ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এরশাদের সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

এরশাদের সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সময়ের দোর্দ- প্রতাবশালী সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এখন একেবারেই অসহায়। স্ত্রী, সন্তান, ভাইসহ অনেকেই আছেন তার। আবার বলতে গেলে থেকেও কেউ নেই। জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে তিনি কাউকে আর বিশ^াস করতে পারছেন না। দেখার মতো আপনজনও নেই। ট্রাস্ট গঠনের মধ্য দিয়ে নিজের সম্পত্তি দান ও স্বাক্ষর জাল করে সম্পদ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় সর্বশেষ থানায় এরশাদের ডায়েরি নানামুখী আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন সম্পদ রক্ষায় কবি ও প্রেমিক মনের এরশাদকে সারাক্ষণ থাকতে হবে পুলিশী নজরদারিতে। ইতোমধ্যে ঘটনার তদন্তে নেমেছে পুলিশ। মূলত সম্পত্তি নিয়ে কাড়াকাড়ির কারণেই তাকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো। জাপার নেতাকর্মীরা বলছেন, বয়সের কারণে এরশাদের আর রাজনৈতিক ভবিষ্যত নেই। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তিনি অংশ নিতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময়েই এরশাদ বলেছিলেন এটাই তার শেষ নির্বাচন। তাছাড়া বয়সের কারণে এক সময়ের আলোচিত এই প্রেমিক মানুষটির শরীর একেবারেই ভাল যাচ্ছে না। তবে সাবেক প্রেমিকাদের মধ্যে বিদিশার সঙ্গে ছেলের বদৌলতে মাঝে মধ্যে দেখা হয়। এই সুযোগে এরশাদের সম্পত্তির দিকে চোখ গেছে অনেকের। তৎপর সুযোগ সন্ধানীরাও। ঘরে-বাইরে সম্পদ গ্রাসের অশুভ তৎপরতা নিজেও বুঝতে পেরেছেন চতুর এই স্বৈরশাসক। তাই তিনিও চান- কেউ যেন অন্যায়ভাবে সম্পদ গ্রাস করতে না পারে। এরশাদের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানিয়েছে, পারিবারিকভাবে এরশাদের সম্পত্তি চান এমন রয়েছেন অন্তত ছয়জন। এছাড়া দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে রয়েছেন আরও অন্তত চারজন। রয়েছেন এরশাদের একাধিক ঘনিষ্ঠ ও বিশ^স্ত কর্মীও। যারা নানা প্রয়োজনে এরশাদের কাছে নিয়মিত যাতায়াত করে থাকেন। সম্প্রতি এরশাদের বাসায় তাদের আনাগোনা বেড়েছে। তাই এরশাদ নিজ বাসা প্রেসিডেন্ট পার্কে বাড়তি মানুষের যাতায়াত সংরক্ষিত করেছেন। জানা গেছে, এরশাদের সম্পত্তির পারিবারিক দাবিদারদের মধ্যে রয়েছেন স্ত্রী রওশন, জিএম কাদেরসহ এরশাদের ছোট ভাই, এরশাদের এক ভাতিজা, সাদসহ আরও একাধিক ব্যক্তি। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে যারা আছেন তাদের কয়েকজনকে এরশাদ এমপি থেকে মন্ত্রী পর্যন্ত বানিয়েছেন। বিশ^াস করে রাজনৈতিক ছায়ায় আগলে রেখেছেন যুগের পর যুগ। তারাই এখন এরশাদের সম্পদ গ্রাসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তবে নেতারা যে যার মতো করে বুঝিয়ে সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে এরশাদের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে। বারিধারার এরশাদের বাসায় প্রতিবন্ধী ছেলে এরিক ছাড়া আপনজন বলতে কেউ নেই তার। বাদ বাকি যারা আছেন সবাই কর্মচারী। তাদের ওপর ভরসা করেই এরশাদকে চলতে হচ্ছে। সম্প্রতি দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এরশাদের সঙ্গে ছিলেন সবার ছোট ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী। স্ত্রী রওশন দীর্ঘদিন আলাদা থাকেন গুলশান দুই নম্বরে নিজ বাসায়। ভাই জিএম কাদেরও থাকেন আলাদা। ছেলে সাদও তার পরিবার নিয়ে থাকেন মালয়েশিয়ায়। চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর থেকেই এরশাদের সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে সম্পদ ট্রাস্টের নামে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন বারবার মত পাল্টানো নেতা। কিন্তু গত এক সপ্তাহে সম্পত্তি নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি অবস্থা। দাবিদার অনেক। কেউ উত্তরসূরি হিসেবে। কেউবা বিশ^স্ত নেতা বা কর্মী হিসেবে সম্পদ নিতে চান। অনেকেই চান ষড়যন্ত্র করে সম্পদ হাতিয়ে নিতে। তাই বুধবার রাতে সম্পদ রক্ষা ও নিজের নিরাপত্তায় থানায় ডিজি করেছেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। স্বাক্ষর জাল করে সম্পদ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এমন তথ্য অভিযোগে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি। বুধবার রাতে এরশাদের পক্ষে একজন প্রতিনিধি বনানী থানায় ওই জিডি (নম্বর ১৫০২) করেন বলে নিশ্চিত করেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ বলছে, উনার (এরশাদ) কাছ থেকে অনেকে স্বাক্ষর নিয়েছেন বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই প্রটেকশন হিসেবে এই জিডি করা হয়। জিডিতে এরশাদ উল্লেখ করেছেন, তার বর্তমান ও অবর্তমানে স্বাক্ষর নকল করে পার্টির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, দলের বিভিন্ন পদ-পদবি বাগিয়ে নেয়া, ব্যাংক হিসাব জালিয়াতি এবং পারিবারিক সম্পদ, দোকানপাট-ব্যবসা-বাণিজ্য হাতিয়ে নেয়া ও আত্মীয়-স্বজনদের জানমাল হুমকির মুখে রয়েছে। এ কারণে তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে কেউ যেন এমন অপরাধ করতে না পারে, সে বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দরকার বলে জিডিতে বলা হয়েছে। বনানী থানার এসআই মোহাম্মদ মুকুল হোসেন বলেছেন, এ বিষয়ে পরিদর্শক (অপারেশন) সায়হান ওয়ালীউল্লাহকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিছু দিন ধরে অসুস্থ ৯০ বছর বয়সী সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ সম্প্রতি একটি ট্রাস্ট গঠন করে সেখানে তার সব সম্পদ দান করেছেন। পাঁচ সদস্যের ট্রাস্টে এরশাদ নিজে সদস্য হিসেবে থাকলেও স্ত্রী রওশন এরশাদ আর ভাই জিএম কাদেরকে রাখেননি। বোর্ডের অন্য সদস্যরা হলেন এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ, একান্ত সচিব ও ভাগ্নে অবসরপ্রাপ্ত মেজর খালেদ আক্তার, চাচাত ভাই মুকুল ও তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। কিছু দিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ এরশাদ গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে একদিনও প্রচারে যাননি। নির্বাচনের আগে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে ফেরার পর নির্বাচনের দিন ভোট দিতেও নির্বাচনী এলাকা রংপুরে যাননি এরশাদ। গত ৬ জানুয়ারি এমপি হিসেবে শপথ নেন এরশাদ, তবে তিনি সংসদে গিয়েছিলেন হুইল চেয়ারে চড়ে। এরপর ২০ জানুয়ারি আবার সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন এরশাদ। তখন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, রক্তে হিমোগ্লোবিন ও লিভারের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরশাদের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, নিজের অবর্তমানে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ নিরসনেই ট্রাস্ট গঠন করেছেন এরশাদ। দিন দিন সাবেক এই রাষ্ট্রপতির শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় ইতোমধ্যে তার দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদ নিয়ে পারিবারিক বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। নিজের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে বেশ সচেতন এরশাদ। তাই সর্বশেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এরশাদ নিজেই বলেছিলেন, ‘এটাই হয়ত আমার শেষ জন্মদিন। আর কোনদিন আমার উপস্থিতিতে হয়ত জন্মদিন পালন হবে না’। এরই ধারাবাহিকতায় অসুস্থ জাপা চেয়ারম্যান একটি ট্রাস্ট গঠন করে তাতে নিজের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দান করেছেন। ৯০ বছর বয়সী সাবেক এই সামরিক শাসক নিজেও ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্য হিসেবে আছেন। ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরশাদ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় লিখেছিলেন, তার নগদ টাকার পরিমাণ ২৮ লাখের মতো। হলফনামায় এরশাদ বার্ষিক আয় দেখান ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ব্যবসা থেকে তিনি আয় করেন দুই লাখ ৬ হাজার ৫০০ টাকা। ইউনিয়ন ব্যাংক থেকে সম্মানি হিসেবে ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ১০ টাকা পান এরশাদ। এছাড়াও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৬ টাকা জমা রয়েছে। বিভিন্ন শেয়ারে এরশাদের অর্থের পরিমাণ ৪৪ কোটি ১০ হাজার টাকা। তার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ও এফডিআর ৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, ডিপিএস রয়েছে ৯ লাখ টাকার। এরশাদ লিখেছিলেন, গুলশান ও বারিধারায় তার দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে যার দাম এক কোটি ২৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। এর বাইরে ৭৭ লাখ টাকা দামের একটি দোকান রয়েছে তার। যানবাহনের মধ্যে তার রয়েছে ৫৫ লাখ টাকা দামের ল্যান্ড ক্রুজার জীপ, ১৮ লাখ টাকা দামের নিশান কার এবং ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের আরেকটি ল্যান্ড ক্রুজার জীপ। জানা গেছে, ট্রাস্টের সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে- এরশাদের বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসা, গুলশানের দুটি ফ্ল্যাট, বাংলামোটরের দোকান, রংপুরের কোল্ড স্টোরেজ, রংপুরের বাড়ি ‘পল্লী নিবাস’, রংপুরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়, ১০ কোটি টাকার ফিক্সড ডিপোজিট। জাতীয় পার্টির একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন, গত প্রায় পাঁচ বছর আগে এরশাদের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় ও জাপা নেতা-চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল খন্দকার মিলে ‘পল্লীবন্ধু ট্রাস্ট’ গঠন করেছিলেন। এরশাদের অবর্তমানে সকল সম্পদ এই ট্রাস্টের আওতায় থাকবে মূলত এমন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ট্রাস্ট গঠন হয়েছিল। কিন্তু এতে সম্মত হননি এরশাদ। তাই পুরনো ট্রাস্টের কার্যক্রম আর সামনের দিকে যায়নি। এখন এরশাদ নিজেই ট্রাস্ট গঠন করেছেন। যেখানে নিজের সব সম্পত্তি দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
×