু’একদিন সবাই মাথা নাড়েন মনে করেন আহারে আমরাও এমন হব। তারপর আবার সেই পুরনো বৃত্তের ভেতর ঢুকে পড়া। এই চক্র থেকে কিছুতেই বেরুতে পারছি না আমরা। একটা কথা মানতে হবে আমাদের রাজনীতির মতো পচা আর গন্ধময় কোন বিষয় নেই দেশে। অথচ এটাই এখনও নির্ণায়ক। আপনি সামাজিক মিডিয়ায় চোখ রাখুন। দেখবেন নেতাদের ছবিতেই লাইক আর ভালবাসার হিড়িক। আপনি যদি কোন চাষী বা সাধারণ শ্রমিকের কোন অসাধারণ কাজের কথা তুলে ধরেন বড় জোর দু-একদিন তারপর সেসব হারিয়ে যাবে বিস্মৃতির আঁধারে। কারণ, আমরা বড় বিস্মরণ প্রিয় জাতি। কোন ঘটনাই বেশিদিন মনে রাখার স্বভাব নেই আমাদের। ফলে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে ভুলতেও খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু আমরা শিখব না যে একজন মেধাবী মানুষের নেতৃত্ব আর গৎবাঁধা মানুষের লিডারশিপে কতটা তফাৎ? অনেকেই বলেন, আমাদের সামনে নাকি কোন পথ নেই বদলানোর কোন রাস্তা খোলা নেই। এটা ভুল কথা। পথ আছে। এই যে আমরা গণতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করি এখানে কাজের বাইরে কথার কোন মূল্য নেই। এদেশের নেতা কে হবেন আর কে দেশ শাসন করবেন তার হিসাব কষে দেয় অর্থনীতি। সামাজিক শৃঙ্খলা বা সমাজ নিরাপত্তার বাইরে মানুষের মনে রাজনীতির প্রভাব শূন্য। দিনরাত টিভি বা মিডিয়া ও তাদের প্রমোট করে না। কিছুদিন আগে আমাদের রাজ্যের নির্বাচন হয়ে গেছে। কি নিরুত্তাপ আর কি সাধারণ সে নির্বাচন। ভোট না দিলে যেহেতু জরিমানার ব্যাপার আছে অনিবার্য কারণ ব্যতীত সবাই যায় ভোট দিতে। আমি দিয়ে দিয়েছিলাম দু’দিন আগে। সে ব্যবস্থাও আছে বৈকি। ভোট কারচুপি বলে তো আর কিছু নেই। কেউ নকল ভোটে বাক্স ভরবে না। বা সঠিক ভোট হলেও তা নিয়ে কেউ দেশ জ্বালাতে যাবে না। বলবে না ভোট হয়নি। আবার হতে হবে। গণতান্ত্রিক আচরণকে আঙুল দেখিয়ে চলবে নানা ধরনের অপকর্ম। এসব কারণেই দেশে কথা আর কথা। যে করছে সে বলছে যে করে না সে আরও বেশি বলে। ভুটান তো আমাদের চাইতে অগ্রসর কোন দেশ নয়। এ দেশকে বলা হয় হিমালয়ের কোলে বেসনেট। চীন আর ভারতের কোলে এই দেশটি আস্তে আস্তে নিজের অস্তিত্ব আর আপন বৈশিষ্ট্যে বেড়ে উঠেছে। এই দুই পরাশক্তির কাছে মাথা নোয়াননি তারা। একসময় আমাদের দেশের কিছু রাজনৈতিক দল দেয়াল লিখনে দেশ ভরিয়ে তুলেছিল। তারা লিখত, ভুটান নয় সিকিম নয় এদেশ আমার বাংলাদেশ। সে ভুটান আজ নিজ গৌরবে বেড়ে উঠছে। আমরা এখনও একে ওকে দোষারোপ করে চলেছি। রাজনীতিতে এখনও কেউ পাকিস্তান বা কেউ ভারতের দালাল নামে পরিচিত। সে বেড়াজাল ভেঙ্গে কবে বেরুবো আমরা? আদৌ বেরুতে পারব কি-না কে জানে। না পারলে এই ভুটানও একদিন আমাদের ফেলে সামনে চলে যাবে। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন সম্পাদিত চুক্তির ভেতর আছে বিদ্যুত আমদানি। আলো রফতানি করা এই ছোট দেশ আমাদের আলোকিত করবে যার মানে তাদের আলো দেয়ার শক্তি আছে। আমরাও তাদের দিচ্ছি অনেক কিছু। বলতে গেলে দিচ্ছি বেশি। সে কারণে আমাদের দায়িত্ব কর্তব্যও বেশি। আমরা যদি নিজেদের দায় ও দায়িত্ব বুঝে পথ না চলি শেখ হাসিনা থাকতে থাকতে সবকিছু নিয়ম ও সভ্যতার ভেতর আসতে না পারে পিছিয়ে পড়লেও অবাক হব না একদিন। সামাজিক সুস্থিরতা আর চলমান সমাজই অগ্রগতির পরিচায়ক। সে জায়গায় আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছি। যে নববর্ষ আলোকিত করে লোটে শেরিং আমাদের মন ভরিয়ে যাবেন তার ভেতর এক বড় ধরনের দুঃখবোধও আছে। আমাদের এক কন্যা নির্মম লালসার শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে গেছে কিছুদিন আগে। যা জাতির মনে গভীর বেদনার মতো জেগে আছে। যে মানুষ যে প্রক্রিয়া আর যে লালসা তাকে মেরেছে সে আজ দুনিয়ার দুশমন। দেখবেন এরাই মূলত উন্নতির প্রতিবন্ধক। এরা নিজেদের লোভের বাইরে ভাল কিছু ভাবতেও পারে না। মনগড়া ধর্ম আর মন কল্পিত জুজুরভয় দেখিয়ে মানুষকে বশ করে রাখা তাদের কাজ। এদের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে পারা এখন জরুরী। সব দেশ ও সমাজের কিছু নিয়ম আচার থাকে। তা মানলেই তারা এগুতে পারে। আমরা বাঙালী বাংলাই মোদের শক্তি। যেমনটা লোটে শেরিং ধানম-িতে গিয়ে তাঁর নিয়মানুযায়ী প্রণাম করে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানালেন। মন ভরে গেল দেখতে দেখতে। আমরা কবে কায়মনো বাক্যে বাঙালী হব? আমাদের দেশ ও জাতিকে কবে আমরা সত্যিকারভাবে ভালবেসে সামনে এগিয়ে নেব? এর ভেতরই আছে ভুটানসহ সবাইকে ছাড়িয়ে যাবার শক্তি। আমাদের আতিথেয়তা ধন্য মুগ্ধ লোটে শেরিংকে ধন্যবাদ ভাল একটা অভিজ্ঞতা উপহার দেবার জন্য।
×