ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাল চন্দ্র মিত্র

প্রণয় ও পরিণয়

প্রকাশিত: ০৯:৩১, ২৫ এপ্রিল ২০১৯

প্রণয় ও পরিণয়

বিবাহ একটি আনন্দঘন পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানই শুধু নয়, একটি সামাজিক চুক্তির অনুষ্ঠানও বটে। বিবাহ অনুষ্ঠানটি শুরু হয় মিষ্টান্ন দিয়ে। কিন্তু সব সময় মধুরেণ সমাপণ হয় না। এক সময় সমাজে বিবাহ প্রথারই কোন চল ছিলনা। বিবাহের জন্য শারীরিক ও মানসিক উপযুক্ততা ও স্বাস্থ্যগত ন্যায্যতা বিবেচনা ছাড়াই অপরিণত বয়সে ছেলেমেয়ের বিবাহ দিয়ে দিতেন। এ কারণে সমাজে বাল্যবিয়ের প্রচলন ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। ফলে দম্পতির স্বাস্থ্য সমস্যা, অকাল বার্ধক্য, স্বল্পায়ু এবং প্রসূতি ও শিশু মৃত্যুর হারও ছিল গণনা করার মতো। সেকালে সন্তানদের বিয়ের দায় মূলত মাতা-পিতা ও অভিভাবকদের বহন করতে হতো। মুখ্যত দুটি পরিবারের পছন্দ ও সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহের আয়োজন করা হতো। পাত্র-পাত্রীর পছন্দ-অপছন্দ ছিল নিতান্তই গৌণ। প্রেম, ভালবাসা, সমঝোতা, একে অপরের প্রতি সম্মান ও মর্যাদাবোধ, পরস্পরের প্রতি আনুগত্য, আস্থা, সহমর্মিতা ও সেবার মনোভাব আনন্দময় ও সফল দাম্পত্য জীবনের পূর্বশর্ত। বিগত দিনে দাম্পত্য প্রেম-ভালবাসা ছিল পরিণয় সাপেক্ষ। অচেনা-অজানা দুটি বাগান থেকে দুটি ফুলকে তুলে এনে বিবাহ নামক একটি বৃন্তে গেঁথে দেয়া হতো। পারস্পরিক বোঝাপড়া ও লেনা-দেনার ভিত্তিতে দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে তুলতে হতো। আজকের দিনে পরিণয় হয়েছে প্রণয় সাপেক্ষ। ছেলেমেয়েরা অনেকেই নিজেদের উদ্যোগে, পছন্দে ও সিদ্ধান্তে কখনও অভিভাবকদের সম্মতি অথবা সম্মতি ব্যতিরেকেই বিয়ে করে থাকে। আগে দেখা পরে জানা ও ডিজিটাল চ্যাটিং ও ডেটিং এর মাধ্যমে ভাববিনিময়। কখনও কখনও গেট-টুগেদার পর্যন্তও গড়ায়। এ যেন সেই গানের কলির অনুরণন। এক বৈশাখে দেখা হলো দু’জনায় ॥ জ্যৈষ্ঠেতে হলো পরিচয় ॥ আসছে আষাঢ় মাস, মন তাই ভাবছে, কি হয় কি হয় ॥ কি জানি, কি হয়? অর্থাৎ আগে জানাজানি, কানাকানি, বাজিয়ে নেয়া ও ভাব বিনিময়। পরিণামে পরিণয়। সেকালে পরিণয় সাপেক্ষ প্রণয় বন্ধন যতটা অটুট থাকত একালে প্রণয় সাপেক্ষ পরিণয়ে ততটা থাকে না। চ্যাটিং-ডেটিং কালের ভাবালুতা, যা নয় সেভাবে একে অপরকে উপস্থাপনার প্রবণতা এক ধরনের মোহজাল ও কল্পলোকের সৃষ্টি করে থাকে। পরিণয়ের পরিণামে পড়ে এর অনেকটাই বাস্তবতার রূঢ় কশাঘাতে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে এবং প্রাথমিক মোহজাল কাটতে শুরু করে। বিশেষ করে দারিদ্র্য যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, প্রেম-ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। ফলে দাম্পত্য সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। অনিবার্য পরিণাম ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ যা একালে বেড়েই চলেছে। একালের প্রণয় সাপেক্ষ পরিণয়ের একটি বড় বৈশিষ্ট্য এই যে ছেলেটি মেয়েটির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আর মেয়েটি সেই সুযোগে ছেলেটির ওপর কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে ওঠে। সেকালে সন্তানদের (ছেলে হোক মেয়ে হোক) বিয়ের দায় ছিল পিতামাতা-অভিভাবকদের। একালে পাত্র-পাত্রীদের স্বাধীনতা, প্রগতি, আধুনিকতা ও সাম্যের দাবি মুখ্য হওয়ায় অভিভাবকদের পছন্দ-অপছন্দ ক্ষেত্রবিশেষে সম্মতি-অসম্মতিকে গুরুত্ব না দেয়ার প্রবণতা সমাজে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। আগের দিনের যৌথ পরিবার প্রথা ভেঙ্গে পড়া এবং স্বামী-স্ত্রী-সন্তানভিত্তিক একক পরিবার গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতে পরিবারে মা-বাবারা অবহেলা ক্ষেত্রবিশেষে নিপীড়নের শিকার হয়ে পড়ছে। দেশে ও সমাজে বৃদ্ধাশ্রম (ওল্ড এজ হোম) প্রতিষ্ঠা ও সেখানে বাসিন্দাদের সংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটা তার অনিবার্য ফল। যা হোক বিয়ের মতো একটি আনন্দময় ও সৃজনশীল সামাজিক চুক্তিভিতিক অনুষ্ঠান সর্বাঙ্গীণ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়ে মধুময় পরিণতি লাভ করবে এটাই প্রত্যাশা। যৌথ বা একক যেমনই হোক শেষ পর্যন্ত সুখময় সুখের সংসার গড়ে উঠুক এটাই কামনা। শান্তিবাগ, পটুয়াখালী থেকে
×