ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জামিনে মুক্ত দুই শতাধিক জঙ্গীর গা-ঢাকা

প্রকাশিত: ১০:৫৯, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

জামিনে মুক্ত দুই শতাধিক জঙ্গীর গা-ঢাকা

শংকর কুমার দে ॥ সারাদেশ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রায় চার হাজার জঙ্গী। এর মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছে দুই শতাধিক। আইনজীবীদের মাধ্যমে গড় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে এমন শতাধিক জঙ্গী জামিন নিয়ে আদালতে হাজিরা দিচ্ছে না। দেশে আটক ও কারাবন্দী এসব জঙ্গীর অবস্থা জানতে গিয়ে এ তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, আদালতে বিচারাধীন ও পুলিশের তদন্তাধীন এমন জঙ্গী মামলা রয়েছে ৮শ’। এর মধ্যে আদালতে বিচারাধীন মামলা ৫৫০। আর পুলিশের তদন্তাধীন এমন মামলার সংখ্যা আড়াইশ’। এসব মামলায় জঙ্গীরা গ্রেফতার হয়েছে, আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে গা ঢাকা দিয়েছে, আদালতে হাজিরা দিচ্ছে না। তদন্তে গাফিলতি ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার এক উর্ধতন কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা জামিন নিয়ে পলাতক হলেও আসামির জামিনদারদের জবাবদিহিতার অভাব থাকায় তাদের কারও বিরুদ্ধেই নেয়া হয়নি আইনানুগ কোন ব্যবস্থা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জঙ্গীরা নির্বিঘেœ জামিন নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গা ঢাকা দেয়া জঙ্গীদের মধ্যে অন্তত দুই ডজন ভয়ঙ্কর জঙ্গী, যারা সমরাস্ত্র পরিচালনাসহ শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরিতে পারদর্শী। সম্প্রতি দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে জঙ্গী সংগঠনের উত্থানের নেপথ্যে এসব দুর্ধর্ষ জঙ্গী কলকাঠি নাড়ছে। আবার কেউ কেউ কারাগারে আটক থেকেও জঙ্গী তৎপরতা চালানোর চেষ্টা করছে। জামিন নিয়ে পলাতক জঙ্গীদের অবস্থান চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জানান, জামিনে মুক্ত জঙ্গীরা কোথায় আছে সে বিষয়ে সঠিক কোন তথ্য নেই। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। এসব পলাতক জঙ্গীকে দ্রুত গ্রেফতার করা না গেলে দেশে নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। এসব ঘটনায় জড়িত জঙ্গীদের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলার রায় হয়েছে। শাস্তিও হয়েছে অনেক জঙ্গীর। এদের মধ্যে অন্তত এক ডজন জঙ্গীর ফাঁসি হয়েছে। যেসব জঙ্গীর ফাঁসি হয়েছে তার মধ্যে ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, আবদুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন ও খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। মামলায় পলাতক জেএমবি সদস্য আরিফ পরে গ্রেফতার হলে ’১৬ সালের ১৬ অক্টোবর তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০০৫ সালে ঝালকাঠিতে বোমা হামলা চালিয়ে দুই বিচারক হত্যা মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া ’১৭ সালের ১২ এপ্রিল বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতার গুরু ও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত হরকত-উল-জিহাদের (হুজি) নেতা মুফতি হান্নান, সদস্য শরিফ শাহেদুল আলম বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ১৪ বছর আগে সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে জিরো টলারেন্স ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সরকারের অগ্রাধিকার ও আন্তরিকতা থাকলেও মামলার তদন্ত ও বিচারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। চাঞ্চল্যকর জঙ্গী হামলার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংগঠনগুলোর নেপথ্যের মদদদাতাদের অনেকেই চিহ্নিত হচ্ছে না বলে তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছোট ছোট স্লিপার সেলে বিভক্ত হয়ে কাজ করায় আটকদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী অন্য জঙ্গীদের ধরা যাচ্ছে না। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় তাদের অবস্থানও চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অপরদিকে তদন্ত শেষে যেসব মামলায় আদালতে চার্জশীট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হচ্ছে সেসব মামলার বিচারেও তেমন অগ্রগতি নেই। নিয়মিত সাক্ষী হাজির না হওয়ায় মূলত এসব মামলার বিচারিক কার্যক্রম গতি হারাচ্ছে। ঢিলেঢালা সাক্ষী সুরক্ষা আইন হওয়ায় প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ সাক্ষীরা ভয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিতে হাজির হচ্ছেন না। এমনকি সাক্ষী হিসেবে যেসব পুলিশ রয়েছেন তারাও আদালতে অনুপস্থিত থাকছেন। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। এভাবে জঙ্গী মামলার তদন্ত ও বিচারে বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে। বিচারপ্রার্থীরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে হতাশ হয়ে পড়েছেন।
×