ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লিটন আব্বাস

জল জোছনায় জলছবি

প্রকাশিত: ১২:৫১, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

জল জোছনায় জলছবি

কবিতা বা শিল্পের চেয়ে জীবন বড়। তার বৈচিত্র্যকে কবিতা উপলব্ধি করতে চায় তার নিজের মতো করে। এ হলো জীবন সত্যকে তুলে ধরা। কবি, চিত্রকর, লেখক-শিল্পী সকলেই এই সত্যকেই নান্দনিক দৃষ্টিতে আবিষ্কার করতে চাইছেন। জীবনকে আমরা তখন নতুন চোখ দিয়ে দেখি আর তখনই উৎকৃষ্ট সৃজন সর্বজনীনতার মহিমা অর্জন করে- এই বোধেই কবিতার পাঠক অনুশীলনে অনুরাগী হয়। এই বোধই কবির প্রকৃত চালিকাশক্তি- যা সৃজনে প্রেরণা দেয়। তাকে যথার্থ সহায়তা দেয় বারুদের গন্ধ, ঘামের গন্ধ, কষ্ট-যন্ত্রণা দগ্ধ সময় আর নিজস্ব দুঃখবোধ বা আনন্দের উপলব্ধি যা কবিতা জন্মের সময় একটা বাস্তব ভূমি থেকে উৎসারিত হয়। কবিতা তখনই শব্দের আবরণে নিজেকে প্রকাশ করে- জল জোছনায় জলছবি’ গ্রন্থের কবি কবি বাবলু জোয়ারদার তার ব্যতিক্রম নয়। কবির শিল্প চেতনা, ভাবনার গভীরতা, শাব্দিক উচ্চারণ এবং নির্মাণকৌশল তার কবিতাকে পাঠকগ্রাহ্য করে তোলে। তার ‘কাব্যস্তনের শিহরণ’ কবিতায় লক্ষ্য করি- ‘ধ্রুপদি কষ্টের ভেতর প্রজ্ঞা-আলোর স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায়। কাব্যস্তনের শিহরণে খুলে যায় বুকের ভেতর অন্য দরজা।’ মাত্রা রক্ষায়, ছন্দ বিন্যাসে খুব সতর্ক না থাকলেও কবিতার ভাববস্তু নিয়ে কবি ভেবেছেন গভীরভাবে। মানবিক অনভূতির স্পর্শ ছড়িয়ে আছে ‘যুদ্ধের সন্তান’ কবিতায়। ‘জোছনার গন্ধ মেখে আত্মহারা হলে অন্ধকার নেমে আসে ফণা তুলে তারপর বিষ উগড়ায় তখন আবার যুদ্ধ যুদ্ধ এভাবে আমরা যুদ্ধের সন্তান’ এক অন্তরঙ্গ উচ্চারণে শৈল্পিক নিবিড়তা পেয়েছে। এ দুঃখ তার ব্যক্তিগত নয়- বাস্তবের যে বাতাবরণে আমরা থাকি তাকে বাদ দিয়ে তো কোন সৃজনচিন্তা সার্থকভাবে স্পর্শ করতে পারে না। সেই বেদনার বারুদ প্রকম্পিত হয়েছে তার ‘মানবিক পুরাণ’ কবিতায়। ‘মানবিক পুরাণ থেকে থেকে উঠে এসে পরিব্রাজক পাখিটি উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ভীষণ ক্লান্ত প্রাণ গান জমা দিয়ে মানুষের কাছে ডেকে নিল সমাহিত সুন্দর-নিজের বুকের ভেতর অতঃপর সাদা বক হয়ে গেল পাখিটি শোক ঢেলে দিয়ে সাদা কুয়াশার ভেতর হারিয়ে গেল...’ কবিতার কোন সীমানা নেই। কবির চেতনায় এবং অবেচতনায় যা কিছু অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বকে নাড়া দেয় তা, সৃষ্টিশীলতার অমোঘ টানে, সমাজ পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি কবিতার কাছে নতজানু হয়ে পাঠকের কাছে অনায়াসে পৌঁছে দেন তার বার্তা আর সেখানেই প্রকৃতি ও মানুষ মিলে-মিশে এক শৈল্পিক সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়। ‘একখ- বাংলাদেশ’ কবিতায় স্বদেশের জাত্যাভিমান সহজ রূপ ও রং মিলে যে রেখার সৃষ্টি হলো তা মূলত দেশ ও মানুষের আকৃতি পায়- ‘গতকাল আকাশ থেকে একটি