ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে পাকবাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৮:৫০, ২৭ এপ্রিল ২০১৯

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরে পাকবাহিনীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল দিনটি ছিল মঙ্গলবার। কুমিল্লার মিয়াবাজারে পাকবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাকবাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়। পাকহানাদার বাহিনী বিমান এদিন সিরাজগঞ্জ শহরে ঢুকে পড়ে। সেখানে তারা দোকান পাট, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এভিনিউ, ধানবান্ধি, আটাচড়া, হোসেনপুর, রৌহাবাড়ী, মালশাপাড়া, পুঠিয়াবাড়ী, মিরপুর, রায়পুর, চর রায়পুর, রহমতগঞ্জ, ভাঙ্গাবাড়ী, রানীগ্রাম, দোয়াতবাড়ী, কোবদাসপাড়া, সয়াগোবিন্দ, মাহমুদপুর, মাছিমপুর, গুণেরগাঁতি প্রভৃতি পৌর মহল্লার অসংখ্য নিরীহ নাগরিকের বসতগৃহ ভস্মীভূত করে। পাকবাহিনী আবারও রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ি অভিমুখে জলপথে অগ্রসর হয়। তখন মহালছড়িতে মেজর মীর শওকতের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তোলে। সকাল ৯ টার দিকে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য এবং একটি মিজো ব্যাটালিয়নকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। বিকেলে পাকবাহিনীর বিশাল দল মুক্তিযোদ্ধাদের মহালছড়ি হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে খাগড়াছড়ি এসে ডিফেন্স নেয়। সেখানে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের গুলিবিদ্ধ হন। তিনি ৭ পাক সেনাকে ঘায়েল করেন। ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে রামগড়ে নেয়ার পথে মারা যান। মহালছড়ি দখল করার পর পাকবাহিনী খাগড়াছড়িও দখল করে নেয়। এরপর পাকিস্তান বাহিনী ধীর গতিতে এগুতে থাকে কক্সবাজারের দিকে এবং পথে রেখে যায় গণহত্যা-নির্যাতনের বর্বর নজির। পাকবাহিনী জনতার প্রতিরোধ ভেঙে চকরিয়ায় প্রবেশ করেই চিরিঙ্গার হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ চালায়। চকরিয়ার পতনের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারে পাকিস্তানী দখলদারিত্ব শুরু হয়। পাকবর্বররা আওয়ামী লীগ নেতা এস. কে শামসুল হুদা, দেলোয়ার হোসেন, সারদা বাবু ও নূরুল কবিরসহ বহু নেতা ও কর্মীর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পাকবাহিনীর হামলায় সারদা বাবুর ছেলে মনীন্দ্র ও লক্ষ্যচরস্থ আবুল হোসেন শহীদ হন। পাকহানাদার বাহিনী জগন্নাথপুর থানায় প্রবেশ করে ব্যারিস্টার আবদুল মতিনের বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করে। এদিকে শাহবাজপুরে পাকবাহিনীর ওপর সফল আক্রমণ চালিয়ে লে. মোরশেদের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা দল মাধবপুরে প্রত্যাবর্তন করে। উক্ত তৎপরতায় পাকিস্তান বাহিনীর কিছু সৈন্য হতাহত হয়। ফুলবাড়ীয়া থানার লক্ষ্মীপুরে প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ২৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাক আর্মির সুসজ্জিত বাহিনী কামান ও অটোমেটিক মেশিনগান নিয়ে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর-মোনাখালী দিয়ে ঢুকে মহিষনগর, গোপালনগর, আনন্দবাগের দিকে বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। হানাদারেরা মোনাখালী থেকে শুরু করে বৈদ্যনাথতলা পর্যন্ত ৮-১০ মাইল কামানের গোলা ও মেশিনগান থেকে শিলাবৃষ্টির গুলি মতো বর্ষণ করে। মেহেরপুর কোর্ট এলাকায় কয়েক ডজন লোক জড়ো করে বড় গর্ত খুঁড়ে গুলি করে হত্যা করে তাঁদের গর্তে ফেলে। তাদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গার দারোগা আইয়ূবও ছিল। চুয়াডাঙ্গা রেল স্টেশন নিকটবর্তী কয়েকটি ঘরে ৫০/৬০ জন লোককে ধরে নিয়ে সেখানে গুলি করে মারে। চট্টগ্রামের হেয়াকো নামক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এদিন পাবনা-বগুড়া মহাসড়কের ডাব-বাগানে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর পাকবাহিনী আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে সিপাহী নেফিরুল হোসেন, সিপাহী রমজান আলী, ল্যান্স নায়েক ফজলুর রহমান, হাবিলদার মোকসেদ আলীসহ ১৭ জন বীরযোদ্ধা শহীদ হন। অপরদিকে ৩০-৩৫জন শত্রু সৈন্য হতাহত হয়। প্রচ- সংঘর্ষের পর পাকবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে নোয়াখালী, সান্তাহার, সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজার পুনর্দখল করে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. রহিম খান ঢাকা আসেন। ঢাকায় তিনি সার্বিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করে বিমান হামলা সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণ করেন। ইসলামাবাদে পাকিস্তান সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের জনৈক মুখপাত্র জানান, নিউইয়র্কে পাকিস্তানের ভাইস কন্সাল মাহমুদ আলী তাঁর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করায় তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ ১৪৮নং সামরিক বিধি জারি করে। এ আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সহায়তাকারীদের পাইকারি শাস্তির নির্দেশ দেয়া হয়। এ আদেশে কোন কারণ ছাড়াই কেবলমাত্র সন্দেহের ওপর ভিত্তি করে চরম শাস্তির লাইসেন্স দেয়া হয় ঘাতকদের। এমনকি যে এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা তৎপরতা চালাবে সে এলাকার লোকদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা লাভ করেন। এই দিন হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘সিলেট ফ্রন্টে প্রতিরোধ ভাঙতে ব্যর্থ পাক আর্মি’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিলেটের শেরপুর ফেরিঘাটে আজ দিনের প্রথমভাগে পাকিস্তানী বিমান ও স্থলবাহিনী একযোগে হামলা চালায়। টানা চারদিন হামলার চতুর্থদিনেও আজ বীরদর্পে পাকিস্তানী বাহিনীর হামলা রুখে দিয়েছে মুক্তিবাহিনী। শেরপুর ফেরিঘাট কুশিয়ারা নদীর উপরে অবস্থিত। কুমিল্লার আখাউড়া এবং সিলেটের একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম এই ফেরি। এরই মধ্যে জানা যায় যে, সিলেট শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত গোপালগঞ্জ এলাকায় আজ ৪ জন গেরিলা মুক্তিযাদ্ধা তাদের ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২২জন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দলকে ঘায়েল করে। যদিও এ সময় তারা পিএএফ প্লেন থেকে নিক্ষেপিত বোমার শেলে আহত হয়। পাকিস্তানী বাহিনী, গানবোটের সাহায্যে বরিশালের মধুমতী নদী পার হচ্ছে এবং এ সময় তারা নদীর দুইপারের গ্রামে বোমা হামলা এবং অগ্নিসংযোগ করছে বলে জানা যায়। ধীরে ধীরে তারা বরিশাল শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই গানবোটগুলো বঙ্গোপসাগর থেকে মধুমতী নদীতে প্রবেশ করে এবং এই নদীটির অসংখ্য শাখা-উপশাখা পুরো বরিশাল জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছে। ৩০ লাখ জনসংখ্যার এ গুরুত্বপূর্ণ জেলাটিতে এখনও পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধের প্রভাব খুব একটা পড়েনি। মুক্তিবাহিনী খুলনায়ও পাকবাহিনীর দখলকৃত রেডিও স্টেশনে গেরিলা কৌশলে হামলা চালায়। চট্টগ্রামে পাকিস্তানী বাহিনী চট্টগ্রাম-কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম-সীতাকুন্ডের মধ্যবর্তী যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিন কুমিল্লা সেক্টরে লাকসাম রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একদল পাক সেনার ওপর অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। সেনাদের দলটি চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল। এই হামলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। যদিও এই হামলা পালটা হামলার মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় পাকিস্তানী সেনারা এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। প্রবল বোমা ও ভারি আর্টিলারি বহর হামলার মাধ্যমে তারা উক্ত জেলায় মুক্তিবাহিনীদের প্রতিহত করে যাচ্ছে। পাকিস্তানী স্থলবাহিনী এই এলাকায় প্রবেশের পূর্বে এর বহির্ভাগে প্রবল পরিমাণে বিমান থেকে বোমা হামলা, ভারি আর্টিলারি বহর থেকে গোলাবর্ষণ চালায় ও মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। সান্তাহার এবং গোরাঘাট থেকে বগুড়ার দিকে অগ্রসরবর্তী পাকবাহিনী সহজেই শহরটির দখল নিতে পেরেছে। পাকিস্তানী বাহিনীর মজুদ গোলাবারুদের ব্যাপকতা মুক্তিবাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি হওয়াতে উক্ত এলাকার অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনী আগেই নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়। বগুড়া থেকে পাকবাহিনী ক্রমশ উত্তর-পশ্চিমের জামালপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানা যায়। গত রাতে কুষ্টিয়ার ভৈরব নদীর পশ্চিমপারে অবস্থিত ইছাখালীতে পাকিস্তানী সীমান্ত ফাঁড়িতে মুক্তিবাহিনী চড়াও হয়ে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। অতঃপর তারা ফাঁড়ির চারপাশে পরিখা খনন করে এবং ভৈরব নদীর ওপর অবস্থিত ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। আজ সকাল থেকে মুক্তিবাহিনী ইছাখালী থেকে দুই মাইল দূরের মেহেরপুর শহরে অবস্থিত পাকিস্তানী সেনা ফাঁড়িতেও মর্টারশেল নিক্ষেপ করা শুরু করে এবং সেনাদলটি বাধ্য হয়ে মেহেরপুর থেকে ৫ মাইল দূরের মায়ামারি গ্রামের একটি বাঁশবাগানে অবস্থান নেয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×