ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নেত্রকোনার হেদায়েত ও সোহরাবের ফাঁসির হুকুম

প্রকাশিত: ১১:১৯, ২৫ এপ্রিল ২০১৯

নেত্রকোনার হেদায়েত ও সোহরাবের ফাঁসির হুকুম

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নেত্রকোনার আটপাড়ার দুই রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। দুই রাজাকার হলেনÑ হেদায়েত উল্লাহ ওরফে আঞ্জু বিএসসি ও সোহরাব আলী ওরফে ছোরাপ। এর মধ্যে আঞ্জু পলাতক। রায় ঘোষণার সময় ছোরাপ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ৬ অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। হত্যা, গণহত্যাসহ তিনটিতে মৃত্যুদ- ও অন্য তিনটিতে দশ বছর করে কারাদ- দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ৭ জনকে হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত টাঙ্গাইলের মোঃ মাহবুবুর রহমানের মামলার রায় ঘোষণা করা হবে যে কোন দিন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার জন্য সিএভি রেখেছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামে নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বুধবার এ আদেশ প্রদান করেছেন। এটি হলো ট্রাইব্যুনালের ৩৭তম রায়। এর আগে ৩৬টি রায় ঘোষণা করা হয়েছে। নয় বছরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৩৭টি মামলায় মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়েছে ৫৯ জনকে, আমৃত্যু কারাদ- প্রদান করা হয়েছে ২৪ জনকে। আর একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান, একজনকে ৯০ বছরের দ- একজনকে ২০ বছরের কারাদ- প্রাদন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের দ-ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে ৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। যার মধ্যে ৬ জনের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। আর একজনকে আমৃত্যু কারাদ- প্রাদন করা হয়েছে। নেত্রকোনার দুই রাজাকারের মামলার রায় ঘোষণার জন্য গত ৭ মার্চ শুনানি শেষ করে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল, সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নী ও তাপস কান্তি বল। আসামিদের পক্ষে ছিলেন আব্দুর শুক্কর খান। এ মামলায় ২১৮ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। রায় ঘোষণার পর প্রসিকিউটর মোখলেছুর রহমান বাদল সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই ট্রমাগুলো আজও এই দেশের মানুষ বহন করে চলছে। আগামী দিনেও যাতে এ রকম কোন গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত না হয় সেই বিষয়ে বলে দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। ছয় অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছে। অন্য তিনটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে।’ রায়ের পর্যবেক্ষণে গণহত্যা নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন আদালত। সে প্রসঙ্গে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন, ‘মামলার গণহত্যার আগের গণহত্যার বিষয়ে আগের সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করেছে ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে গণহত্যা মানব সভ্যতায় যেন আর সংঘটিত না হয়, আমাদের দেশে তো নয়ই। বিশ্ব সম্প্রদায়কেও যেন গণহত্যার দায় এবং ক্ষত বহন করতে না হয় সেই বিষয়েও রায়ে মন্তব্য করা হয়েছে। আগের গণহত্যার মামলায় রায় দেয়ার ক্ষেত্রে যে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছিল, তার সঙ্গে এটি যুক্ত করেছে আদালত। আমাদের আইসিটি এ্যাক্টে গণহত্যার সংজ্ঞাটি নতুন করে নির্ধারিত হওয়ার পর ট্রাইব্যুনালের এই বক্তব্য প্রমাণ করে যে, গণহত্যা কখনও ক্ষমার যোগ্য নয়। এটি পুনর্বার যেন সংঘটিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’ মামলার সূত্রে জানা যায়, প্রসিকিউশনের তদন্ত দল এ মামলার অনুসন্ধান শুরু করে ২০১৫ সালের ৫ মে। আঞ্জু, মঞ্জু ও ছোরাপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অভিযোগের বিষয়ে ৪০ জনের জবানবন্দী শোনেন তদন্ত কর্মকর্তারা। ছোরাপকে ২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২০১৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাকে ট্রাইব্যুনালের এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। আর এনায়েত উল্লাহ ওরফে মঞ্জুকে গ্রেফতার করা হয় ওই বছরের ৩০ মার্চ। তার ভাই আঞ্জুকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। প্রায় দেড় বছর তদন্তের পর ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ওই তিনজনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। মামলার বিচার শুরুর আগেই ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান এনায়েত উল্লাহ ওরফে মঞ্জু। এরপর ২০১৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আসামি হেদায়েতুল্লাহ আঞ্জু ও ছোরাপ আলীর বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৩ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল গত ৭ মার্চ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখে। অভিযোগগুলো হলোÑ অভিযোগ ১: একাত্তরের ২৯ মে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার মধুয়াখালী গ্রামে ২০-৩০টি ঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং গণহত্যার সমতুল্য অপরাধ। অভিযোগ ২: একাত্তরের ২৩ অগাস্ট নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার মোবারকপুর গ্রামের শহীদ মালেক তালকুদার ও কালা চান মুন্সীকে অপহরণ, হত্যা এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। অভিযোগ ৩: একাত্তরের ৩০ অগাস্ট নেত্রকোনা জেলার মদন থানার মদন গ্রামের শহীদ হেলিম তালুকদারকে অপহরণ ও হত্যা এবং লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। অভিযোগ ৪: একাত্তরের ৩ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার সুখারী গ্রামের দীনেশ চন্দ্র, শৈলেশ চন্দ্র, প্রফুল্ল বালা, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, দুর্গা শংকর ভট্টাচার্য্য, পলু দে, তারেশ চন্দ্র সরকারকে অপহরণ, হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ এবং কিছু হিন্দু পরিবারকে দেশত্যাগে বাধ্য করা। অভিযোগ ৫: একাত্তরের ২ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা জেলার মদন থানার মাঝপাড়া গ্রামের হামিদ হোসেনকে অপরাহরণ, নির্যাতন। অভিযোগ ৬: একাত্তরের ৬ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা জেলার মদন থানার মদন গ্রামের ১৫০-২০০টি ঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। রণদা প্রসাদকে হত্যাকারীর রায় যে কোন দিন ॥ মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত টাঙ্গাইলের মোঃ মাহবুবুর রহমানের মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে যে কোন দিন। বুধবার রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের শুনানি শেষে চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মামলাটির রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন পক্ষে ছিলেন প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত। তার সঙ্গে ছিলেন তাপস কান্তি বল। অন্যদিকে আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী গাজী এম এইচ তানিম। গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন পক্ষ। ১১ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ আমলে নেয়ার পর ২৮ মার্চ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তার বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটির তদন্ত শুরুর পর ট্রাইব্যুনাল থেকে পরোয়ানা জারি হলে ওই বছরের নবেম্বরে মাহবুবকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি এখন গাজীপুরের কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। ২০১৭ সালের ২ নবেম্বর এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা মোঃ আতাউর রহমান। অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, মাহবুবুর রহমান একাত্তরের ৭ মে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর গ্রামে যায়। সেখানে গিয়ে তারা রনদা প্রসাদ সাহা (আরপি সাহা) এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহার খোঁজ করেন। তাদের না পেয়ে তারা ৩৩ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। পরবর্তীতে একই তারিখে রাত ১১টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আরপি সাহা ও ভবানী প্রসাদ সাহাসহ ৫ জনকে অপহরণ ও হত্যা করে। অন্যদিকে আসামিসহ রাজাকাররা ২৪ নিরীহ মানুষকে আটক করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। তার মধ্যে ২২ জনকে হত্যা করা হয়। প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা সূত্রে জানা গেছে , ১৯৭১ সালের ৭ মে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী মির্জাপুরের সাধারণ মানুষের ওপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে ব্যাপক গণহত্যা চালায় এবং গ্রামবাসীর বাড়িঘর লুটপাট করে। এদিন রাতে আরপি সাহাকে ও নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কমপ্লেক্স থেকে তার একমাত্র ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর আর তাদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ১৯৭১ সালের ৭ মে ছিল শুক্রবার। মির্জাপুরে সাপ্তাহিক হাটবার। এদিন জুমার নামাজের পর স্থানীয় দালাল মওলানা ওয়াদুদের নির্দেশে ও তার দুই ছেলে মান্নান ও মাহবুবের নেতৃত্বে কিছু ধর্মান্ধ ব্যক্তি মির্জাপুর বাজারে ব্যাপক লুটপাট চালায়। একই সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে মির্জাপুরের সাহাপাড়ায় হামলা চালিয়ে নিরপরাধ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে পাশের বংশাই নদীতে ভাসিয়ে দেয়। আসামি মাহাবুর রহমানকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
×