নক্ষত্র খসে পড়ল আজ আকাশে একটি নক্ষত্র উদিত হয়ে রোদের চাদর বিছিয়ে দিল জমিনে গ্রহণলাগা চাঁদ হৈহৈ করে হেসে উঠল আকাশটা হয়ে গেল একখ- বাংলাদেশ’ আবার মিলিত মানুষের স্বরূপনিধিয়ো উচ্চারিত হয় ‘ঋদ্ধতা’য় এভাবে- ‘সঙ্গমের সুখে সম্পদ বাড়ালে মানুষকে ভালবেসে ঋদ্ধ হলে না’ কবির ‘দিঘল পুরুষ’ কবিতায় পরিণত মস্তিষ্কের ছাপের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধোত্তর এক নৃশংস ভয়াল ট্র্যাজেডির সুর পাই এভাবে যা আগস্ট বা শ্রাবণ ট্রাজেডি নামে পরিচিত- ‘একদিন শ্রাবণ মেঘের অন্ধকারে হায়নার নির্মম আঘাতে আমাদের দিঘল পুরুষ চলে গেল অভিমানে নদীগুলো রক্তে ভরে গেল পাখিদের গান থেমে গেল আর মানুষেরা পুনরায় আরশোলা হয়ে গেল।’ দিঘল পুরুষটি আর কেউ নয় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর আরশোলা চরিত্রটি প্রতীক মূলত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সপরিবারের ঘাতক-’৭৫-এর পনেরো আগস্টের খুনী। এক প্রতীক ব্যঞ্জনার ভেতর দিয়ে এবং শব্দ চর্চার মধ্যে কবি অন্বেষণ করেছেন এই সত্য- এই ইতিহাস যা পাঠককে অপার দুঃখতৃপ্তির স্বাদ এনে দেয়। অধিকাংশ কবিদের হৃৎমাজারে এক রূপক চরিত্র থাকে নিশ্চয় সেই চরিত্রের মূলে নারী। জলজোছনায় জলছবির কবিও ব্যতিক্রম নয় তার রিদিকা পর্বের পাঁচটি কবিতায় নিজের ব্যথা-বেদনা, প্রেম-ভালবাসার খোঁজটাই করেছেন এবং এই চরিত্রের ভেতর একটা আলোর আভাস অন্বেষণ করেছেন এই খোঁজটাই কবির ধর্ম তার অপার অতৃপ্তি। তৃপ্তির পরিসমাপ্তি হয়তো ঘোচে না কোন কবির জীবনে। ‘আমি উত্তর পুরুষে হেঁটে যাব রেখে যাব কিছু সৌরভ-কিছু ঐশ্বর্য ... আর তখনই ভালোবাসা ঝর্নাজল হবে মানবতা ঝর্নাজল হবে গায়ত্রীসন্ধ্যার পবিত্রতা ছড়াবে ইথারে’ এখানেও উত্তর পুরুষ প্রতীক- এক ঐতিহাসিক চরিত্র যা একজন আদর্শবান কবিকে ইতিহাস চেতনা থেকে দূরে রাখে না এবং নিজের দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার ভুলে যায় না- এই জায়গায় কবি বাবলু জোয়ারদারের মতো অধিকাংশ কবিই অটুট। সে কারণেই শিল্পের চূড়ান্ত বিচার পাঠকের পরিশীলিত অনুভবের উপর বর্তায়। এটাও হয়তো শেষ কথা নয়। অনেক সময় দেখা গেছে তাৎক্ষণিক বর্জনের বহু সময় অতিক্রম করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা সমাদার পায় পুনর্বিবেচনার নতুন উপলব্ধি কল্যাণে। রাজশাহীর রাঢ়বঙ্গ প্রকাশনী থেকে ২০১৮ সালে প্রকাশিত ২০০ টাকা দামের চারফর্মার ‘জলজোছনায় জলছবি’ কাব্যগ্রন্থটির কবিতা পাঠস্বাদ অন্য বৈচিত্র্যে আত্মপ্রকাশ করেছে, যা একজন কবির অস্তিত্বের মহিমা এবং তার অন্তর্বস্তু বা সাংকেতিকতা, ব্যঞ্জনা, ভাবনা অথবা সরলভাবে বললে বক্তব্য, শব্দকে আশ্রয় করেই আত্মপ্রকাশ করেছে। আর পাঠকও পরম সাগ্রহে তার পাঠ এগিয়ে নিতে ও অন্বয় করতে অন্যরকম এক অনুভূতির খোরাক যোগাবে নিঃসন্দেহে তা বলা চলে- এতেই কবিতার মুক্তি, কবিকে বাঁচতে ও লিখতে উসকে দেয়ার প্রেরণা, কবির কলমে জোগাবে নতুন নতুন ভাষা।
×