ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াবহ শব্দদূষণ- দশ মিনিটে হাজার বার হর্ন

প্রকাশিত: ১০:৫৪, ২৪ এপ্রিল ২০১৯

ভয়াবহ শব্দদূষণ- দশ মিনিটে হাজার বার হর্ন

শাহীন রহমান ॥ শব্দ দূষণের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী। শব্দ দূষণের হাত থেকে রক্ষা পেতে আলাদা নীতিমালা করা হলেও এই নীতিমালা কেউ মেনে চলে না। ফলে যে যার ইচ্ছামতো গাড়ির হর্ন বাজিয়ে রাস্তায় চলাচল করছে। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, নীতিমালা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকায় যেখানে সর্বোচ্চ শব্দের মাত্রা থাকা উচিত ৩৫ থেকে ৭৫ ডেসিবলের মধ্যে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ১৩২ ডেসিবল পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মাত্রার শব্দ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ। পরিবেশ অধিদফতরের জরিপে দেখা গেছে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে যানবাহন এবং এর হর্ন শব্দের প্রধান উৎস হিসেবে উঠে এসেছে। হর্ন গণনায় দেখা যায়, অনেক স্থানেই মাত্র ১০ মিনিটে ৫শ’ থেকে ১ হাজারবার বাজানো হচ্ছে। এছাড়া সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, নির্মাণ কাজ এবং কল-কারখানা থেকেও শব্দ দূষণ হচ্ছে। এদিকে শব্দ দূষণ রোধে সচেতনতা তৈরিতে আজ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস। দিবসটি পালনের জন্য পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এই কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশ। পরিবেশ অধিদফতর জানায়, ১৯৯৬ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস পালিত হয়। বিগত চার বছর পরিবেশ অধিদফতরের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। তবে বেসরকারী সংস্থার উদ্যোগে দেশে এক যুগের বেশি সময় ধরে দিবসটি উদযাপিত হয়। জানা গেছে শব্দ দূষণ রোধে দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এটি রোধে আইনের কার্যকর কোন প্রয়োগ নেই। এদিকে সরজমিনে দেখা যাচ্ছে পরিবহন চলাচল বা নির্মাণ কার্য পরিচালনা অথবা সভাসমাবেশ বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক বা যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোন আইন মানা হচ্ছে না। সাধারণ জনগণের এ বিষয়ে কোন সচেতনতা নেই। এ ক্ষেত্রে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতার প্রয়োগ ঘটছে বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকস্মিক তীব্র শব্দে মানুষ আংশিক বা সম্পূর্ণ বধির হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘদিন মাত্রাতিরিক্ত শব্দের মধ্যে অবস্থান করলে কানে শোনার ক্ষমতা লোপ পায়, যা আর ফিরে পাওয়া যায় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ শতাংশ শ্রবণজনিত সমস্যার কারণে তাদের নিত্য জীবনে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। বাংলাদেশে ১১.৭ শতাংশ মানুষ উভয় কানে শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এছাড়া শব্দ দূষণের কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপি- ও মস্তিষ্কে অক্সিজেন কমে যেতে পারে। এতে শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একজন মানুষের প্রতিদিন বিভিন্ন মাত্রার শব্দের মধ্যে অবস্থানের মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। তাদের এই মানদ- অনুযায়ী একজন মানুষ যথাক্রমে ৯০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ২ ঘণ্টা ৩০ মিনিট, ১০০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ১৫ মিনিট, ১১০ ডেসিবল শব্দের মধ্যে ৩০ সেকেন্ড, ১২০ ফই শব্দের মধ্যে ৯ সেকেন্ড এবং ১৩০ ফই শব্দের মধ্যে ০১ সেকেন্ডের কম সময় অবস্থান করতে পারেন। অথচ ঢাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ১৩০ ডেসিবল পর্যন্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দকে সহনীয় হিসেবে ধরা হয়। এদিকে শব্দ দূষণের ক্ষতির হাত থেকে জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে দেশে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ এ এলাকাভেদে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে রাত ও দিন ভেদে সর্বনি¤œ ৪০ ডেসিবল এবং সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দ অনুমোদিত রয়েছে। এই নীতিমালায় ঢাকাকে পাঁচটি এলাকায় ভাগ করে প্রতিটি এলাকার জন্য শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দিন ও রাতের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ মাত্রার শব্দ হচ্ছে নীরব এলাকায় ৪৫ ও ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় ৫০ ও ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় ৭৫ ও ৭০ ডেসিবল। কিন্তু জরিপে দেখা গেছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরের কোথাও শব্দের মাত্রা এই মানদ-ের মধ্যে সীমিত নেই। কোথাও কোথাও তা দ্বিগুণের বেশি। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদফতর দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে শব্দের মানমাত্রা পরিমাপ বিষয়ক একটি জরিপ করেছে। দেখা গেছে সবখানেই শব্দের মানমাত্রা অতিক্রম করেছে। রেকর্ডকৃত আকস্মিক শব্দের মাত্রা হচ্ছে, ঢাকায় সর্বোচ্চ ১৩২ ডেসিবল, ও সর্বনিম্ন ৫১ ডেসিবল, চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ১৩৩ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪৭ ডেসিবল, সিলেটে সর্বোচ্চ ১৩১ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৫০ ডেসিবল, খুলনায় সর্বোচ্চ ১৩২ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪২ ডেসিবল, বরিশালে সর্বোচ্চ ১৩১ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৫৪ ডেসিবল, রংপুরে সর্বোচ্চ ১৩০ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪৬ ডেসিবল, রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ১৩৩ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৫৬ ডেসিবল এবং ময়মনসিংহে সর্বোচ্চ ১৩১ ডেসিবল ও সর্বনিম্ন ৪৭ ডেসিবল। পরিবেশ অধিদফতর পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬ অনুসারে, নীরব এলাকা অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, উপাসনালয় রয়েছে এমন এলাকায় চলাচলকালে যানবাহনে কোন প্রকার হর্ন বাজানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা হতে ৫শ’ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ইট বা পাথর ভাঙ্গার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত মিকচার মেশিনসহ নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য যন্ত্র বা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। কোন ধরনের অনুষ্ঠানে শব্দের মানমাত্রা অতিক্রমকারী কোন যন্ত্রপাতি দৈনিক ৫ ঘণ্টার বেশি সময়ব্যাপী ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করা যাবে না এবং অনুমোদনের সময়সীমা রাত্রি ১০টা অতিক্রম করবে না। অথচ ঢাকায় কোথাও এই নীতিমালা মেনে কর্মকা- পরিচালনা করতে দেখা যায়নি। ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যানবাহনের শব্দ দূষণের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিশেষ করে ৬৫ কিংবা এর চেয়ে বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি আরও বেশি। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৫০ হাজারেরও বেশি লোকের ওপর এক জরিপ শেষে দেখা গেছে অতিরিক্ত প্রতি ১০ ডেসিবল শব্দের জন্য স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ১৪ শতাংশ। এ ঝুঁকি গড়ে সব বয়সীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ ডেসিবল শব্দে স্ট্রোকের ঝুঁকি ২৭ শতাংশ বাড়ে। নতুন এ গবেষণায় দেখা গেছে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন শব্দের কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। গবেষণায় বলা হয়েছে, সবধরনের স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ৮ শতাংশ এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে ১৯ শতাংশের জন্য দায়ী যানবাহনের অতিরিক্ত শব্দ। এছাড়া শব্দের কারণে চাপ তৈরি হয় এবং তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। এর ফলে রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় দেশের শব্দ দূষণ নীতিমালায় এ ধরনের অপরাধের জন্য ১ মাসের কারাদণ্ড বা ৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। পরবর্তী দফায় একই অপরাধের জন্য ৬ মাসের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। বিধিমালা তৈরি পর আজ পর্যন্ত শব্দ দূষণের অভিযানে কারো জেল দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। অবশ্য শব্দ দূষণের অভিযোগে কিছু কিছু যানবাহনের জরিমানা করা হয়েছে।
×