রূপনগরে অনেক মানুষ বাস করে। সবার কথা বলব না। তিনজনের কথা বলব- একজন বাবা, অন্যজন মা, আরেকজন রীপা। রূপনগর এলাকায় ওরা নতুন এসেছে। রীপার বাবা সুমন সরকারী চাকরি করেন। ওর মা সোনালী গৃহিণী। রীপা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। রূপনগরে আসার পর রীপা একটা জিনিস খেয়াল করল, এ এলাকায় অনেক শিশু। কয়েক শিশুকে সব সময় রাস্তায় দেখে। স্কুল টাইমেও রাস্তায় দেখা যায়। রাস্তার অলিগলিতে কাগজ, বোতল টোকাই করাই তাদের কাজ।
রীপা একদিন স্কুলে যেতে যেতে ভাবল, ওরা স্কুলে যায় না কেন! ওদের কি পড়ালেখা করতে ইচ্ছা করে না? আমার মতো স্কুলড্রেস পরে স্কুলে যেতে মন চায় না! আমার তো মনে হয়, ওদের ইচ্ছা করে। কোন কারণে হয়ত যেতে পারে না। কারণটা মায়ের কাছ থেকে জানতে হবে।
মায়ের সঙ্গে রীপা স্কুলে যাচ্ছে। গাড়ির ভেতর থেকে পথশিশুদের দেখিয়ে রীপা বলল, ‘মা, ওই যে শিশুদের দেখছ না, ওদের তো প্রায় সময় পথে পথে দেখি। আচ্ছা, ওরা কি পড়ালেখা করে না, স্কুলে যায় না?’
মা তাকিয়ে বললেন, ‘ওদের তো পড়ালেখা করতে মনে চায়। কিন্তু পরিবেশ-পরিস্থিতের কারণে হয়ত বা পড়ালেখা করার সুযোগ পায় না।’
‘কেন পায় না?’
‘এই শিশুদের খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে, কারও বাবা নেই, কারও মা নেই। এমনও হয়ত অনেকে আছে মা-বাবা দু’জনের কেউ নেই। তাদের দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ নেই। তাই নিজের পেট বাঁচানোর জন্য পথে পথে ঘুরে টোকাইগিরি করে ওরা।’
‘বল কী মা! ওরা মা-বাবা ছাড়া থাকে?’
‘থাকে।’
রীপা আর কিছু বলে না। মনে মনে কী যেন ভাবে। গাড়ি চলতে থাকে। একটু পর রীপা তার মাকে বলল, ‘মা, তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। তুমি কি শুনবে আমার কথা?’
‘তোমার কোন কথাটা শুনিনি? অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে শুনব। তুমি বল।’
‘মা, তুমি যে বললে, ওদের দায়িত্ব নেয়ার মতো কেউ নেই!’
‘আমি সত্যিই বলেছি তো। তোমার বিশ্বাস হয় না। বিশ্বাস না হলে চল একদিন ওদের সঙ্গে কথা বলি। ওদের মুখ থেকে তুমি শুনবে, আমি সত্যি বলেছি কি না।’
‘না না মা, আমি কী তোমার কথা অবিশ্বাস করেছি! অবিশ্বাস করেনি। তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।’
‘কী কথা, বল।’
‘আচ্ছা মা, যাদের অভিভাবক নেই, তাদের মধ্যে থেকে মেধাবী কয়েককে বেছে নিয়ে আমরা কি দায়িত্ব নিতে পারি না?’
রীপার কথা শুনে মা অবাক হয়ে গেলেন! মেয়ে তো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে। রীপার কথার কোন উত্তর দিলেন না মা। তিনি গালে হাত রেখে কী যেন ভাবতে লাগলেন! গাড়ি জ্যামে আটকে আছে।
এরই মধ্যে একটা মেয়ে ফুল নিয়ে গাড়ির জানালার কাছে এসে বলল, ‘আফা, ফুল লাগব, ফুল?’
গাড়ির ভেতর থেকে মেয়েটার কথা শুনতে পেল না রীপা। কিন্তু বুঝতে পারল মেয়েটা ফুল বিক্রি করার জন্য গাড়ির জানালার কাছে এসেছে। রীপা তার মাকে বলল, ‘মা, জানালা একটু খুলে দাও, একটি ফুল কিনব।’
মা এদিক-ওদিক তাকিয়ে জানালা খুলে দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে রীপা বলল, ‘ফুলের দাম কত?’
গাড়ির জানালার ওপাশ থেকে মেয়েটা বলল, ‘একটা ফুল দশ ট্যাকা।’
মায়ের কাছ থেকে দশ টাকা নিয়ে একটি ফুল নিল। ফুলটি হাতে নিতে নিতে রীপা মেয়েটিকে বলল, ‘তোমার নাম কী?’
‘জরিনা।’
‘মা-বাবা কী করেন?’
‘আব্বু নেই। আম্মু আছেন। তার অসুখ। বস্তিতে থাকে।’
জরিনার কথা শুনে মন খারাপ হলো রীপার। কিন্তু সে তা বুঝতে দিল না। রীপা আবার বলল, ‘পড়ালেখা কর না?’
‘না আফা, সুযোগ নাই। তয় পড়ালেহা করতে ইচ্ছা করে।’
জরিনা টাকাটা পেয়ে আর দেরি করল না। কথা শেষ না করেই সে ফুল বিক্রির উদ্দেশ্যে অন্য গাড়ির জানালার পাশে চলে গেল।
রীপার মা এত সময় চুপ করে পেপার পড়ার ভান ধরে ছিলেন। জরিনা চলে যাওয়ার পর তিনি চোখের সামনে থেকে পেপার সরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘রীপা, আমার কথা কি বিশ্বাস হলো?’
‘হ্যাঁ মা। ওর বাবা নেই। মা আছেন। তাও আবার অসুস্থ। আমার মনে হলো, জরিনা ফুল বিক্রি করে সংসার চালায়।’
‘তুমি ঠিক ধরেছ। আমারও তা-ই মনে হয়।’
‘আচ্ছা মা, ওদের মতো শিশুদের পাশে আমরা কোনভাবে দাঁড়াতে পারি না?’
‘দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু কীভাবে দাঁড়ানো যায়, সেটিই তো ভাবার বিষয়!’
‘তা ঠিক মা। তুমি একটু আমাকে ভাবতে দাও। ভেবে বলছি।’
গাড়ির জ্যাম ছেড়ে গেল।
একটু পর রীপা বলল, ‘মা, আইডিয়া একটা পেয়েছি?’
‘কী আইডিয়া বল দেখি, শুনি?’
‘রূপনগরে যত পথশিশু আছে, তাদের নিয়ে একটু স্কুল খুলব। আর এই স্কুলের মাস্টার হবে তুমি। প্রতিদিন তুমি চব্বিশ ঘণ্টার দুই ঘণ্টা ওদের পেছনে দেবে।’
‘কী বল রীপা? তা কী সম্ভব!’
‘মা! মানুষের দ্বারাই তো সব সম্ভব। রূপনগরে কত পথশিশু আছে। আগে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। যদি বেশি হয়, তাহলে কমপক্ষে দশজন নিয়ে আমরা নতুন স্কুল খুলতে পারি।’
‘ঠিক আছে রীপা। আইডিয়া ভাল। তোমার বাবার সঙ্গে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’
‘অবশ্যই মা। এটি করতে হবে। তোমরা যদি না কর, তাহলে আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে দেব।’
‘তুমি কোন চিন্তা কর না রীপা। আমি তো বাসায় বসেই থাকি। দুই ঘণ্টা মানুষ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলে ভাল লাগবে। আমি পারব। শুধু তোমার বাবার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা দরকার।’
‘ঠিক আছে মা, তোমার কথা শুনে খুশি হলাম। তাহলে আমরা রূপনগর বদলে দেব।’
‘অবশ্যই।’
গাড়ি স্কুল গেটে এলো। রীপা স্কুলে ঢুকে গেল।
রাতে বাসায় বাবার সঙ্গে কথা বলে সবাই সিদ্ধান্ত দিল, সামনের জানুয়ারি মাস থেকে পথশিশুদের নিয়ে তারা একটি স্কুল চালু করবে।
অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: