ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আগামী এক শ’ দিনকে ভালভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ

প্রকাশিত: ১১:০৯, ২৪ এপ্রিল ২০১৯

আগামী এক শ’ দিনকে ভালভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আমরা উৎসাহহীন, উদ্যোগহীন, উচ্ছ্বাসহীন ও উদ্যমহীন ১০০ দিন দেখেছি। আশা করেছিলাম, ১০০ দিনে বড় ধরনের উত্থানের প্রতিফলন দেখতে পাব। কিন্তু তা না হয়ে শুধু ধারাবাহিক উদ্যোগ ছিল। আবার সরকার যে ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তা মিশ্র ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেমন কর ছাড়, সুদের হারে সুবিধা। এজন্য গত ১০০ দিন ভুলে আগামী ১০০ দিনকে ভালভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন এ অর্থনীতিবিদ। মঙ্গলবার সিপিডির এক সংবাদ সম্মেলনে বর্তমান সরকারের ১০০ দিন নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের স্বাধীন পর্যালোচনা : বর্তমান সরকারের প্রথম এক শ’ দিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান। এ ছাড়া বক্তব্য দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সরকারের কিছু ভাল উদ্যোগের কথা জানান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার মতে, এই ভাল উদ্যোগের মধ্যে আছে, বিদেশী কর্মজীবীদের বিষয়ে জরিপ চালিয়ে করের আওতায় আনার উদ্যোগ, মানিলন্ডারিং বিধিমালা জারি করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপনকে করের আওতায় আনা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাব করা আট দশমিক ১৩ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিকে ঈর্ষণীয় বলছে সিপিডি। উৎপাদন খাতের ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধিই জিডিপির প্রবৃদ্ধি চালিকাশক্তি। তবে সিপিডি এই প্রবৃদ্ধির হিসাব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। সিপিডির মতে, এই হিসাব বাস্তবসম্মত নয়। অর্থনীতির সূচকগুলোর সঙ্গে এর মিল নেই। জিডিপির হিসাব আরও গভীরে গিয়ে করা উচিত। তা না হলে নীতিনির্ধারণে সমস্যা হবে। সিপিডি কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরে জিডিপির হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। সিপিডি বলেছে, উৎপাদন খাত নির্ভর প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিবিএসের হিসাব, চামড়া খাতে প্রথম প্রান্তিকে সাড়ে ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ রফতানিতে নেতিবাচক প্রবণতা রয়েছে। রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু চলতি মূল্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখানো হয়েছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। আবার গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেসরকারী খাতে ঋণ প্রবাহে প্রবৃদ্ধি সাড়ে ১২ শতাংশ। কিন্তু গতবার একই সময়ে এই খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। সিপিডির মতে, বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মানে হলো, শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ভূমিকা দেখিনি। আবার কর আহরণের শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি নেই। ব্যক্তি খাতের ঋণ প্রবাহ বেশি হয়নি। মূলধনী পণ্যের আমদানিও বেশি দেখা যায়নি। ব্যাংক খাতেও চাঞ্চল্য নেই। তিনি বলেন, যেহেতু বিনিয়োগ বেশি হয়নি, তাই উৎপাদনশীলতা বেশি দেখাতে হবে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, গত কয়েক বছরে কি এমন প্রযুক্তির উন্নয়ন হয়েছে, যাতে শ্রমের উৎপাদনশীলতা এত বাড়ল? আবার উৎপাদনশীলতা বাড়লে শ্রমিকের আয় বৃদ্ধি হওয়ার কথা। কিন্তু সর্বশেষ খানা আয় ও ব্যয় জরিপে এর প্রতিফলন নেই। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কতটা কর্মসংস্থান হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাই প্রবৃদ্ধির হিসাবটি উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে না। যেসব দেশে বৈষম্য কম সেসব দেশে তুলনামূলকভাবে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা সহজ হয় বলে মনে করেন সিপিডির আরেক বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বৈষম্য কমানোর দিকে নজর না দিলে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে। নির্বাচনী ইশতেহার সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, শাসক দলের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বাস্তবায়নের মধ্যে পার্থক্য আছে। শাসক দল বলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে তা দেখছি না। রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি হলো পরিবর্তন, দিন বদল। কিন্তু তা আটকে রাখছে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে থাকা সুবিধাভোগীরা। আওয়ামী লীগের দেয়া নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই নিতে হবে। তা না হলে এই ইশতেহার কাল্পনিক দলিল হিসেবে ইতিহাস বিচার করবে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। আমরা অতীতে দেখেছি, বড় বড় উদ্যোক্তার অর্থ জোগানের ক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থার একটা ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এখন আমরা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছি ঋণখেলাপী এটা একটা সমস্যা তা সবাই স্বীকার করছে। সরকারও স্বীকার করছে, যার ফলে আমরা দেখছি নানামুখী উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কীভাবে এটা (খেলাপী ঋণ) কমানো যায়। তিনি বলেন, কিন্তু দুঃখজনক হলো সত্যিকার অর্থে ঋণখেলাপী না কমিয়ে, সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে এটা কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যার ফলে আমরা গুড প্র্যাকটিস থেকে ব্যাড প্র্যাকটিসে চলে যাচ্ছি। সুবিধা দেয়ার ফলে ঋণখেলাপীরা উৎসাহিত হবে। সেই সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকও উৎসাহিত হবে। তার ফলে তারল্যের ওপর প্রভাব পড়বে। তারল্যের ওপর প্রভাব পড়ার কারণে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থসঙ্কট দেখা দেবে এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য যখন ব্যাংকের কাছে অর্থ চাওয়া হবে তখন ব্যাংক যদি অর্থ দিতে না পারে তাহেল আমাদের বিনিয়োগ এবং অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে। ফাহমিদা বলেন, আমরা মনে করি খেলাপী ঋণের বিষয়ে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তার ফলে আমরা উল্টো দিকে যাচ্ছি। এর ফলে ব্যাংকের প্রকৃত যে স্বাস্থ্য তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে না। এটা ভাসা ভাসা একটা সমাধান। সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা একটি ব্যাংক কমিশনের কথা বলেছিলাম। আমরা সেটার জন্য কাজ করছি। সরকারের কাছে আমরা বার বার ব্যাংকিং কমিশনের কথা বলেছি। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত সেরকম কোন উদ্যোগ নেয়নি। এখন আমরা শুধু ব্যাংকিং কমিশন নয়, নাগরিকদের নিয়েও কমিশনের চিন্তাভাবনা করছি। এর আগে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। এ সময় খেলাপী ঋণ ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, খেলাপী ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান সরকারের ১০০ দিনে ব্যাংক খাতের কোন উন্নয়ন আমরা দেখছি না। সরকারের পক্ষ থেকে ভাল ঋণ গ্রহীতাদের ছাড় দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কারা ভাল ঋণ গ্রহীতা সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা আসেনি। এটা নির্দিষ্ট করা উচিত। তা না হলে এর ফলে সুযোগ নেয়া হবে এবং অর্থনীতির জন্য কোন লাভ হবে না। সিনিয়র ফেলো খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বৈষম্য চরমে। আমাদের ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রে যেতে হলে, সার্বিক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে এগোতে হবে। শ্রমবাজার বাড়ছে শিক্ষিত কিন্তু বেকারও বাড়ছে, দক্ষ শ্রমশক্তি বাড়াতে হবে।
×