ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্রমণকন্যাদের চোখে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

ভ্রমণকন্যাদের চোখে বাংলাদেশ

সাকিয়া হক, মানসী সাহা তুলি, সিলভী রহমান, শামসুন নাহার সুমা। মেধাবী চার তরুণী। ভ্রমণে জনকল্যাণমূলক কাজ করে সাড়া ফেলেছেন। তারাও ভ্রমণ করেন। তবে সেটা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে। ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন বয়োসন্ধিকালীন সমস্যা, সমাধান, খাদ্য, পুষ্টি সুরক্ষার কৌশল, স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশ্নোত্তর, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে। ভিডিও প্রদর্শন করেন। মেয়েরা নির্ভয়ে তাদের সমস্যার কথা খুলে বলে। সঠিক সমাধান বাতলে দেন ভ্রমণ কন্যারা। নিজ খরচায় তারা ভ্রমণ করেন। ট্র্যাভেলেটস অব বাংলাদেশ ভ্রমণ কন্যাদের সংগঠন। প্রতিষ্ঠাতা সাকিয়া হক ও মানসী সাহা তুলি। দুজনেই চিকিৎসক। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের একটি প্রজেক্ট নারীর চোখে বাংলাদেশ। এই প্রজেক্টের আওতায় ৫৫টি জেলা ভ্রমণ শেষ হয়েছে। আটটি ধাপ সম্পন্ন করেছে তারা। তবে ব্যক্তিগতভাবে ইতোমধ্যে সাকিয়া হক, মানসী সাহার ৬৪টি জেলা ভ্রমণ শেষ হয়েছে। ভ্রমণকন্যাদের সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জানাচ্ছেনÑ মুহাম্মদ শফিকুর রহমান সাকিয়া হক সাকিয়ার ভ্রমণের নেশাটা ছোটকাল থেকেই। সময় পেলেই এদিক সেদিক ঘুরে আসতেন। যখন ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হলেন। ভ্রমণের নেশাটা আরও জোরালো হলো। পাশে পেলেন বন্ধু মানসী সাহা তুলিকে। অষ্টম শ্রেণী থেকে তাদের বন্ধুত্ব। স্কুটিতে সাকিয়া ৫৭টি জেলা ভ্রমণ শেষ করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণ মিলিয়ে মোট ৬৪টি জেলা বাংলাদেশে সাকিয়া হক আর মানসী সাহা হবেন প্রথম দুই নারী, যারা বাংলাদেশে প্রথম স্কুটিতে করে ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করেছেন। আর জন্য তাদের আর মাত্র ৭টি জেলা স্কুটিতে ভ্রমণ করতে হবে। এত যানবাহন থাকতে স্কুটি কেন? সাকিয়া বলেন- আমরা নিজেরাই স্কুটি বেছে নেই। বাইসাইকেল নিলে সময় বেশি লাগত। ১২৫ সিসি, অকটেনে চলে এমন স্কুটি হলো ভ্রমণকন্যাদের যানবাহন। ৬ এপ্রিল ২০১৭ প্রথম তারা স্কুটিতে ভ্রমণ শুরু করেন। ভ্রমণপ্রিয় নারীদের সম্পূর্ণ আস্থা পেয়েছে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ। দেশে বিদেশে স্বীকৃতিও মিলেছে অনেক। জানাল সাকিয়া হক। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ জয়বাংলা কনটেস্ট ২০১৮তে ফাইনালিস্ট ছিল। নির্বাচিত ১০০ তরুণকে নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । সেখানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পান সাকিয়া হক। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের পক্ষে। ২০১৮তেই ট্র্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় সম্মাননা পায় দেশের বাইরে থেকে। মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদের মেয়ে মেরিনা মাহাথির ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানায়। বিভিন্ন দেশের শতাধিক প্রতিনিধির মধ্যে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সাকিয়া হক নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বক্তব্য রাখেন। পেশা চিকিৎসক বলে নয়। মানবকল্যাণ সাকিয়ার ধ্যান-জ্ঞান। