ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা বিষয়ে সব কিছুই খোলাসা হওয়া দরকার

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২৮ এপ্রিল ২০১৯

স্বাধীনতা বিষয়ে সব কিছুই খোলাসা হওয়া দরকার

আমাদের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে সেই প্রথম দিন থেকেই চলছে গভীর চক্রান্ত। আর অনেক দাম দিয়ে কেনা এই স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পর পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছিল তা আমরা বিগত বিএনপি ও সামরিকতন্ত্রের অধীনস্থ প্রায় দুই যুগের শাসনামলে টের পেয়েছি। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর্বটি (’৭১ এর মার্চ-ডিসেম্বর পর্ব) আমাদের ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হলে আমরা মানসিকভাবে শত্রুদের প্রতিহত করা তথা তাদের পরাভূত এবং বিতাড়নের ব্যাপারে বাস্তবে আমাদের পরিস্থিতিটা ছিল অবিন্যস্ত, অসংগঠিত ও সামরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুতিহীন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ভূমিধস বা নিরঙ্কুশ বিজয় জাতিকে মানসিক দিক থেকে এমন শক্তিধর ও প্রত্যয়দৃঢ় অবস্থানে নিয়ে যায়। জাতি এবার ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’ এই চেতনায় উদ্বেল হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে জাতি যেন মুহূর্তেই ‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন’ এই মন্ত্রের দীক্ষা পেয়ে যায়। ফলে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি জনগণের অবিচল ও ইস্পাতদৃঢ় আস্থা আর বঙ্গ শার্দূল বঙ্গবন্ধুর অসম সাহসিকতার ওপর ভর করে একটি জাতির মহাজাগরণ দেখতে পেলাম যা বিশ্বের ইতিহাসে ছিল এক অনন্যসাধারণ ঘটনা। বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন আর তাঁর এই চেতনার বিকাশ ঘটেছিল তাঁর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে। সুতরাং, বিশ্বের যে কোন স্বাধীনতা আন্দোলন যেমন সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনটি কিন্তু সেক্ষেত্রে এ কারণে বিশেষ ও ব্যতিক্রমধর্মী ছিল। নেতা প্রথমে গোটা জনগোষ্ঠীকে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনী রায়-অর্থাৎ, অহিংসপন্থায় ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিজয়ের মোহনায়। গোটা পাকিস্তান আমলে শেরেবাংলা-শহীদ সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তেইশ বছরব্যাপী নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এই আস্থাবোধই তাদেরকে সেদিন এমনই এক সুদৃঢ় অবস্থানে পৌঁছে দেয় যেÑ ঢাল-সড়কি ছাড়াই বিজয় লাভের ব্যাপারে তারা মানসিকভাবে নিশ্চিত হয়ে ওঠে। আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের এই পর্বে বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদী নেতৃত্ব, সকল প্রকার ভ্রুকুটিকে অগ্রাহ্য করার দৃঢ়তাপূর্ণ ভূমিকা আর তাঁর অতুলনীয় ত্যাগ-তিতিক্ষা এক অনন্য গৌরব গাথা ও মহিমামণ্ডিতরূপে ভাস্বর হয়ে রয়েছে এবং রইবে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে বেশ কিছু ঘটনা এখনও খানিক আলো-আঁধারীতে ছেয়ে আছে যা খোলাসা হওয়া দরকার। পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাতচল্লিশ পরবর্তী সময়ে শেরেবাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী, বঙ্গবন্ধুসহ দেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক-বুদ্ধিজীবীরাও সচেষ্ট থেকেছেন। আর এই লক্ষ্যেই বার বার তাদেরকে রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এমনকি, চুয়ান্নতে পূর্বপাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণও ঐ একই লক্ষ্যে সূচিত হয় এবং নির্বাচনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিও তাই ছিল গণতন্ত্র এবং স্বায়ত্তশাসন আদায় করা। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক অবস্থান আর সে কারণেই চক্রান্ত্রের বেড়াজাল রচনা করে দেশবাসীকে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত রাখাই ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার এবং স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণের ক্ষেত্রে জনগণকে মানসিকভাবে একরূপ প্রস্তুতি দিলেও এর কোন সশস্ত্র প্রস্তুতি না থাকা এবং স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে যে ধরনের প্রশাসনিক ও দেশপ্রেমমূলক সক্ষমতা জাতির থাকা একান্ত অপরিহার্য তা না থাকায় স্বাধীনতা লাভের পরপরই কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দেশটিকে বিপন্ন করে তুলতে উদ্যত হয়। স্বাধীনতার পর পরই এক শ্রেণীর চোর, বাটপার আর লুটেরার দৌরাত্ম্যে জাতির পিতা এতই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন যে, তার তখন বেদিশা হয়ে পড়ার জোগাড়! সর্বত্র বঙ্গবন্ধুকে নাকাল করার দেশী-বিদেশী চক্রান্ত শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই। আর সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আপনজন হিসেবে কথিত ও পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা শুরু হয় তা আজ বিশেষভাবে বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে বৈকি! কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার সম্প্রতি জনকণ্ঠে সিরিজ নিবন্ধ রচনার মাধ্যমে আমাদের গৌরববাহী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিব বাহিনী গঠনের তাৎপর্য, এর যথার্থ, উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে যে সব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পেশ করেছেন তা সত্যের কষ্টিপাথরে ও ঘটনা প্রবাহের চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণে যে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ ধারণ করবে তা তো বলাই বাহুল্য! তিনি এই বাহিনী গঠনের বিষয়টিকে যতটা সরলীকরণ করতে চেয়েছেন তা কি আদৌ তা-ই ছিল নাকি এর পেছনে সেদিনের এই বাহিনীর কুশীলবদের কারও কারও অন্য কোন গভীর ও সুপ্ত বাসনা ও অভিপ্রায় ক্রিয়াশীল ছিল তাও কিন্তু আজ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের দাবি রাখে! আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে করে যে, সেদিন- অর্থাৎ ১৯৭১ এ প্রবাসী সরকার গঠনের সূচনালগ্নে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবকে কে বা কারা প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পরান্মুখ ছিলেন আর কেনই বা তারা তাজউদ্দীন সাহেবকে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর হয়ে কাজ চালিয়ে যাবার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিলেন, কি যুক্তিতেই বা তা তোলা হয়েছিল? এ সব কথা আজ খোলাসা হওয়া দরকার। মোস্তফা জব্বার সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী মুজিব বাহিনী যদি স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রতিবিপ্লবীদের হাত থেকে বঙ্গবন্ধুকে রক্ষার (যে যুক্তি এর প্রতিষ্ঠাতারা দিয়েছিলেন) উদ্দেশ্যেই গঠিত হয়ে থাকে তাহলে এর হোতারা দেশ স্বাধীন হবার মাত্র এক বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেন এমন নৃশংস-নির্মমতায় মেতে উঠেছিলেন? গণবাহিনী, জাসদ, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র এসব বুলি ও এদের নির্মমতা সেদিন বঙ্গবন্ধুর পতনের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল। আর তা বুঝতে কি কারও রকেট সায়েন্স জানার প্রয়োজন পড়ে? বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যে ধরনের অপদস্তকর উক্তি এবং তার সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে যে ধরনের সশস্ত্র আক্রমণ তারা সেদিন অবলীলায় চালিয়ে গেছে তা কিসের আলামত ছিল বা তা কি তাৎপর্যই বা বহন করে? এ সকল প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়াটা একান্তই জরুরী নয় কি? আরেকটি বিষয়ও খুব গভীর মনোযোগের ও ব্যাখ্যার দাবি রাখে আর সেটি এই যে, ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনটি বর্জনের ব্যাপারে ছাত্রলীগের বৃহৎ অংশটি (যারা কিনা পরে জাসদভুক্ত হয়েছিল) সেদিন এত সোচ্চার ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল কেন? কারাই বা সেদিন এদের প্রেরণার উৎসভূমি ছিল? সেদিন নূরে আলম সিদ্দিকী ছাত্রলীগের সভাপতি না থাকলে এবং দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন নির্বাচনের পক্ষে নিরবচ্ছিন্নভাবে এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ব্যাপক বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ রচনা করে ছাত্রলীগকে উদ্বুদ্ধ না করতেন তাহলে স্বাধীনতার বিষয়টি যে ঘোরতর তমশায় আবৃত হয়ে পড়তো তাতে কোন সন্দেহ আছে কি? এবার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত সেই একই নিয়মে অব্যাহত থাকতে দেখে দুটো কথা বলার তাগিদ বোধ করছিÑ অতি সাম্প্রতিককালে মার্কিন সিনেটের কতিপয় সিনেটর বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনকে ঘিরে সেই পুরনো খেলা আবার শুরু করেছেন। ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি নেতারা নির্বাচনবিষয়ক কোন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে দাখিল না করে তারা নির্বাচন পরবর্তী সময়গুলোতে যেসব অভিযোগের ডালি মেলে ধরেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি মিথ্যার বেসাতি করে চলেছেন সে বিষয়ে তাদের বিদেশী মেন্টর বা ইয়ার-বন্ধুরা কিন্তু একেবারেই ‘স্পিক টি নট’! অথচ, বিরোধীদের নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে ‘ভয়-ভীতি বা মামলা-হামলা’র মাধ্যমে বিরত রাখা হয়েছিল, ‘ব্যালট বাক্সগুলো আগের রাতেই ভরে রাখা হয়েছিল’ ইত্যকার যেসব অভিযোগ তুলে তারা এখনও আসর জমাতে চাইছেনÑ সেই ঢোলের কাঠি হয়ে মার্কিন কংগ্রেসের ৬ সদস্যকে হঠাৎ সোচ্চার হতে দেখে আকলমন্দ ব্যক্তি মাত্রেই হাসি সংবরণ করতে পারছেন না! কারণ, ড. কামালদের এ বিষয়ক সাজানো নাটকটি এদের এসব বক্তব্যের মাধ্যমে একেবারেই খোলাসা হয়ে গেল এবং ড. কামাল সাহেবদের বল-ভরষার উৎসটি যে আসলে কী ও কোথায় তা-ও অনেক পরিষ্কাররূপ নিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে এই মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের যেন ঘুমই হারাম হয়ে গেছে! অথচ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহু দেশের গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আজ যে নাজুক অবস্থা বিরাজমান তা কিন্তু এদেরকে বিচলিত করে না। আমরা লক্ষ্য করছি, দেশে এখনও বিভিন্ন মহলের প্ররোচনায় অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডসমূহ, নারীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও নিপীড়ন এবং নানাবিধ অকথ্য ঘটনা ঘটাবার নিত্য প্রয়াসও চালানো হচ্ছে চারদিকে। নির্বাচনে ঐতিহাসিক পরাজয় বিষয়ে ড. কামাল গংরা বেশ কিছুকাল যাবৎ তাদের দেশী-বিদেশী এজেন্টদের মাধ্যমে হুর-হাঙ্গামা বাধাবার কসরত করে অবশেষে এর অসারতা অনুধাবনপূর্বক রণে ভঙ্গই দিয়েছেন আপাতত। মির্জা ফখরুল সাহেবরা নিছক নিজেদের ভোঁতা মুখ রক্ষার জন্য মাঝে-মধ্যে এমন সব বালখিল্যতা করে ফিরছেন! শর্টসার্কিট থেকে মার্কেটে আগুন লাগলে বা কোন দূরবর্তী ও রীতিমতো অগম্য স্থানে কোন নারী শ্লীলতাহানির শিকার হলে মির্জা সাহেব-নজরুল সাহেব আর বিএনপির গোয়েবলস রিজভী সাহেবরা ঘটনার কোন প্রকার বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়াই ঢালাওভাবে এজন্য সরকারকে দোষারোপ করে চলেছেন। তাদের সময় যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ সাহেব ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’ বলে টিপ্পনি কেটেছিলেন তখন এদের এসব বিচার-বিবেচনাবোধ কোথায় বন্ধক ছিল? বিএনপির নির্বাচিত সাংসদরা সংসদে যাবেন কিনা তা নিয়ে এক মহাসঙ্কটে নিপতিত তারা এখনও। যদিও বিএনপি-জামায়াত ও ড. কামালের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের যারা জিতেছেন তাদের তিনজন (একজন বিএনপির) ইতোমধ্যে শপথ নিয়েছেন। কেউ কেউ শপথ নেয়ার জন্য প্রস্তুত বলে জানা গেছে। দেখা যাক, কোথাকার পানি শেষতক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×