ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাজার হাজার কোটি টাকার

যশোরে শতাধিক গাড়ির পার্টস স্প্রিংপাতি ও বডি উৎপাদন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৯:০৫, ২৬ এপ্রিল ২০১৯

যশোরে শতাধিক গাড়ির পার্টস স্প্রিংপাতি ও বডি উৎপাদন হচ্ছে

সাজেদ রহমান, যশোর অফিস ॥ যশোরে শতাধিক গাড়ির পার্টস, স্প্রিংপাতি ও বডি উৎপাদন হচ্ছে। যা আগে সবই আমদানি নির্ভর ছিল। এসব উৎপাদিত গাড়ির পার্টস ব্যবহার করছেন দেশের প্রতিষ্ঠিত পরিবহন ও স্থানীয় রুটের গাড়ির ব্যবসায়ীরা। একইসঙ্গে পাথর ও ইটভাঙ্গা মেশিনও তৈরি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে পাথরভাঙ্গা মেশিন ভারতে রফতানি করছেন উদ্যোক্তারা। যার বাজার হাজার কোটি টাকা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। যশোরের গাড়ির পার্টস উৎপাদনকারীদের মধ্যে অন্যতম এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আক্তার হোসেন জানান, বিসিক শিল্পনগরীতে ২০১১ সালে আমরা এক বিঘা জমির ওপর কারখানা গড়ে তুলি। আমাদের কারখানায় ৫০ শ্রমিক কাজ করছেন। এখানে শতাধিক গাড়ির পার্টস উৎপাদন করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে গাড়ির ব্রেকড্রাম, পেসারপ্লেট, গিয়ারবক্স, ব্রেকডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, গিয়ার বক্সের বডি অন্যতম। এস পার্টস সর্বনিম্ন ৫শ’ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে। বিশেষ করে সব ধরনের গাড়ির ড্রাম যাচ্ছে সারাদেশে। স্বনামধন্য পরিবহন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয় রুটের গাড়ির মালিকরা এসব পার্টস ব্যবহার করছেন। গত তিনবছর আগে শহরতলীল উপশহর এলাকায় এসকে মেটাল ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলেন তরুণ উদ্যোক্তা কামরুল হাসান সোহেল। বর্তমানে সেখানে পিকআপের স্প্রিংপাতি উৎপাদন হচ্ছে। এস পিকআপ, টিকিং পিকআপ, জেক ও আইশার পিকআপে ব্যবহার হচ্ছে এই স্প্রিংপাতি। প্রতিমাসে গড়ে ২ হাজার ৫শ’ থেকে ৩ হাজার পিস স্প্রিংপাতি উৎপাদন করছে প্রতিষ্ঠানটি। এসকে মেটাল ইন্ডাস্ট্রির স্বত্বাধিকারী কামরুল হাসান সোহেল জানান, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পর প্রথমে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছিলাম। পরে চাকরি ছেড়ে ৩ বছর আগে গড়ে তুলি আমরা প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে নিজস্ব মেশিনে স্প্রিংপাতি উৎপাদিত হচ্ছে। এখানে ৫০ শ্রমিক কাজ করছেন। গ্যাস ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত এবং স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা পেলে স্প্রিংপাতির বাজার আরও বড় করতে পারতাম। ১৯৯২ সালে মাত্র ১২শ’ টাকা পুঁজি যশোর শহরে নিয়ে রিপন মেশিনারিজ নামে কৃষি পার্টসের ব্যবসা শুরু করেন আশরাফুল ইসলাম বাবু। এরপর ব্যবসা ভাল হলে ১৯৯৫ সালে রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন হচ্ছে স্টোন মিনি ক্রাশার, ইটভাঙ্গা, পাথরভাঙ্গা মেশিন, ইস্পলার, প্রেসার পুলি, লাইনার স্লট প্লেট, পানির পাম্প, স্যালো ইঞ্জিনের মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ। ওই প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পাথরভাঙ্গা মেশিন দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভারতে রফতানি হচ্ছে। যশোর লাইট অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং মালিক সমিতির সভাপতি ও রিপন মেশিনারিজের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বাবু জানান, প্রতিমাসে তাদের উৎপাদিত পাথরভাঙ্গা মেশিন ১৫টি ভারতে রফতানি করা হচ্ছে। যার প্রতি মেশিনের দাম সাড়ে ৪ লাখ টাকা। আর সারাদেশের বাজারে তাদের ইট ও পাথর ভাঙ্গা মেশিনের বাজার ভাল। শুধু রিপন ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ না, যশোরে অন্তত ৩শ’ হালকা ও ভারি প্রকৌশল শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের পণ্য সারাদেশে ব্যবহার হচ্ছে। অগ্রণী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী শমসের আলী বলেন, তাদের কারখানা যশোর-নড়াইল রোডে অবস্থিত। সেখানে সরিষার তেল ভাঙ্গানো মেশিন, বোতলজাতের জন্য ফিল্টার উৎপাদন হচ্ছে। তাদের পণ্য দেশের ৪০টি জেলায় যাচ্ছে। যশোর বিসিকে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং উৎপাদন করছে টিউবওয়েল, বিচেলিকাটা মেশিন, গাড়ির ড্রাম ও অটোবাইকের পাটর্স। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ইলিয়াস হোসেন জানান, তারা চট্টগ্রাম থেকে জাহাজভাঙ্গা কাঁচামাল হিসেবে কিনে এনে তা গলিয়ে পণ্য উৎপাদন করছেন। যা দেশের বাজারে অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। তিনি বলেন, যদি সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পাওয়া যেত তাহলে এই শিল্প আরও বিকশিত হতো। গাড়ির বডি তৈরি কাজে ব্যস্ত মোঃ শাহিন জানান, বলতে গেলে সারাদেশের বড় গাড়ির বডি যশোরে তৈরি হয়ে থাকে। আমরা সনাতন পদ্ধতিতে বডি তৈরি করছি। স্বনামধন্য পরিবহন থেকে শুরু করে স্থানীয় রুটের গাড়ির বড়ি। এখানকার কারিগররা তৈরি করে থাকে। যার বাজার শতকোটি টাকা হবে। সরকারের সহযোগিতা পেলে আমরা আরও ভালভাবে মেশিন এনে বডি তৈরি করতে পারতাম। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি যশোর জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক সিরাজ খান মিন্টু জানান, জেলায় ৩শ’টি হালকা ও ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি প্রতিষ্ঠান ভারি শিল্প পণ্য উৎপন্ন করছে। যার মধ্যে রয়েছে বড় গাড়ির পাটর্স, পাথর, খোয়া ভাঙ্গা মেশিন, কৃষি পাটর্সস মেশিনারিজ, পাওয়ার টিলার মেশিন, রাইস মিলের মেশিন, বড় গাড়ির যন্ত্রাংশ উল্লেখযোগ্য। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে বছরে হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের সমিতির সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা দিলে আরও ভাল করতে পারতাম। কেননা ইতোমধ্যে ভ্যাট আইন নিয়ে আমাদের মধ্যে ভীতি বিরাজ করছে। যদি প্যাকেজ ভ্যাট উঠে যায় তাহলে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে। সারাবছর শ্রমিক দিয়ে পণ্য উৎপাদন করলেও বিক্রি হয় ৩-৪ মাস। যশোরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প নিয়ে কাজ করছেন এই অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ এনজিও আরআরএফ। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফিলিপ বিশ্বাস জানান, যশোরে অনেক আগে থেকে গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে কারিগররা। তাদের উৎপাদিত যন্ত্রাংশের মান অনেক ভাল। আমরা তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি এবং বাজার সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকি। তাদেরকে ঋণের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ বিষয়ে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, যশোরের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প প্রতিষ্ঠান অনেক আগে থেকে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত যন্ত্রাংশ ভাল মানের। তবে তাদেরকে আরও বিকশিত হতে হলে আন্তর্জাতিক বাজার খুঁজে বের করতে হবে। কেননা উৎপাদিত পণ্যের পরিচিতি না থাকলে তা খুব বেশি এগাবে না। আর ব্যাংগুলোকে ভাল প্রতিষ্ঠানে এসএমই ঋণ দিতে হবে।
×