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সম্মাননা পেয়েছেন অনেক। বাংলাদেশে চারটি ক্যাটাগরিতে চারজনকে কীর্তিমান নারী সম্মাননা দেয় একটি শীর্ষ স্থানীয় কোম্পানি। সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলার মধ্যে পুরস্কার পান ডা. সাকিয়া হক। সাকিয়ার জন্য এটি ছিল অবিশ্বাস্য সাফল্য। তিনি বলেন- আমার জন্য অবিশ্বাস্য কারণ আমি এখনও যোগ্যতা অর্জনের শুধু চেষ্টা করে চলছি। ইতোপূর্বে আসলে একাকি ভ্রমণে যাওয়ার প্লাটফর্ম বা গ্রুপ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল। কিন্তু ট্র্রাভেলেটস অব বাংলাদেশকে খুঁজে পাবার পর আর সমস্যা হয়নি। নিশ্চিন্তে দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখছি। এমনটাই বললেন সুমনা করিম। তবে ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশেকে সক্রিয় রাখতে ভূমিকা রাখছেন আরও অনেকে। মানসী সাহা তুলি খুলনার মেয়ে মানসী সাহা তুলি। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। গল্পের বই পড়া তার অভ্যাস। গল্পে কত জানা অজানা দেশের কথা। মানসীর ইচ্ছা হয়, এমন সব দেশ যদি ঘুরতে পারতাম। ২০০৫ সাল। তার ছোড়দা বগা লেক ঘুরে এলেন। গল্প করলেন মানসীর সঙ্গে। দেশ বেড়ানোর ইচ্ছাটা তখন তার আরও বেড়ে গেল। মেডিকেলে পড়তে এসে পেলেন সাকিয়া হককে। সাকিয়াও ছিলোদেশ ভ্রমণের নেশা। দু’জনে মিলে শুরু করলেন ভ্রমণ। দশটির মতো জেলা ভ্রমণ হলো। তারপর শুরু করলেন নারীর চোখে বাংলাদেশ প্রজেক্ট। শুধু নিজেরা ভ্রমণ করলে তো হবে না। এক সময় অন্য নারীদের কথাও ভাবলেন মানসী। ২০১৬ সালের ১৭ নবেম্বর। মানসী আর সাকিয়া গড়ে তুললেন ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ। মেয়েদের প্রথম ট্রাভেলিং গ্রুপ। শুরুতেই ভাল সাড়া পড়ল। অনেক নারী এগিয়ে এলেন। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ গ্রুপে নারীরাই ভ্রমণের আয়োজন করে, অংশগ্রহণ করে। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সদস্যরা প্রথম ভ্রমণে যায় ২০১৭ সালের ২৯ জানুয়ারি। ১৯ জন মেয়ে ছিল সে দলে। গন্তব্য ছিল নরসিংদীর সরিষা ক্ষেত ৭০ বছরের বৃদ্ধ, ২০ বছরের তরুণীও আছেন। মেঘনার পাশে রাত কাটানো, নিঝুম দ্বীপে রাতের ক্যাম্পিং, বান্দরবনের পাহাড়ী পথে হেঁটে গিয়ে ঝর্ণার দেখা পাওয়া এসব কিছুতেই মানসী মুগ্ধ। তা ভাষায় এই ছোট জীবনে এও বা কম কিসে? আর সাকিয়া, সুমা, সিলভীর মতো ভ্রমণসঙ্গী পেয়ে ও সে খুব খুশি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সাড়া, ভালবাসা তাকে মুগ্ধ করেছে। গেল নারী দিবসের কথা। দৈনিক ভোরের কাগজ ভ্রমণকন্যাদের সম্মাননা প্রদান করে। নারীর চোখে বাংলাদেশ আসলে কেমন? ডা. মানসী সাহা তুলি বলল, নারীর চোখে সবচেয়ে বড় পাওয়া মনে হয়, স্বাধীনতার স্বাদ। স্বাধীনভাবে মানুষের জন্য কাজ করতে পারার মজাই আলাদা। গরিব, দুঃখী অসহায় কেউ এলো। পরম যতœ, মমতা দিয়ে মানসী তার চিকিৎসা করেন। এতেই তার আনন্দ। কী পেলেন বা পেলেন না। এসব একদমই ভাবেন না। চলতে ফিরতে দু-চারটা কটু কথা যে কানে আসেনি। তা ও কিন্তু নয়। কারও বাজে মন্তব্যকে বুড়ো আগুন দেখিয়ে তার চোখের সামনে দিয়ে সাই করে গাড়ি ছুটিয়ে যাওয়ার মতো আনন্দ কমই আছে। বলল মানসী সাহা তুলি। মানুষের কল্যাণে তিনি কাজ করে যেতে চান। এটাই তার ইচ্ছা। সিলভী রহমান চার ভ্রমণকন্যাদের একজন সিলভী রহমান। জয়পুরহাটের মেয়ে। পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা ভার্সিটির টুরিস্ট সোসাইটির সঙ্গে ভ্রমণে যেতেন। তবে তার ভ্রমণের উৎসাহটা আসে সানজিদ সৈকত থেকে। সানজিদ সৈকত তার বড় ভাই। শুধু দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতেন। আবার সে গল্পও করতেন সিলভীর সঙ্গে। ভাইকে দেখে সে ভ্রমণে উৎসাহিত হয়। পরিবার তেমন বাধা দিত না। যদি না নিরাপত্তার ব্যাপারটা থাকত। বলল সিলভী। সিলভীর বাবাও ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। বাবা তার ভ্রমণের অন্যতম অনুপ্রেরণা বলে জানান। ব্যক্তিগতভাবে ৫০টি জেলা ভ্রমণ করেছে সিলভী। আর নারীর চোখে প্রজেক্টে তার ভ্রমণকৃত জেলার সংখ্যা ২৪। ভ্রমণকন্যারা দুটি স্কুটিতে করে ভ্রমণ করেন। সিলভী থাকেন সাকিয়া হকের বাইকের সঙ্গে। ছোটবেলায় ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সিলভী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে মাস্টার্স করেছেন। নতুন শহর, মানুষ আমাকে খুব টানে। ভ্রমণে মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার সম্পর্কে জানা যায়। মানুষজন এত আন্তরিকভাবে আমাদের গ্রহণ করে। যা শত কষ্টকেও ভুলিয়ে দেয়। বলল সিলভী রহমান। নারীর চোখে বাংলাদেশ প্রজেক্টে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কেমন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সিলভী বলেন, বিভিন্ন স্কুলে বাচ্চাদের উচ্ছ্বাসিত চেহারা আমাদের খুব আনন্দ দেয়। দু’চোখ ভরা তাদের কৌতূহল। স্বপ্ন। তারা যেন আমাদের দেখে স্বপ্ন পূরণে উৎসাহী হয়। তাদের না বলা কথাগুলো অনায়াসেই বলে ফেলেছে আমাদের কাছে। সমাধান বাতলে দিয়েছি। এমনই সব মধুর আনন্দের অভিজ্ঞতা। বললো সিলভী রহমান। সিলভী হার না মানা সাহসী মানুষ। স্কুটিতে চড়ে ভ্রমণ। সাহস তো লাগেই। মানুষের জন্য সব সময়ই সিলভী কাজ করে যেতে চান। পর্যটন স্থানগুলো যেন নোংরা না হয়। ভ্রমণকারীরা সে খেয়াল রাখবেন। এটাই তিনি প্রত্যাশা করেন। তার মতে, পর্যটনে অমিত সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ। সম্ভাবনাকে তুলে ধরার প্রয়োজন দেশ-বিদেশে। শামসুন নাহার সুমা কোথায় যাবে? কারা সঙ্গে থাকবে? নিরাপত্তা আছে কি? এমন শত প্রশ্ন করেছিল সুমার অভিভাবক। ভ্রমণে যাবার কথা বলতেই। সেদিন সুমার খুব মন খারাপ হয়। একদিন ফেসবুকে ট্র্যাভেলেটস অব বাংলাদেশ নামে একটি গ্রুপ তার চোখে পড়ল। শুধু মেয়েদের ভ্রমণের গ্রুপ। সব কিছু জানলেন। পরিবারকে বোঝালেন। পরিবারও বুঝল, মেয়েরা মেয়েরা ভ্রমণে যাচ্ছে, ভালই তো। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশের সঙ্গে সুমার প্রথম ভ্রমণ নারায়ণগঞ্জ। এর আগে ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনেক জেলা বেড়ান। তিনি ৩১টি জেলা ভ্রমণ করেছেন। এর মধ্যে নারীর চোখে বাংলাদেশ প্রজেক্টে আছে ১৬টি জেলা। খাওয়া-দাওয়া আর দর্শনীয় স্থান দেখা। এটাই যখন ভ্রমণে অধিকাংশ মানুষের কাজ। সুমার চোখে তখন অন্য স্বপ্ন। নারী নিজের পায়ে দাঁড়াবে। নিজের অধিকার কি তা জানবে, বুঝে নেবে কড়ায় গ-ায় নিজের অধিকারটুকু। সুমা অনুভব করলেন এ জন্য তৃণমূলে গিয়ে কাজ করতে হবে। সে জন্য তাদের টার্গেট স্কুলের ছাত্রীরা। আমরা প্রতি জেলার একটা করে স্কুলে গিয়ে কথা বলি। বয়োসন্ধিকালীন সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ, আত্মরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলি। ভিডিও দেখিয়ে ব্যাখ্যা করি। যে সমস্যার কথা ওরা কাউকে বলেনি। বলবার সুযোগ কিংবা সাহস পেত না। তা আমাদের খুলে বলত। বলল শামসুন নাহার সুমা। দেশের দক্ষিণের জেলা বরগুনা। সেখানেই সুমার জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে পড়ছেন তিনি। ক্লাস, পরীক্ষা, সামর্থ্য সব সুবিধা যখন মিলে যায়। তখনই ব্যাগ গুছিয়ে ভ্্রমনে বেড়িয়ে পড়েন। হিমু পরিবহন। হুমাযুন আহমেদ এর ভক্তদো সংগঠন। যারা বাংলাদেশে বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার লক্ষ্য কাজ করছে। সুমা এই সংগঠনের সাথে যুক্ত। সুমা জানালো, মেয়েদের নিয়ে আরো কিছু জনকল্যানমুলক কাজ করা ইচ্ছে তার রয়েছে। ভ্্রমনে সুমা চড়ে বসেন মানসী সাহার বাইকের পিছনে।
×