ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পুঁজিবাজারের জন্য বাজেটে প্রণোদনা থাকবে’

বাংলাদেশের মতো এত উচ্চ সুদের হার বিশ্বে কোথাও নেই ॥ অর্থমন্ত্রী

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

বাংলাদেশের মতো এত উচ্চ সুদের হার বিশ্বে কোথাও নেই ॥ অর্থমন্ত্রী

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পৃথিবীর কোথাও কোন দেশে বাংলাদেশের মতো উচ্চ সুদের হার নেই বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, এত বেশি সুদ দিয়ে কখনই ব্যবসা করা যাবে না। সুদের ওপর নতুন করে সুদ আরোপ করা হচ্ছে। এজন্য আগামীতে সুদের হার অনেক কমিয়ে আনা হবে। যাতে ঋণখেলাপী না হয়। এছাড়া বাজেটে পুঁজিবাজারের জন্য প্রণোদনা থাকবে। পাশাপাশি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদহারে কোন পরিবর্তন আসবে না বলে জানান অর্থমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার প্রাক বাজেট আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এই প্রাক বাজেট আলোচনা হয়। এতে দেশের এনজিও নেতৃবৃন্দ, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পাদক ও সাংবাদিক এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) কার্যনির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। মন্ত্রী বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা খুব ভাল আছে এটা বলব না। তবে খুব খারাপও নেই। এ খাতের উন্নয়নে এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হচ্ছে। অনেকেই খেলাপী ঋণের বিপরীতে কোন উদ্যোগ নিতে পারছে না। মামলা করতে পারছে না। এ সব বিষয়ে উদ্যোগ নিবে আসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি। আমার ওপর বিশ^াস রাখুন। অসততা আমাকে স্পর্শ করেনি, করবেও না। আমি অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছি। সাধারণ মানুষের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমি অনুরোধ করবো এই দেশটা আমাদের দেশের ক্ষতি হয়, দেশের মানুষের চলার পথে যাতে প্রতিবন্ধকতা না হয় সে জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। সবাই সবার জায়গা থেকে কাজ করতে হবে। আলোচনার শুরুতেই অর্থমন্ত্রী বলেন, কেউ ঋণ গ্রহণ করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যবসা করলে লাভ বা লোকসান হতে পারে। যারা লোকসান দেয় তাদের জন্য কিছু করার ব্যবস্থা থাকে না। ঋণখেলাপী হওয়ার পরও সব ব্যবসায়ীদের জেলে পাঠালে তো হবে না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। মন্ত্রী বলেন, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ যেসব পণ্য বিদেশ থেকে আসবে সেগুলো শতভাগ স্ক্যানিং হয়ে আসবে। আবার যেসব পণ্য রফতানি হবে সেগুলোও শতভাগ স্ক্যানিং করা হবে। তাছাড়া র‌্যান্ডম শ্যাম্পলিংয়ের মাধ্যমে পরিদর্শন করার ব্যবস্থা করা হবে। মন্ত্রী বলেন, যারা আয়কর দেয় তারা শুধু কর দেবে, আর যারা কর দেয় না তারা দেয়ই না। দেশের ৪ কোটি মানুষ কর দেয়ার যোগ্য হলেও কর দেয় মাত্র ২৯ লাখ। এজন্য ভ্যালু এ্যাডেড ট্যাক্স নির্ধারণ করা হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদহারে কোন পরিবর্তন আসবে না বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের রেট ও রিটার্নে আমরা হাত দিইনি, দেব না। তবে সঞ্চয়পত্রের সংস্কার নিয়ে কাজ চলছে। সঞ্চয়পত্রের যাদের জন্য করা হয়েছে শুধু তারাই এখানে বিনিয়োগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে তারা কোন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি বলেন, অনেক অবৈধ টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা হচ্ছে। ফলে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হওয়ার কথা তার চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাৎ যাদের সঞ্চয়পত্র থাকা দরকার তাদেরই থাকবে; তারাই কিনবে, তাদের কোন সুযোগ-সুবিধা কমবে না। পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, পুঁজিবাজারের উন্নতি ছাড়া দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। মন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে পুঁজিবাজারে ৫০ কোটি নয়, যদি পাঁচ লাখ কোটি টাকাও দেয়া হয় তাহলেও শেষ হয়ে যাবে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে বৈঠকের পর আমি বললাম বর্তমান বাজার যে খারাপ হচ্ছে এর পেছনে কেউ আছে। পরদিন ১০০ পয়েন্ট পড়ে গেল। যদি পুঁজিবাজার খারাপ অবস্থা বলতাম তাহলে কি হতো। অর্থমন্ত্রী বলেন, সামনে বাজেট। পুঁজিবাজার বিষয়ে বাজেটে কিছু না কিছু প্রণোদনা থাকবে। এখন বাজার ভাল হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে খারাপ হচ্ছে। এটি যারা করে তারা বুঝে শুনেই করে। এই সুযোগে তারা কম দামে শেয়ার কিনে ফায়দা লুটছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর হবো। তিন মাস ধরে বাজারে পতন হচ্ছে এবং গত ২০ বছরে এত লম্বা সময় বাজার খারাপ ছিল না এ তথ্য তুলে ধরে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, কোথায় পতন হচ্ছে? সূচক ছিল ৪ হাজার ৫০০ পয়েন্ট, হয়ে গিয়েছিল ৫ হাজার ৯০০ পয়েন্ট। বাজারে কাউকে জোর করে নিয়ে আসা যাবে না। কেউ ইচ্ছে হলে আসবেন, নইলে আসবেন না। সূচক যে অবস্থায় আছে, আমরা খারাপ দেখি না। সাংবাদিকদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখানে বাজার চলে আপনাদের দ্বারা। কিন্তু যেভাবে চালাচ্ছেন মনে হয় বাজারই নেই। সূচক ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার ৩০০ পয়েন্ট হলে কী এমন হয়ে যায় বলুন তো! এ সময় মন্ত্রী কিছু উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, জাপানে ১৯৮৯ সালে যে সূচক ছিল ৩৯ হাজার পয়েন্ট, ২০০৭ সালে তা নেমে আসে ৭ হাজার পয়েন্টে। যুক্তরাষ্ট্রেও ১৭ হাজার থেকে ৭ হাজার পয়েন্টে নেমে আসে সূচক। দুনিয়ার সব জায়গাতেই এ রকম হয় এমন মন্তব্য করে মুস্তফা কামাল আবার সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা ভয় দেখাচ্ছেন। ভয় দেখালে তো হবে না। মুশকিল হচ্ছে আমাদের বাজারটা অন্যদের মতো নয়। অন্যদের বাজারে যারা আসেন, বুঝে-শুনেই আসেন। আমাদের বাজারে জেনে-বুঝে আসা লোক কম। অর্থমন্ত্রী বলেন, পুঁজিবাজার দেশের অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুঁজিবাজারের উন্নতি ছাড়া দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজার নিয়ে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুঁজিবাজারের উন্নয়ন করা হবে। আমরা বারবার এ বাজারকে নিয়ে নাজুক অবস্থায় পড়তে চাই না। মানুষের গালাগালি শুনতে চাই না। এ জন্য আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নেব। অনুষ্ঠানে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। এর ফলে আয়ও কমে যাচ্ছে। অনলাইনেও আয় তেমন নেই। সংবাদপত্র প্রকাশে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বাড়ছে। ভ্যাট আইনে সংবাদপত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া আছে। এরপরও এ খাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এ কর প্রত্যাহার করতে হবে। কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর প্রস্তাব করেন মতিউর রহমান। সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া হিসেবে পরিশোধিত অর্থেও শতভাগ করমুক্ত রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, মূল বেতনের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ি ভাড়ায় করমূক্ত রয়েছে। বর্তমান বেতন কাঠামোতে সাংবাদিকদের বাড়িভাড়া দেয়া হয় ৭০ শতাংশ। অবশিষ্ট ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়ায় কর প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশ^ সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন, উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু পরিবেশের দিকে কোন মনোযোগ দেয়া হচ্ছে না। ইচ্ছামতো গাড়ি নামছে ঢাকায়। কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। যানজট কমাতে হলে বাড়তি করারোপ করে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নইম নিজাম বলেন, অর্থনীতিতে চ্যালেঞ্জের সবথেকে বড় জায়গা হচ্ছে ব্যাংক। ব্যাংকে কোন প্রকার দায়বদ্ধতা নেই। কিছু মানুষ ঋণের নামে লোপাট করছে। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে অর্থনীতিতে সঙ্কট আরও বাড়বে। এছাড়া শেয়ার বাজার নিয়েও নতুন করে ভাবতে হবে। ইংরেজী দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, টেক্সেও আওতা বাড়াতে হলে ইনসেনটিভের ব্যবস্থা খাতকে হবে। বাংলাদেশে এ ধরনের কোন ব্যবস্থা নেই। ব্যাংকিং খাতে আস্থা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাজেটে এ নিয়ে পদক্ষেপ থাকা উচিত।
×