ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা থেকে সিলেট যেতে সময় কমবে আড়াই ঘণ্টা

প্রকাশিত: ১০:১২, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

 ঢাকা থেকে সিলেট যেতে সময়  কমবে আড়াই ঘণ্টা

ওয়াজেদ হীরা ॥ আখাউড়া-সিলেট রেলপথ আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মিটারগেজ রেলওয়ের পাশাপাশি ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ এবং স্টেশনগুলোর উন্নয়ন করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ঢাকা থেকে সিলেট যেতে সময় কমে আসবে আড়াই ঘণ্টা। ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে সরকার। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। চীন সরকার এ প্রকল্পে ১০ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা ঋণ দেবে। সরকারী তহবিল থেকে যোগান দেয়া হবে পাঁচ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাব তথ্যে জানা গেছে, বর্তমানে ওই রেলপথে ১৩ জোড়া ট্রেনের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে রেলওয়ে বিভাগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২৬ জোড়া ট্রেন চালানোর সুযোগ হবে। এতে মানুষ দ্রুত যাতায়াত করতে পারবে আর উন্নয়ন ঘটবে রেল অবকাঠামোরও। জানা গেছে, ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের আখাউড়া-সিলেট সেকশনের মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজ রেললাইনে রূপান্তর’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় সিলেট রেলস্টেশনসহ এই রুটের আরও কয়েকটি রেলস্টেশনের আধুনিকায়ন করা হবে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ রুটে বড় কন্টেনার ও যাত্রী পরিবহনে গতি আসবে। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করার টার্গেট নিয়ে প্রকল্পটি প্রস্তুত করা হয়। অনুমোদন পরবর্তীতে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান প্রকল্পটি নিয়ে বলেন, এ প্রকল্পের আওতায় ওই রেলপথের বাঁকা অংশগুলো সরল করার পাশাপাশি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হবে। প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দ্রুতগতির রেল চলতে পারবে। তাতে সাধারণ মানুষের ভ্রমণ সময় অনেক কমে আসবে। প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেললাইনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। দ্রুত ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা না হলে ঢাকা-সিলেট এবং চট্টগ্রাম-সিলেট রেল চলাচল বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ট্র্যাকের কাঠামো, পাহাড়ী এলাকার আঁকাবাঁকা রেলপথ এবং পরিচালনা জটিলতার কারণে এ পথে বর্তমানে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলতে পারে। ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হলে এই পথে ব্রডগেজ ট্রেনের গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার এবং মিটারগেজ ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার। তাতে ঢাকা-সিলেট ও চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেনযাত্রার সময় আড়াই ঘণ্টা কমবে। পাশাপাশি ভারতের অসমের সঙ্গে রেল যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হবে। ২০৩৫ সাল বা তারপরও ওই অঞ্চলে যে চাহিদা সৃষ্টি হতে পারে, তা মাথায় রেখে এ পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানানো হয় প্রকল্প প্রস্তাবে। এদিকে, জানা গেছে, এ প্রকল্পে প্রতিকিলোমিটার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭১ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ৫৩৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ঈশ্বরদী থেকে পাবনার ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প চলমান আছে। এ রুটের মোট দৈর্ঘ্য ৭৮ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। ফলে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় পড়ছে মাত্র ৬ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। ৩৩৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা শহর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ’ প্রকল্প চলমান আছে। এ রুটের মোট দৈর্ঘ্য ২৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। ফলে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় পড়ছে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ১৮৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ রুটের দৈর্ঘ্য ২১ দশমিক ৫৩ কিলোমিটার। ফলে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে মাত্র ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। অথচ প্রস্তাবিত প্রকল্পের ব্যয় সমজাতীয় প্রকল্পের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। বিদ্যমান লাইন রেখে দুই কিলোমিটার করে বাইপাস লাইন নির্মাণ করা হবে। পুরো রুটেই বাইপাস লাইন নির্মাণ করা হবে রেলপথটি সচল রাখার জন্য। পরবর্তীতে বাইপাস লাইন তুলে ফেলা হবে। প্রতি কিলোমিটারে ৭১ কোটি টাকার বেশি ব্যয় প্রসঙ্গে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ডুয়েলগেজ করার কারণে ব্যয় বেশি হচ্ছে। কারণ বিদ্যমান লাইন সচল রেখে রেলপথটি নির্মাণ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যয় বেশি হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেশি ব্যয় ফ্যাক্টর নয়। রেলপথটা নির্মাণ জরুরী। দুই কিলোমিটার করে বাইপাস লাইন নির্মাণ করে ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এভাবে প্রকল্পের আওতায় ১৭৬ কিলোমিটার বাইপাস লাইন নির্মাণ করা হবে। এর ফলে ব্যয়ও বাড়ছে। ব্যয়ের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যয় এ রকমই হবে। এতে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয় রয়েছে। তাছাড়া সিলেট রেলস্টেশনটি বদলে যাবে। পাশাপাশি অন্য স্টেশনগুলোও আধুনিকায়ন করা হবে। তাছাড়া রেল চলাচল অব্যাহত রেখেই বিশেষ পদ্ধতিতে ডুয়েলগেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। রেলপথ তো আর বন্ধ রাখা যাবে না। ব্যয় বৃদ্ধির আরও একটি কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এ সেকশনে যেসব ট্রেন চলবে, সেগুলো ইঞ্জিন পরিবর্তনে বর্তমান পদ্ধতি আর থাকবে না। অটোসিস্টেম সংযোজন করা হবে। তাছাড়া রেলপথে যেসব পাহাড় রয়েছে সেগুলো যাতে ধসে না পড়ে, সেজন্য রিটেইনিং ওয়াল দেয়া হবে। এসব কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এত টাকা প্রয়োজন হবে। রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ অংশে নির্ধারিত লোড ক্যাপাসিটিতে ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে। এ রুটে কন্টেনার পরিবহনে স্পীড ও লোডের সীমাবদ্ধতা থাকবে না বিধায় জাতীয় এবং আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক ফ্রেইট ও বিজি কন্টেনার ট্রেন পরিচালনা সেবা চালু করা হবে। প্রকল্পের আওতায় ২৩৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার ট্র্যাক নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে ১৭৬ দশমিক ২৪ কিলোমিটার মেইন লাইন এবং ৬২ দশমিক ৯০ কিলোমিটার লুপ লাইন। ৪৯টি মেজর ব্রিজ, ২২টি সিগন্যালিং স্টেশন, ২০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ১৭ হাজার বর্গমিটার আবাসিক ভবন, ব্যারাক ও ডরমিটরির কাজ করা হবে। প্রকল্পের আওতায় দেশী ও চীনা পরামর্শক থাকবেন ২ হাজার ৯৯৬ জন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সিলেট বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগীয় শহর। অঞ্চলটি তেল, গ্যাস, ক্যালসিয়াম কার্বনেট খনিজ সম্পদের সব থেকে বড় উৎস। চা উৎপাদনেও সিলেট প্রধান অঞ্চল। নানা গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই দ্রুত সময়ে ডুয়েলগেজে রূপ দেয়া হবে সিলেট-আখাউড়া রুটকে। এছাড়াও আখাউড়া-সিলেট সেকশনের বিদ্যমান মিটারগেজ রেললাইন ডুয়েলগেজে রূপান্তরের জন্য চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডের (সিআরবিজি) সঙ্গে ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পরের বছর ২০১৬ সালের ২১ মার্চ এ প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) অনুমোদিত হয়। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ও চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী দুই দেশের মধ্যে জিটুজি বিষয়ক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। এছাড়াও আখাউড়া-সিলেট রেললাইনটি ডবল লাইনে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে দুই বছর আগে বাংলাদেশ রেলপথ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অবশেষে নানামুখি আলোচনা শেষে সেই প্রকল্প আলোর মুখ দেখছে।
×