ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রীহট্ট ফ্রন্টে পাক জঙ্গী বিমান ভূপাতিত ॥ ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

শ্রীহট্ট ফ্রন্টে পাক জঙ্গী বিমান ভূপাতিত ॥ ২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল দিনটি ছিল বুধবার। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে বিনাশর্তে অস্ত্র সাহায্য ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য প্রতিবেশী দেশসমূহের সরকারের প্রতি আবেদন জানান। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় অবিলম্বে দেশের পূর্বাঞ্চলে গণহত্যা বন্ধ করার আহ্বান জানান। পাকবাহিনী মাধবপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যুহের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। সারাদিন প্রচ- গোলা বিনিময়ের পর গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ ব্যুহ ত্যাগ করে সিলেটের মনতলা নামক স্থানে চলে আসে এবং নতুন করে প্রতিরক্ষা গঠন করে। এ যুদ্ধে পাকবাহিনীর প্রায় ৩০০ জন হতাহত হয়। যুদ্ধে সিপাহী খালেদ এবং সিপাহী শাহজাহান শাহাদাৎ বরণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রামের হেঁয়াকো এলাকা থেকে সরে এসে চিকনছড়া নামক স্থানে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। ভোরে ঢাকার মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা টহলরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। বন্দুকযুদ্ধে ৭ জন গেরিলা যোদ্ধা শহীদ হন। হানাদার ঘাতকরা মিরপুরে এক পৈশাচিক হত্যাকা- চালায়। এ হত্যাকা-ে হানাদারদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় স্থানীয় বিহারীরা। এ ছাড়া অসংখ্য বাঙালীকে পাকসেনারা ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। এদের অধিকাংশই আর পৃথিবীর আলো দেখেনি। পত্রিকায় দেয়া এক বিবৃতিতে শান্তি ও কল্যাণ পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা নুরুজ্জামান কল্যাণ পরিষদের সকল সদস্যকে সেনাবাহিনীর পাশে থেকে মুক্তিবাহিনী নামধারী দুষ্কৃতকারীদের সমূলে উৎখাতের নির্দেশ দেন। তিনি জানান, শত্রুদের প্রশ্রয় দিলে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পাকিস্তান তারা ধ্বংস করে দেবে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হলে আমরা দাসে পরিণত হবো। ভারতীয় হাই কমিশনারকে পাকিস্তানী পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে এনে সতর্কতা ও হুমকি দেয়া হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদের সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, বাংলাদেশে রক্তগঙ্গা বন্ধ করার জন্য বিশ্ব জনমত ও বিশ্বের সর্বত্র শান্তিকামী শক্তিগুলোকে অবিলম্বে তৎপর হতে হবে। আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনরক্ষা করতেই হবে। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা। শিলিগুড়ি থেকে দৈনিক যুগান্তরের নিজস্ব প্রতিনিধির রিপোর্টে বলা হয় মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এই এলাকাটি পশ্চিম দিনাজপুরে রাধিকাপুর সীমান্ত শহর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে সীমান্তের ওপার থেকে এই খবর পাওয়া গেছে। বিরাট এক অঞ্চলজুড়ে মুক্তিসেনারা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করে তুলেছে। কয়েকটি এলাকায় আজ পাকবাহিনীর ওপর তারা অতর্কিত আঘাত হেনেছে। বগুড়া শহরের দক্ষিণ-পূর্বে শেরপুর এলাকায় মুক্তিফৌজে পাক বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য করতোয়া