মাঝরাতে হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে গেল। চারিদিক নিস্তব্ধ-নিঃশুসি।
পুরো পৃথিবীটা যেন নিথর স্ট্যাচু। শুধু দেয়াল ঘড়িটার টিক টিক শব্দ আর একটা নারী কণ্ঠে কান্নার হালকা আওয়াজ আমার কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে।
ঘুমের ঘোরে নারী কণ্ঠে কান্নার আওয়াজ শুনে ভয়ে পাংশু হয়ে গেলাম!
ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে হাজার বছরের শুকনো কাঠখড়ির মতো হয়ে গেল, যেন দিয়াশলাইয়ের কাঠি ঘষতেই ফিরিঙ্গির মতো জ্বলে উঠবে।
ভাবলাম, কোন ভূত-পেত্নী কাঁদছে হয়তো।
বউকে ডাকছি কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছে না।
পরক্ষণেই খেয়াল করলাম বউ পাশে নেই।
হায়! হায়! আমার বউটা গেল কোথায়!
ঐ পেত্নী আমার বউটাকে তাড়া করেনি তো!
বিয়ে করেছি সবেমাত্র দুদিন হলো।
পেত্নীটা আগে থেকেই বউয়ের পিছে পড়ে ছিল হয়তো।
এসব নানা চিন্তা পাঁয়চারি করতে লাগলো আমার মস্তিষ্কের বেলাভূমিতে।
আমাদের বিয়ে হয়েছে দুদিন হলো, সেটা আগেই বলেছি।
কিভাবে বিয়ে হয়েছে জানেন?
বিয়েটা ছিল অন্যরকম।
সিনেমার ঘটনার মতো বলতে পারেন।
সেদিন নানুবাড়ি থেকে বাড়ি ফিরছিলাম।
৫০ কিঃমিঃ দূরত্বের পথ।
জানালার পাশে বসেছিলাম। পাশের সিটটা খালিই পড়ে ছিল।
আপনারা তো জানেন লোকাল বাসে কি ঘটে।
২০০ মিটার দূর থেকে কোন যাত্রী ইশারা করলেও গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করে তাকে উঠানোর জন্য।
একটা জায়গায় বাস থামলো, সেখানে একটা মেয়ে উঠলো। মেয়ে নয় যেন, ছেলের বড়ভাই!
মেয়েটা কোনদিকে না তাকিয়ে নিঃসঙ্কোচে ধুরমুর করে আমার পাশে বসল।
বসেই হাফ ছেড়ে বলল, থ্যাং গড! সিট তাহলে পেলাম!
দেখে মনে হলো, পশ্চিমা মেয়েদের চাল-চলন বেশ অনুসরণ করে মেয়েটি।
সিটে দু-মিনিট বসেই সে আর চুপ থাকতে পারল না।
আমাকে লক্ষ্য করে বলল-হ্যালো! আমি পিংকি।
আমি তাতে অবাক হইনি, কারণ এরকম মডার্ন মেয়েদের কাছে এটা কোন ব্যাপারই না।
আমিও বললাম-হাই! আমি হিমেল।
আমি তালতলা যাব,আপনি? মেয়েটা বলল।
এভাবে বাসের এক ঘণ্টায় অনেক কথাই হলো।
মোবাইল নম্বর, ফেইসবুক আইডির লেনাদেনাও হয়ে গেল।
পিংকি নেমে গেলে বাস থেকে।
হাত নাড়িয়ে টা টা জানাতে ভুললো না সে।
জবাবে আমিও হাত নাড়ালাম।
মেয়েটা মডার্ন আর আল্ট্রা-মডার্ন সেইসঙ্গে অসম্ভব সুন্দরীও ছিল।
তারপর থেকে আমাদের নিয়মিত ফোনে কথা বলা, ফেইসবুকে চ্যাটিং চলতে থাকলো।
কথায় আছে না, একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মাঝে বন্ধুত্ব হয় না বা হলেও সেটা বন্ধুত্বের মধ্যে বেশিদিন থাকে না।
আমাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
বন্ধুত্ব প্রেমে রূপ নিলো।
কয়েকমাস চুটিয়ে প্রেম করলাম অতঃপর বিয়ের আলোচনা।
দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ের দিন তারিখও ঠিক হলো।
বিয়ের দিন হঠাৎ আমার একটা ফোন আসলো।
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে অচেনা লোকটি যা বললেন তা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে টপাক করে মাটিতে পড়ে গেলাম!
