ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তানজিনা আল-মিজান

নবচেতনায় নবরূপে

প্রকাশিত: ১২:৫৫, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

নবচেতনায় নবরূপে

যে কোন অনুষ্ঠানকে মুখরিত করে তোলা বাঙালী জাতির সহজাত প্রবৃত্তি। মেহেদী অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বিয়ে থেকে শুরু করে নামকরণ মুখে ভাত, ঈদ, পূজা-পার্বণ সব অনুষ্ঠানেই চলে হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার। চলে আনন্দের ফল্গুধারা। বেশ কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশে বর্ষবরণ উৎসবটিও খুব আনন্দের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বর্ষবরণ যেন বাঙালীর প্রাণের অনুষ্ঠান। নববর্ষকে নব নব রূপে বরণ করে নিতে কারও মনে যেন কোন কার্পণ্য নেই। এই নববর্ষ বরণ এখন একটি বাৎসরিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। আগে মানুষ বছর ধরে অপেক্ষায় থাকত ঈদ, পূজার অনুষ্ঠান অথবা পরিবারের কারও বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। এখন মানুষ ঠিক একইভাবে অপেক্ষা করে নববর্ষকে বরণ করে নিতে। চারদিকে চলে যেন রঙ্গের মাখামাখি। লাল, সাদা, হলুদ, সবুজ সব রঙ্গে রাঙ্গিয়ে মানুষ রঙ্গিন হয়ে ওঠে। ছোট বড়, ছেলে-মেয়ে সবার মনেই এই দিনে থাকে একই রঙ্গের মাতম। সবচেয়ে বড় কথা, সকল ধর্মের মানুষই এই বর্ষবরণকে উপভোগ করেন সমানভাবে। ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবাই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী উজ্জ্বল রঙ্গীন পোশাকে নিজেদের সজ্জিত করে তোলেন। বিভিন্ন বুটিক শপ, পরিচিত অপরিচিত নামীয় কাপড়ের দোকানগুলোতে বসে বিভিন্ন ধরনের নজরকাড়া পোশাকের পসরা। শুধু পোশাকেই নববর্ষ উদযাপিত হচ্ছে তা কিন্তু নয় বিভিন্ন ধরনের রেশমি চুড়ি, চুলের ফিতা ক্লিপ এগুলোর প্রতিযোগিতাও চলছে সমানভাবে এবং এগুলোও মানুষকে রাঙ্গিয়ে তুলছে ঠিক একইভাবে। পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ নববর্ষ অনুষ্ঠানের প্রাণ হচ্ছে বৈশাখী মেলা। মেলা শুনলেই মনের মধ্যে একটি আনন্দ অস্থিরতা কাজ করে। আর যদি হয় বৈশাখী মেলা তা হলে তো কথাই নেই। সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কারও কোন ক্লান্তি নেই, রোদে পোড়ার ভয় নেই মানুষ মনের আনন্দে মেলায় যায়, কেনা কাটা করে প্রিয়জনকে উপহার দেয়। এই মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাটির থালা বাসনে করে পান্তা-ইলিশ খাওয়া। ‘আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’-এই গানটির কথা মনে পড়ে গেল। আর মনে পড়বে নাই বা কেন? প্রাকৃতিক দিক দিয়ে আমাদের এই বাংলাদেশ কিন্তু অনেক সমৃদ্ধ। নদীমাতৃক এই দেশ তার বুক ভরে আছে ইলিশ মাছ। আর সেই মাছ দিয়েই আমরা নতুন বছরকে বরণ করে নিচ্ছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। অন্য আর কোন দেশেই এমনটি হয় না। এসব আনন্দের মধ্যে একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে আর সেটা হচ্ছে নতুন বছরকে শুধু আনন্দ সহকারে বরণ করে নিলেই কিন্তু হবে না সেই সঙ্গে নিজেকেও নতুন আঙ্গিকে নতুন পরিকল্পনায়, নতুনভাবে সাজাতে হবে। আর শুধু নিজেকে সাজিয়ে তুললেই কিন্তু উৎসবের আনন্দ পরিপূর্ণ হয় না। নিজের সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষগুলোকে যদি একটু হলেও সাজিয়ে নেয়া যায় তবেই পাওয়া যাবে প্রকৃত আনন্দ। আমাদের আশপাশে অনেক অভাবি মানুষ আছে যাদের দুবেলা খাবার মেটানোই দুরূহ ব্যাপার। তাদের জন্য বর্ষবরণের অনুষ্ঠান করা অথবা নতুন পোশাকে নিজেকে সজ্জিত করাটা এক রকম অসম্ভব চিন্তা। তারা মেলায় যায় ঠিকই কিন্তু সেখান থেকে কিছু কেনা অথবা পান্তা ইলিশ খাওয়া তাদের জন্য অসম্ভব। আমাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যারা একটু চাইলেই ওই সমস্ত অভাবি মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটাতে পারেন। আমরা নিজেদের বাজেট থেকেই একটু বাঁচিয়ে যদি একটি শিশু, কিশোর অথবা বৃদ্ধ- মানুষকে নতুন রঙ্গিন পোশাক পরাতে পারি, যদি পারি তাদের এক জনের মনেও বৈশাখী রং ঢেলে দিতে তাহলে আমার মনে হয় নিজেকে যেভাবে রাঙ্গানো যাবে তা হয়ত নতুন পোশাকে রাঙ্গানোর চেয়েও বেশি হবে। একটু ভেবে দেখেন, যে ছোট্ট মেয়েটি শুধু দোকানের দিকে তাকিয়ে নতুন নতুন জামাগুলোকে দেখে আর দেখে সেগুলোকে নিজের করে পাবার স্বপ্ন। আপনি যদি হঠাৎ একদিন সেই গরিব মেয়েটির স্বপ্ন পূরণ করেন তা হলে ব্যাপারটি কেমন হবে? নিঃসন্দেহে ব্যাপারটি অনেক আনন্দের হবে। আমার বিশ্বাস, ওই মেয়েটি যে আনন্দ পাবে আপনি নিজে তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পাবেন। কারণ কারো মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলে এক ধরনের স্বর্গীয় আনন্দ পাওয়া যায় এটা তো আমরা সবাই জানি। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকেউ এসব ব্যাপারে উৎসাহীত করতে হবে। সব ব্যাপারে শুধু নিজের জন্য কিনব বা নিজের জন্য নিব এই মনোভাব থেকে বাচ্চাদের বের করে আনতে হবে। আর এই কাজ বড়দেরকেই শুরু করতে হবে। বাচ্চাদের অভ্যাস করাতে হবে শুধু নিজের জন্য নয় সঙ্গে অন্যদের কথাও ভাবতে হবে। বন্ধু-বান্ধবকে উপহার দেয়া থেকে শুরু করে গরিব-দুঃখীকে সাহায্য করা, বড়দের সম্মান ছোটদের স্নেহ করা সবই ওদের অভ্যাস করাতে হবে। তাহলে নিশ্চয়ই এক সময় বাচ্চারা যখন বড় হবে তখন সবাইকে নিয়ে আনন্দ করার মতো ভাল কাজগুলো করতে পারবে। তাতে করে দ্বন্দ্ব-কলহ বিদ্বেষ যেমন দূর হবে তেমনি সকলের সঙ্গে সকলের সুসম্পর্ক তৈরি হবে এবং একই সঙ্গে দেশের উন্নতি হবে।
×