নদী পার হওয়ার সময় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। নিকটবর্তী কাজিপুর এবং হরিপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। কুমিল্লা ফ্রন্টে গঙ্গাসাগর এবং ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী একটা এলাকায় মুক্তি সংগ্রামী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বহু সংখ্যক পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কুচবিহার থেকে প্রাপ্ত একটি খবরে জানা গেছে, হানাদারের কুড়িগ্রাম দখলের চেষ্টা মুক্তিবাহিনী বানচাল করে দিয়েছেন। একটি পাক অগ্রবর্তী বাহিনীর পাঁচজন সৈন্যকে মুক্তি সংগ্রামীরা গুলি করে মেরেছেন এবং ধরলা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই পাক সৈন্যরা হাতে তৈরি নৌকাতে করে ধরলা নদী পার হচ্ছিল। পাক বিমান ভূপাতিত : শিলং থেকে পিটিআই জানাচ্ছে, খাসি পাহাড়াঞ্চল ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের শ্রীহট্ট ফ্রন্টে একদল মুক্তি সংগ্রামী আজ সকালে একটি পাক জঙ্গী বিমানকে গুলি করে ভূ-পাতিত করেছে। বিমানটি হরিপুরে সার কারখানার দিকে যাচ্ছিল। এই দিন যুগান্তর এ প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, গোয়ালন্দে অন্যুন এক শ’ পাকসৈন্য নিহত। বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সমিতির সভাপতি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সহ-সভাপতি গোপাল হালদার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিষ্ণু দে, মনোজ বসু, সরযুবালা দেবী, সুচিত্রা মিত্র, সুশোভন সরকার ও সম্পাদক দীপেন্দ্র নাথ চট্টোপাধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি চেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এই দিন দৈনিক যুগান্তর পিটিআই-এর বরাতে ‘পূর্ব ও পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের ব্যাপক গেরিলা তৎপরতা’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিফৗজ পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে গুপ্ত ও গেরিলা আক্রমণ যেমন চালিয়ে যাচ্ছেন, ওদিকে পাকিস্তান জঙ্গী বাহিনী আজ উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে আসামের কাছাড় জেলার সংলগ্ন শ্রীহট্ট সীমান্তের দিকে নতুন অভিযান শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে আজ রাতে যে সংবাদ পাওয়া যায় তাতে বলা হয় যে, মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ের পর পাকবাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী কুশিয়ারা নদীর সম্মুখে হাজির হয়েছে। কিন্তু শ্রীহট্টের দিক থেকে পাক বাহিনীর যে দলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিক থেকে অভিযানকারী অপর একটি ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের আশায় এক সপ্তাহ পূর্বে রওয়ানা হয়েছিল, তারা এখনও গুরুত্বপূর্ণ শেরপুর খেয়াঘাট দখলের জন্য মুক্তিফৌজের সঙ্গে লড়াইয়ে আটকে আছে। সংবাদ এ-ও জানা যায় যে, পাক বিমানবাহিনীর বারবার বোমাবর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসসাধন এবং দূরপাল্লার কামান দাগানো সত্ত্বেও মুক্তিফৌজ শ্রীহট্টের মাইল পনেরো দূরে অবস্থিত শেরপুরে পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন এবং তাদের আক্রমণে পাক জঙ্গী ফৌজ বহু সংখ্যায় হতাহত হয়েছে। উপকূলবর্তী শহরগুলো দখলের চেষ্টা : প্রকাশ, মধ্য রণাঙ্গনে পাকিস্তানী ফৌজ বগুড়া ও ময়মনসিংহ থেকে যমুনার উভয় তীর ধরে অভিযান চালিয়েছে। নদী তীরবর্তী শহরগুলো পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতে পাওয়ার জন্যই তাদের এই উদ্যম। পাক বিমানবাহিনী আজকে বগুড়ার পূর্বদিকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বোমাবর্ষণ করে ধ্বংস করেছে। বিশেষ করে যমুনার পশ্চিম উপকূলবর্তী সিরাজগঞ্জ, কাজীপুর ও হরিপুর শহর কয়টি বিধ্বস্ত হয়। জামালপুর তুমুল সংগ্রাম : পূর্ব তীরে ময়মনসিংহের দিক থেকে অভিযানরত পাকিস্তানী ফৌজ জামালপুর ঢুকেছে। ওখানে মুক্তিফৌজের সঙ্গে প্রচ- সংগ্রাম চলেছে এখন অবধি। সংবাদে বলা হয় যে, ঢাকা, মধুপুর ও কিশোরগঞ্জ থেকে পাকফৌজের যে দলটি ময়মনসিংহের ওপর জড়ো হয়েছিল, এতক্ষণে তারা ঐ শহরে সদর কার্যালয় স্থাপন করেছে। বরিশাল শহর এখনও মুক্তিফৌজের হাতে : দক্ষিণ রণাঙ্গনে এখন পর্যন্ত বরিশাল শহরটি মুক্তিফৌজের কর্তৃত্বে। ফরিদপুর থেকে অভিযানরত পাকবাহিনীকে গেরিলারা বরিশালের পথে অনেক জায়গায় সংগ্রামের মুখে ফেলেন। নদী তীর বরাবর পাকিস্তানী গানবোট ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলি বিনিময়ের সংবাদও পাওয়া গেছে। সৈন্যরা চট্টগ্রামে শ্রমিক পাচ্ছে না : চট্টগ্রামে পাকবাহিনী নাকি ১৩০০০ বন্দর শ্রমিকের মধ্যে বন্দুক দেখিয়ে মাত্র ১৪০০ জনকে জরুরী মালপত্র উঠানো নামানোর কাজে সংগ্রহ করতে পেরেছে। অধিকাংশ বন্দর ও ডক শ্রমিক পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলি এড়িয়ে শহর ছেড়ে চলে গেছে এবং মুক্তিযাদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। চৌকি দখলের চেষ্টা বানচাল : শিলিগুড়ি থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের দিনাজপুরে কিশোরগঞ্জ এলাকা থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে। এই এলাকাটি পশ্চিম দিনাজপুরে রাধিকাপুর সীমান্ত শহর থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে। সীমান্তের ওপার থেকে এই খবর পাওয়া গেছে। মুক্তিফৌজের অতর্কিত আঘাত : শিলং থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, মুক্তিফৌজ বিরাট এক অঞ্চলজুড়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করে তুলেছে। কয়েকটি এলাকায় আজ পাকবাহিনীর ওপর তারা অতর্কিতে আঘাত হেনেছে। বগুড়া শহরের দক্ষিণ-পূর্বে শেরপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ পাক বাহিনীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য করতোয়া নদী পার হওয়ার সময় এই সংঘর্ষ শুরু হয়। নিকটবর্তী কাজিপুর এবং হরিপুর এলাকায় মুক্তিফৌজ ও পাকবাহিনীর মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। কুমিল্লা ফ্রন্টে গঙ্গাসাগর এবং ইমামবাড়ী স্টেশনের মধ্যবর্তী একটা এলাকায় মুক্তি সংগ্রামী ও পাকবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষে বহু সংখ্যক পাক সৈন্য হতাহত হয়েছে। হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। কুচবিহার থেকে প্রাপ্ত একটি খবরে জানা গেছে, হানাদারের কুড়িগ্রাম দখলের চেষ্টা মুক্তিবাহিনী বানচাল করে দিয়েছেন। একটি পাক অগ্রবর্তী বাহিনীর পাঁচজন সৈন্যকে মুক্তি সংগ্রামীরা গুলি করে মেরেছেন এবং ধরলা নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই পাক সৈন্যরা হাতে তৈরি নৌকাতে করে ধরলা নদী পার হচ্ছিল। পাক বিমান ভূপাতিত : শিলং থেকে পিটিআই জানাচ্ছে, খাসি পাহাড় অঞ্চল ও মেঘালয়ের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের শ্রীহট্ট ফ্রন্টে একদল মুক্তি সংগ্রামী আজ সকালে একটি পাক জঙ্গী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে। বিমানটি হরিপুরে সার কারখানার দিকে যাচ্ছিল। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×