ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নুসরাত হত্যাকাণ্ড

অর্থ যোগানদাতার খোঁজে সিআইডি সোনাগাজীতে

প্রকাশিত: ১১:০০, ২৪ এপ্রিল ২০১৯

অর্থ যোগানদাতার খোঁজে সিআইডি সোনাগাজীতে

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে আগুন পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার অর্থ যোগানদাতার খোঁজে ঢাকার সিআইডির একটি বিশেষ টিম ফেনীর সোনাগাজীর সেই মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছে। একই সঙ্গে পিবিআই টিম হত্যা মামলার আসামিদের বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাব তল্লাশি চালিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এই হত্যা মামলার নাটেরগুরু স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা রুহুল আমিন রিমান্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পিবিআইয়ের তদন্ত টিম। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নুসরাতের যৌন হয়রানির পর পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় অর্থ যোগানদাতাদের খোঁজে মঙ্গলবার সকালে ফেনীর সোনাগাজীতে গেছে ঢাকা সিআইডির বিশেষ টিম। আমাদের ফেনীর নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, সিআইডি টিমটি সেই ইসলামিয়া ফাজিল ডিগ্রী মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছেন। সিআইডির সূত্র জানায়, নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বিশেষ মহল তৎপর ছিল। এজন্য কারা এই ঘটনাটি ভিন্নখাতে পরিচালনার জন্য অর্থ লেনদেন করেছে। কারা সুবিধা নিয়েছে। তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। এ সময় সিআইডির টিমটি সোনাগাজীর বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলছে। একই সঙ্গে পিবিআই টিম মামলার গ্রেফতারকৃত আলোচিত আসামিদের ব্যাংক হিসাবে তল্লাশির জন্য মাঠে নেমেছে। তারা সোনাগাজীর বিভিন্ন ব্যাংকে তল্লাশি চালিয়েছে। মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মামলার প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ও সন্দেহভাজন যাদের নাম এসেছে তাদের ব্যাংক হিসাব খতিয়ে দেখতেই ফেনীর সোনাগাজীর বিভিন্ন ব্যাংকে এই তল্লাশি। এদিকে এই মামলার অন্যতম আসামি রুহুল আমিনকে ৫দিনের রিমান্ড তৃতীয় দিনের জিজ্ঞাসাবাদে নুসরাত যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। পিবিআইবির তার ব্যাংক হিসাব ও মোবাইল কললিস্ট নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, নুসরাত যৌন নির্যাতনে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। পরে সিরাজকে গ্রেফতার করা হয়। এর পরই আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন নুসরাতের পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় রুহুল সিরাজ উদ দৌলার নানা অপকর্ম ধামাচাপা দিতে চেষ্টা চালায়। এজন্য তিনি নুসরাতের পরিবারকে নানা হেনস্তা করেন। মামলা তুলে নেয়ার জন্য চাপ দেন রুহুল আমিনের ক্যাডাররা। পরে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করেন রুহুল। পরে নুসরাতকে থানায় ডেকে এনে ভিডিও করে নানাভাবে হেনস্তা করেন। রুহুল ওই মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি হয়ে যান। মাদ্রাসার মার্কেটের ১২টি দোকান, ভেতরের বিশাল পুকুরের মাছ চাষ ও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানা উপায়ে আদায় করা বাড়তি টাকার ভাগ পেতেন রুহুল আমিন ও আরেক সদস্য কাউন্সিলর মাকসুদ। ক্যাম্পাসের বাইরে মাদ্রাসার রয়েছে জমিসহ কোটি টাকার সম্পদ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, শনিবার বিকেলে নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা মামলার আলোচিত আসামি সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিনকে ৫দিনের রিমান্ড নিয়েছে পিবিআই। এছাড়া আসামি জাবেদ ও কামরুন নাহার মনিকে আদালতে হাজির করা হয়। পরে তারা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক শাহ আলম জানান, এই হত্যাকা-ের অন্যতম আসামি জাবেদ ও কামরুন নাহার মনি এজাহারভুক্ত আসামি নূর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেন। তারা জানান, জাবেদ ও মনি সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয়। জাবেদ নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। মনি বোরকা সংগ্রহ ও নুসরাতের হাত-পা চেপে ধরে আগুন লাগিয়ে দেয়। অপরদিকে ওই ঘটনায় আওয়ামী লীগের রুহুল আমিন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জানতেন বলেও তাদের জবানবন্দীতে উঠে আসে। কিলিং অপারেশনের পর কিলাররা রুহুল আমিনকে ফোন করেন। তখন রুহুল আমিন বলেন, আমি জানি, তোমরা চলে যাও। নুসরাত হত্যা করার মিশনে অংশ নিয়েছিলেন তার সহপাঠী জবানবন্দীতে জানা গেছে, মনি এখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অর্থাৎ গর্ভে সন্তান নিয়েই নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনায় যুক্ত হন তিনি। আর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই তিনি এখন কারাগারে। দোষীদের শাস্তি চান আসামিদের স্বজনরাও ॥ নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় কঠোর শাস্তি চান আসামিদের স্বজনরাও। এ জঘন্যতম অপরাধ যারা করেছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া দরকার বলে দাবি করেছেন তারা। নুসরাতকে ডেকে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে পুড়িয়ে হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত অধ্যক্ষ সিরাজের শ্যালিকার মেয়ে মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী উম্মে সুলতানা পপি ওরফে শম্পা। সে উপজেলার মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নের লক্ষীপুর গ্রামের শহিদুল ইসলামের মেয়ে। পপির বাবা শহীদুল ইসলাম জানান,অধ্যক্ষ আমার ভায়রা। তিনি যে অপকর্ম করেছেন। তাকে আত্মীয় পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করি। তার অপকর্মের বলি হয়েছে আমার মেয়ে পপি। আত্মীয় হওয়ার কারণে মেয়ে পপিকে ওই কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। আমার মেয়ে অন্যায় করলে তার শাস্তি চাই। আসামি শাহাদাত হোসেন শামীমের মা বিবি ফাতেমা জানান, একজন সহপাঠীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার মতো জঘন্যতম অপরাধ যারা করেছে তাদের শাস্তি হওয়া চাই। এতে আমার সন্তান শামীম জড়িত থাকলেও। এ রকম সন্তানের মা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে চাই না। তার মৃত্যুর আগে আমার মৃত্যু হয়ে যাক। তবে আসামি মোঃ জাবেদের পিতা রহমত উল্লাহ দাবি করেন, জাবেদ খুব সহজ-সরল ছেলে। সে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকতে পারে না। তবে যদি কারও সহযোগিতায় হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকে তাহলে কিছুই বলার নেই। উত্তর চর ছান্দিয়ায় নূর উদ্দিনের বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে পরিবারের লোকজন কোথায় গেছে? তা কেউ বলতে পারছে না। তবে বাড়ির লোকজন জানায়, জড়িত সবার কঠোর বিচার হওয়া দরকার যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস না পায়। এদিকে নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদ হাসান নোমান জানান, সারাদেশের জনগণের এখন দাবি রাফির খুনীদের উপযুক্ত বিচার। এ হত্যাকাণ্ডে যারা পরিকল্পনাকারী, মদদদাতা ও কিলিং মিশনে জড়িত তাদের অবশ্যই কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বাবা মাওলানা একেএম মুসা মানিক। তিনি বলেন, মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার দোসরদের দেয়া আগুনে পুড়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নুসরাতের খোঁজখবর নিয়েছেন এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নিতেও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই বাংলাদেশ এবং সিঙ্গাপুরে খ্যাতনামা চিকিৎসকরা আমার মেয়ের চিকিৎসার জন্য কাজ করে গেছেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতায় মেয়েকে বাঁচানো যায়নি। বাবা মাওলানা মুসা মানিক আরও বলেন, আমার মেয়ের মৃত্যর পরে এ ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করার জন্য দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশনা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। আর তার ফলশ্রুতিতেই খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে প্রায় আসামি। আসামিদের এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। মা শিরিন আখতার বলেন, মেয়েটা আমার পিছু ছাড়ত না।
×