পড়েই যেন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লাম আমি।
রক্তাক্ত হয়ে গেলাম।
যেন, হৃদয়ের মগজ বেরিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল!
লোকটি বলেছিলেন-
আমি যাকে বিয়ে করছি সে নাকি বিয়ের আগেই ডজনখানেক ছেলের সঙ্গে বিছানায় গিয়েছিল, এটা নাকি তার কাছে মামুলি ব্যাপার!
কথাগুলো বিশ্বাস হলো আমার। কারণ পিংকি তো মডার্ন, সে তো পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসারী।
রাগে-ক্ষোভে পা-ুর হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, কোনভাবেই পিংকিকে বিয়ে করব না।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম-বিয়ে না করার ঘোষণাটা বিয়ের আসরে সবার সামনে উপস্থাপন করব।
মনের কথা মনে চেপে রেখে বর সেজে বিয়ে করতে গেলাম।
ওহ্ স্যরি! বিয়ে করতে নয়, বিয়ে ভাঙতে।
ওখানে গিয়ে সবার সামনে উচ্চকণ্ঠে বিয়ে না করার ঘোষণা দিয়ে আমি পালাতে লাগলাম।
সবাই আমার পিছু পিছু ছুটতে লাগলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একটা মাঠে চলে আসলাম।
হাফাতে লাগলাম আমি।
ভাবলাম পেছনে কেউ নেই।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই পরিবারের লোকজন হাজির।
আমাকে ঘিরে ধরল সবাই।
কারণ জানতে চাইলো।
আমি পকেট থেকে বিষের শিশি বের করে সবার উদ্দেশ্যে বললাম-এই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইলে আমি এখানেই বিষ পান করব।
কেউ আমাকে জোর করবেন না।
আমার এমন কথা শুনে সবাই শুকনো কিসমিসের মতো চুপসে গেল।
পিংকিও ছিল ওখানে।
পিংকির দিকে তাকাইনি আমি।
হঠাৎ করেই চোখ পড়ল ওর দিকে।
তার চোখে-মুখে বিধ্বস্ততার স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। ঠিকরে বের হচ্ছে বিধ্বস্ততা। যেন, যুদ্ধ ফেরত কোন পরাজিত সৈনিক।
তার চেহারায় আকুতির বীণ বাজছে।
পিংকির দিকে তাকানোর পর আমি কেমন জানি নিস্তেজ হতে লাগলাম।
শরীরের শক্তিগুলো যেন উবে যাচ্ছিল।
আমার রাগ আর ক্ষোভগুলো নিমিষেই সপ্ত আসমান পেরিয়ে অজানা কোন প্রান্তে চলে গেল।
পিংকির অনুশোচনা ভরা মায়াবী মুখখানার কাছে আমি পরাজিত হলাম।
অসহায় আত্মসমর্পণ করলাম ওর বিধ্বস্ততা আর অনুশোচনার কাছে।
মনে মনে ভাবলাম, যে মেয়েটা ডজনখানেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করার পর কিছু মনে করেনি সেই মেয়েটাই আজ বিপর্যস্ত।
অনুশোচনায় কাতর।
সে হয়তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। ভালো হওয়ার পথ খুঁজছে।
আমার উচিত তাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনা, তাকে ভালো হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।
এতক্ষণ ধরে সবাই চুপচাপ।
কেউ একটা কথাও বলেনি।
সবার নীরবতা আমিই ভাঙলাম।
আমি সবার উদ্দেশ্যে বললাম-শুনুন! আমি বিয়ে করব।
আমার কথা শুনে সবার যেন পুনঃজন্ম হলো।
প্রাণ ফিরে আসলো সবার মনে।
সবার চুপসে যাওয়া মুখগুলোতে রসের সঞ্চার হলো।
মাঠের মধ্যেই আমার মামা কাজিকে ডেকে নিলেন।
সেখানেই খোলা মাঠে আকাশ বাতাসকে সাক্ষী রেখে আমাদের বিয়ে হলো।
খুশির বন্যা বইতে লাগলো সবার মনে।
শীর্ষ সংবাদ: